বুধবার, ৩১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা
রাজধানীর ফুটপাত

দিনে চাঁদাবাজি ১০ কোটি টাকা

হরেক রকম ব্যবসা, দোকানপ্রতি ওঠানো হয় ১০০ থেকে হাজার

হাসান ইমন

দিনে চাঁদাবাজি ১০ কোটি টাকা

রাজধানীর ব্যস্ত ফুটপাত -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর মেরাদিয়া এলাকায় প্রতি বুধবার হাট বসে। সেখানে ওই দিন আবাসিক এলাকার এভিনিউ রাস্তাসহ প্রায় সব রাস্তায়ই ২ হাজারের বেশি হকার বসেন। এসব হকার ছোট চৌকি ও নির্দিষ্ট ৪ থেকে ৬ ফুট জায়গায় বসেন। এসব চৌকি ও রিকশাভ্যানে কাপড়চোপড়, প্রসাধনী, জুতা, বিছানার চাদর, মশারি, খেলনা, ফলমূল, শরবত, খাবার, গৃহস্থালি জিনিসপত্রসহ নানা ধরনের পণ্য সাজিয়ে বসেন হকাররা। তবে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে চার হাত আয়তনের একেকটি চৌকি বা রিকশাভ্যান বসাতে তাদের অগ্রিম দিতে হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। আর পণ্যের ধরন অনুযায়ী দৈনিক একজন হকারকে দিতে হচ্ছে ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা। বুধবার ছাড়াও সড়কগুলোতে শাক-সবজি ও মাছ, মুরগি ও মাংসের দোকান বসে। ওই সব দোকান থেকে দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা ওঠান চাঁদাবাজরা।

কে বা কারা নেন এই টাকা, এমন প্রশ্নে মেরাদিয়া বাজারের ফুটপাতের কাপড় ব্যবসায়ী লতিফ মিয়া বলেন, হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন রিয়াজ, আসিফ, রুবেল, সজীব ও আলামীন। আর তাদের দলপতি হিসেবে আছেন খালেদ। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে লাইনম্যান ও তার সহযোগীরা মারধর করেন, মালামাল ফেলে দেন।

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের তথ্য বলছে, শুধু এই এলাকা নয়, গুলিস্তান, পল্টন, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, সূত্রাপুর, নিউমার্কেট, ফার্মগেট, মিরপুর, বিমানবন্দর, উত্তরাসহ রাজধানীর ৫০টি এলাকায় ফিরোজের মতো অন্তত ৩০ জন লাইনম্যান সরদারের নেতৃত্বে ফুটপাতে হকার বসানো হয়। এসব হকারের কাছ থেকে চাঁদা তোলার জন্য নিযুক্ত আছেন দেড় শতাধিক লাইনম্যান। চাঁদা তোলার জন্য প্রত্যেক লাইনম্যানের সঙ্গে পাঁচ-সাতজন করে সহযোগী থাকেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় একটি গোষ্ঠী ও একশ্রেণির পুলিশ সদস্য মিলে লাইনম্যান সরদার ও লাইনম্যান নিয়োগ দেন। কোনো কোনো এলাকায় ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকায় অন্তত তিন লাখ হকার রয়েছেন। এলাকাভেদে ও পণ্যের ধরন অনুযায়ী একজন হকারের কাছ থেকে দৈনিক ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয় বলে হকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির হিসাবে, আড়াই লাখ হকারের কাছ থেকে দৈনিক গড়ে ৪০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এ হিসাবে ফুটপাত থেকে প্রতিদিন চাঁদা ওঠে ১০ কোটি টাকা; মাসে ৩০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটি ও বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, অবৈধ হকার্স সংগঠন ও লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরা অসাধু পুলিশ সদস্যদের যোগসাজশে চাঁদা তোলেন। সিটি করপোরেশন মামলা করলেও তারা গ্রেফতার এড়িয়ে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান এম এ কাশেম।

