শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

মোটরসাইকেল যখন ভোগান্তির কারণ

শামীম আহমেদ

মোটরসাইকেল যখন ভোগান্তির কারণ

রাজধানীতে মোটরসাইকেল চলে বেপরোয়া -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সময় তখন সকাল সাড়ে ৯টা। রাজধানীর শাহজাদপুরের বাঁশতলা গলিতে গাড়ির চাপ। সরু গলিটি দিয়ে ধীরে পার হচ্ছিল বিভিন্ন যানবাহন। হঠাৎ একটি মোটরসাইকেল উল্টো দিকের লেন একটু ফাঁকা পেতেই টান দিয়ে সামনে চলে যায়। তার দেখাদেখি আরও চার-পাঁচটি মোটরসাইকেল এগিয়ে যায়। পরে যায় আরও কয়েকটি। ৫০ গজ সামনে গিয়েই বিপরীত থেকে আসা সিএনজি অটোরিকশার সামনে আটকা পড়ে মোটরসাইকেলগুলো। তখন আর পেছনে আসার সুযোগও নেই। মুহূর্তে থমকে যায় পুরো রাস্তার যান চলাচল। প্রভাব পড়ে আশপাশের সব সড়কে। আটকা পড়ে স্কুল শিক্ষার্থীদের বহনকারী বেশ কয়েকটি স্কুলভ্যানও। গত বুধবার সেই জট খুলতে লেগে যায় দেড় ঘণ্টার বেশি।

মোটরসাইকেল বা রাইড শেয়ার রাজধানীর গণপরিবহন সংকট থেকে নগরবাসীকে কিছুটা নিস্তার দিলেও বর্তমানে যেন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। সড়কে নিয়মকানুনের ধার ধারছেন না অনেক বাইকার। সামান্য ফাঁক পেলেই মোটরসাইকেলের মাথা ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছেন অলিগলি। আগে যাওয়ার জন্য উল্টোপথে গিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছেন আসা-যাওয়ার উভয় পথ। সেই যানজটে আটকা পড়ছেন নিজেও। যানজটের মধ্যেও হর্নের শব্দে ভারী করে ফেলছেন বাতাস। সুযোগ পেলেই বাইক তুলে দিচ্ছেন ফুটপাতে। বাইকারদের এমন স্বেচ্ছাচারিতায় ক্ষুব্ধ পথচারী, সড়কের পাশের দোকানদারসহ অন্য যানবাহনের চালকরা।

এদিকে যানজটের শহর ঢাকায় অলিগলি দিয়ে কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে মোটরসাইকেল বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে রাইড শেয়ারিং করে আয় করতে ঢাকার বাইরে থেকেও আসছেন অনেকে। ২০২২ সালে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন নিবন্ধন হয়েছে মোট ৫ লাখ ৭৮ হাজার ১৫১টি। এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১২টি, যা এযাবৎকালের রেকর্ড। আর শুধু ঢাকায় মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৮৪৮টি। এর আগে ঢাকায় সর্বোচ্চ মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছিল ২০১৮ সালে ১ লাখ ৪ হাজার ৫১টি। আর কোনো বছর মোটরসাইকেল নিবন্ধন লাখ ছাড়ায়নি। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় ২০ হাজার ৭৭১টি ও সারা দেশে ৮২ হাজার ৩২৬টি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত মোটরসাইকেল ও বাইকারদের নিয়ম না মানার প্রবণতা সড়কে ভোগান্তি বাড়াচ্ছে বলে মনে করছে বিভিন্ন মহল। এদিকে বাইকারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খোদ বাইকারদেরই। সাখাওয়াত হোসেন নামে এক বাইকার বলেন, যারা ঢাকার বাইরে থেকে এসে রাইড শেয়ারিং করছে, তারা মফস্বলে খুশিমতো মোটরসাইকেল চালিয়েছেন। নিয়ম মানতে হয়নি। ঢাকায় এসেও তারা একইভাবে চালাচ্ছেন। আবার অনেকে নিয়ম জানেন না, জানলেও মানেন না। আজব ব্যাপার হচ্ছে, হেলমেট না থাকলে পুলিশ জরিমানা করে। অথচ রাস্তায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে কিছু বলা হয় না। এদিকে পরিসংখ্যান বলছে, দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর জন্য দায়ী মোটরসাইকেল। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান ২ হাজার ২১৪ জন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ। গত মার্চে ৪৮৬টি দুর্ঘটনায় ৫৬৪ জন নিহত হয়েছেন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের পরিমাণ ৩৪.৩৯ শতাংশ। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চার চাকার বাহনের তুলনায় মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩০ গুণ বেশি। এ ছাড়া একটি বাসের বিকল্প হিসেবে সড়কে নামছে ১৫ থেকে ২০টি ছোট যানবাহন। এতে যানজট, দুর্ঘটনা, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ বাড়ছে। জ্বালানি বেশি পুড়ছে। বিশ্বে যারাই মানসম্মত গণপরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ছোট গাড়িকে নিরুৎসাহ করেছে, তারাই পরিবহন ব্যবস্থাপনায় সফল। আমরা উল্টোপথে হাঁটছি। ভালো গণপরিবহন না পাওয়ায় মানুষ বিকল্প খুঁজছে। ফলে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকারের মতো ছোট যানবাহনে সড়ক ভরে যাচ্ছে। এর সাইড এফেক্ট অনেক। ঢাকা বসবাসযোগ্যতা হারানোর পেছনে এর দায় আছে। তিনি বলেন, পরিকল্পিত নগরী গড়তে কোন যানবাহনকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার সেই পলিসিই আমাদের নেই। সময় চলে যাচ্ছে। মানুষ ছোট গাড়িতে বিনিয়োগ করে ফেলছে। পরবর্তীতে এ সমস্যা সমাধান করা দুষ্কর হয়ে পড়বে।

 

সর্বশেষ খবর