‘চট্টগ্রাম নগরজুড়ে সেবার মান নিম্নমুখী। স্বাচ্ছন্দ্য সংকট বাড়ছে। সেবা বিবেচনায় খোদ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মূল্যায়নেই চসিকের অবস্থান পিছিয়েছে ৯ ধাপ। ফলত জনমনেও বাড়ছে অসন্তোষ!’
চট্টগ্রাম সিটিতে সরকারবিরোধী একাংশের এমন মন্তব্যের পালে লেগেছে জোর। এখনই বইতে শুরু হয়েছে আগামী সিটি নির্বাচনী হাওয়া। তবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনই হবে পরবর্তী চসিক নির্বাচনের ‘ল্যান্ডমার্ক’- এমনটিই মনে করছেন গেল বারের প্রার্থী ও আগামী বারের সম্ভাব্যরা। আগামীতে কে হচ্ছেন মেয়র? আওয়ামী লীগের কে পাচ্ছেন মনোনয়ন? আগামী সিটি ভোটে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ থাকবে, নাকি থাকবে না? নির্বাচনের রূপটাই বা কেমন হবে? রাজনৈতিক অঙ্গনে এসব প্রশ্নে আলোচনা দিন দিন জোরদার হচ্ছে। নগর নির্বাচনের এখনো প্রায় তিন বছর বাকি। অনেকের শঙ্কা ও অভিযোগ নাকচ করে ক্ষমতাসীনরা বলছেন, এখনো চসিক মেয়রের কাজের মূল্যায়নের সঠিক সময় আসেনি। তাই বর্তমান মেয়র মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিমের জায়গায় অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্তের অবকাশ নেই। তা সত্ত্বেও মেয়র পদের আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠের আলোচনায় আছেন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, বিএনপি ত্যাগী সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম ও জাতীয় পার্টি মনোনীত চট্টগ্রামের প্রথম মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। অন্যদিকে বিএনপিতে এখনো সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী হিসেবে গেলবারের প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনকেই ‘সবেধন নীলমণি’ বলে ভাবা হলেও আসতে পারে চমক! সাবেক মেয়র ও প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনের ছেলে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার মীর হেলালও প্রার্থী হতে পারেন। অবশ্য বিএনপি অভ্যন্তরে নির্বাচন নিয়ে এখনো আছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। নির্বাচন কোন পন্থায় হবে সেই বিতর্ক দূরে ঠেলেও এখনই নগর সেবার মান ও গতি নিম্নগামী হওয়ায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করছে নগরবাসী। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে সাফল্য না আসা, মশার উৎপাত বৃদ্ধি, হোল্ডিং ট্যাক্সের করাল গ্রাসে ত্যক্ত-বিরক্ত মানুষ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের মূল্যায়নে চসিকের সেবার মান ৯ থেকে ১৮-তে নামাকেই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। তারা বলছেন, দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে চসিকের সেবার মান একদম তলানিতে। অনেকের ধারণা, সরকারি এ মূল্যায়নই আসন্ন নির্বাচনে মেয়র পদে পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। এদিকে রাজনৈতিক বলয়ের অন্দরমহল ও মাঠপর্যায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মহানগর সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনকে নিয়েই যেন আলোচনাটি জমজমাট। অভূতপূর্ব জনসমাগমে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমাবেশের সমন্বয়ে সাফল্য এবং চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে সমর্থক প্রার্থী নোমান আল মাহমুদের মনোনয়ন লাভ আ জ ম নাছির উদ্দিনকে এনেছে নতুন করে আলোচনায়। তিনিও আছেন ফুরফুরে মেজাজে। তাঁকে ঘিরে দলীয় হাইকমান্ড ও সাধারণ কর্মীদের আস্থার ভিত ‘আরও মজবুত হয়েছে’ বলে মনে করছেন সমর্থকরা। ফের কি আওয়ামী লীগের মেয়র পদে মনোনয়ন চাইবেন? এমনটি জানতে চাইলে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আগামী চসিক নির্বাচনের আগে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন আছে। সেই নির্বাচন এবং পরবর্তীতে শহর প্রশাসন দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী কীভাবে সাজাবেন, তার ওপরই আমার নির্ভরতা। তাঁর নির্দেশনায় আমরা এগোব।’ চসিক নির্বাচন ঘিরে আরেক আলোচিত নাম বিএনপি ছেড়ে দেওয়া মনজুর আলম। তিনি বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে নানা কার্যক্রমে জড়িত থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যুক্ত নন। তবু আগামী মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে তাঁকে নিয়েও গুঞ্জন আছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন রাখা হলে সাবেক এই মেয়র বলেন, ‘আমি তো শুধু বিএনপি থেকে নয়, রাজনীতি থেকেও অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছি।’ মনজুর আলম জানান, তিনি সমাজসেবা নিয়ে আছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের জন্য কাজ করে যাবেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুসংহত জোট হলে সে ক্ষেত্রে চসিক মেয়র পদে লড়তে চান চট্টগ্রামের প্রথম মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। জাতীয় পার্টির এই প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ‘ভোটের পরিবেশ এখনো হয়নি। অবস্থার পরিবর্তন হলে, পরিবেশ ফিরে এলে সেই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে দল ও কোনো মিত্র জোটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।’ তবে মেয়র পদের ক্ষমতা ও মর্যাদাগত পুরনো মজবুত অবস্থান এখন নেই বলে জানালেন তিনি। বলেন, আগে চসিক সভায় বিভিন্ন সেবা সংস্থার ‘অফিশিয়াল কমিশনার’-এর উপস্থিতির প্রথা বাতিল করে দিয়ে বিএনপির সময় সেবা প্রাপ্তির সমন্বয়কে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় থাকা ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘ভোট মানুষের অধিকার। সেই অধিকার, অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ ফিরে না এলে পরবর্তী যে কোনো নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার প্রয়োজন। তা না হলে কেন সেই ভোটে অংশ নেব?’ নগরবাসীর মৌলিক চাহিদাগুলো, সেবাগুলো পূরণ হয়নি, উপরন্তু হোল্ডিং ট্যাক্স চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য এই বিএনপি নেতার। এদিকে বিএনপির অভ্যন্তরে সম্ভাব্য মেয়র পদে আলোচিত আরেক তরুণ নেতা ব্যারিস্টার মীর হেলাল বলেন, ‘আমার বাবা নগরপিতা ছিলেন এবং আমিও চট্টগ্রাম নগরের সন্তান, সেহেতু দল সিদ্ধান্ত দিলে নির্বাচন করতেই পারি।’ এদিকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নগর সেবা নিয়ে নানা অভিযোগ কিংবা স্থানীয় সরকারের মূল্যায়ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক না তুলে মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘করোনা-পরবর্তী দুটি বছরে সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল না। তবু দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। রাস্তাঘাট, অবকাঠামো পরিবর্তন হয়েছে। পিসি রোড, আরাকান রোডসহ সড়কপথের সংকট দূর হয়েছে।’ তবে মশক নিধন সম্ভব হয়নি স্বীকার করে জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি চসিকের ‘হাতে নেই’ বলে জানালেন মেয়র। বললেন, ‘সেবা ও উন্নয়নে যেসব প্রকল্প এর মধ্যে গৃহীত হয়েছে, আগামী তিন বছর তার বাস্তবায়ন হলে নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণ হবে।’ ফের নির্বাচনে লড়বেন কি না? এ প্রশ্নে মেয়র রেজাউল বললেন, ‘নির্বাচন এখনো তিন বছর বাকি। তত দিন বাঁচি কি না, এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।’