নিয়ন্ত্রণে যারা : গুলিস্তান আহাদ পুলিশ বক্সের উত্তর পাশের ফুটপাতে হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন মো. হারুন ওরফে লম্বা হারুন ও তার শালা দেলু। গোলাপ শাহ মাজারের পূর্ব পাশের রাস্তা ও ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলেন লিপু ও শহীদ। তাদের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন ৪-৫ জন। এদের নেতৃত্বে রয়েছেন সুলতান। খদ্দর বাজারের তিন পাশে ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলার নেতৃত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ আলী। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন কাদেরসহ অন্তত পাঁচজন। রমনা ভবনের পশ্চিম পাশ ও ভাসানী স্টেডিয়ামের সামনের ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলেন আলী মিয়া। তার সহযোগী হিসেবে মিন্টুসহ আছেন ৫-৭ জন। রাজধানী হোটেল থেকে বেল্টের গলি পর্যন্ত ফুটপাতের টাকা তোলেন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কালা নবী, সেলিম, নাসির ও তার সহযোগীরা। গুলিস্তান সিনেমা হল বিল্ডিং থেকে পূর্ব পাশে ফুটপাত ও রাস্তা থেকে টাকা ওঠান বাবুল। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন কালা নাসির ও ইবরাহীমসহ আরও ৩-৪ জন।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের পাশের ফুটপাতে চাঁদা আদায় করেন সাইফুল মোল্লা ও আবুল হোসেন। তাদের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন চট্টগ্রামের হারুন ও জুয়েলসহ পাঁচজন। মতিঝিল শাপলা চত্বরের সোনালী ব্যাংক থেকে জীবন বীমা পর্যন্ত ফুটপাত থেকে টাকা ওঠান মকবুল ও আজাদ। বায়তুল মোকাররমের পশ্চিমে স্বর্ণ মার্কেটের সামনের ফুটপাতে চাঁদা তোলেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার আমানিয়ার ছেলে মো. হারুন। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন খোকন মজুমদারসহ আরও তিনজন। বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেট থেকে ক্রীড়া পরিষদ ভবন পর্যন্ত চাঁদা তোলেন রহিম, গোলাপ ও নুরু।

নিউমার্কেট, গাউছিয়া, বলাকা সিনেমা হল, বাকুশাহ মার্কেট ও ঢাকা কলেজের সামনে চাঁদা তোলেন ইবরাহিম ওরফে ইবু, সাত্তার মোল্লা, রফিক ও নুরুল ইসলামসহ তার সহযোগীরা। ফার্মগেট এলাকার টাকা তোলেন নজরুল, শাহ আলম, তাজু ও চুন্নুসহ সহযোগীরা। বিমানবন্দর থেকে টাকা তোলেন আকতার ও তার স্ত্রী, জামালসহ সহযোগীরা। মিরপুর শাহ আলী ও দারুস সালাম এলাকা থেকে চাঁদা তোলেন কবির, জুয়েল ও শফিকসহ সহযোগীরা। উত্তরা মডেল টাউনের ১ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় প্রায় দুই হাজার দোকান বসে মূল রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে। সোনারগাঁ জনপথ রোড, আবদুল্লাহপুর বেড়িবাঁধ রোড, রবীন্দ্র সরণি ও এর আশপাশের সড়কসহ ৩ নম্বর সেক্টরের জসিম উদ্দিন রোডে বসে শতাধিক দোকান। এসব দোকান থেকে টাকা তোলেন বাবু, রাছেল, আতিক, সাইফুল, উজ্জ্বলসহ আরও ৫-৭ জন। এদের নেতৃত্বে রয়েছেন সর্দার মোরসালিন ও রাসেল। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডিএসসিসি এলাকায় ফুটপাতের জায়গা চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। লাল চিহ্নিত এলাকায় হকার বসতে পারবে না। একমাত্র সবুজ চিহ্নিত এলাকায় হকার বসতে পারবে। ইতোমধ্যে গুলিস্তানে লাল চিহ্নিত এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচজন হকারকে বিভিন্ন মেয়াদে দন্ড দেওয়া হয়েছে। হকারদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

সর্বশেষ খবর