মৌসুমের শুরুতে কৃষকরা এক কেজি আলু বিক্রি করেছিলেন ১৪-১৫ টাকায়। গত জুন মাস থেকে আলু নিয়ে বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। অক্টোবর মাসে পাইকারিতে ৫৫ টাকায় বিক্রি হলেও খুচরা পর্যায়ে এক কেজি আলু কিনতে হয়েছে ৬০-৬৫ টাকায়। চার বছর ধরে এমন ধারাবাহিকতা চলে আসছে। মৌসুমের শুরুতে কৃষকের হাত থেকে বিক্রি হওয়া আলুর দাম এভাবেই বাড়তে থাকে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে কৃষকের ঘরে আলু আসে। ওই সময় স্থানীয় ফড়িয়া, আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে আলু বিক্রি করেন কৃষকরা। ব্যবসায়ীরা হিমাগারে আলু মজুত করেন। এরপর দুই-তিন মাস আলু বিক্রি বন্ধ থাকে। বাজারে জুলাই মাসে আলুর দাম বাড়তে শুরু করে। আর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আলুর দাম সর্বোচ্চে গিয়ে ঠেকে। কৃষিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর আলুর দাম নিয়ে মূলত কারসাজি হয় হিমাগার গেটে। ব্যাপক মজুত থাকার পরও বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আলুর মূল্যবৃদ্ধি করতে থাকেন হিমাগার মালিক, মজুতদার ও আড়তদাররা।
বুধবার জয়পুরহাটের খুচরা বাজারে কার্ডিনাল, গ্যানোলা, ডায়মন্ডসহ বিভিন্ন জাতের এক কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, আর দেশি পাকরি লাল জাতের এক কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। সেই আলু আবার হিমাগার গেটে পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৫৬ টাকায়, আর দেশি পাকরি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬২ টাকায়। সরকার বারবার আলুর দাম কমাতে বাজার মনিটরিংয়ের কথা বললেও এসবের কোনো প্রভাব পড়েনি। সংশ্লিষ্টরা জানান, কৃষকরা আলু উৎপাদন করলেও তারা ন্যায্যমূল্য পান না। তাদের কাছ থেকে তুলনামূলক কম দামে আলু কিনে মৌসুম শেষে আড়তদার, ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকরাই দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে তোলেন। যার প্রভাব বর্তমান বাজারে ভোগ করছেন ভোক্তারা। কৃষকরা যখন মাঠ থেকে আলু তোলা শুরু করেন, তখন উৎপাদনের ৬৫ শতাংশ আলু বিক্রি করে দেন। এর এক মাসের মাথায় তারা আরও ২৫ শতাংশ আলু বিক্রি করেন। বলতে গেলে কৃষকের ঘরে থাকা আলু জুন মাসের মধ্যেই বিক্রি করা শেষ হয়। উৎপাদন মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ীরা এসব আলু কিনে নেন। যেটুকু থাকে তা পরিবারের খাবারের জন্য এবং বীজ ব্যতীত আর কোনো আলু তাদের ঘরে থাকে না। কৃষক তাদের বীজ আলু সংরক্ষণ করে থাকেন হিমাগারে। সিংহভাগ আলু মজুত করেন ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। হিমাগার মালিকদের মধ্যেও কেউ কেউ এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। হিমাগার মালিক ও মজুতদাররা ধীরগতিতে জুন থেকে বিক্রি শুরু করেন। চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত। সময় যত ঘনিয়ে আসে মজুত কমার সঙ্গে দামও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে চোখের পলকে। মৌসুমের শুরুতে কৃষকের ঘরে যখন আলু থাকে তখন দাম বাড়তে দেখা যায় না। কৃষকরা এক মণ (৪০ কেজি) গ্যানোলা, কার্ডিনাল, ডায়মন্ড জাতের আলু ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা এবং দেশি পাকরি লাল ৬৬০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করেন। সেই আলু হিমাগার থেকে বিক্রি শুরু হওয়ার সঙ্গে সে বিদ্যুৎ গতিতে দাম বাড়তে থাকে। আর ক্রমেই বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।
এখানেই শেষ নয়, আলুর মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবেও তারা নানান কথা বলছেন, বর্তমানে কৃষকের হাতে আলু না থাকলে কী হবে, পর্যাপ্ত পরিমাণ আলু আছে হিমাগার মালিক ও মজুতদারদের হাতে। সংকট সৃষ্টি করে আড়তদার ও মজুতদাররা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারসাজি করা হচ্ছে। উৎপাদন ও মজুত অনুযায়ী আলুর সরবরাহে সংকট নেই। শুরুর তুলনায় এ সময়ে এসে কেজিতে দাম সর্বোচ্চ ৮-১০ টাকা বাড়তে পারে। কারণ হিমাগার খরচ বা ওজন কমে যায়। কিন্তু এখন এক কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকায়। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিছু হিমাগার মালিক, বড় ব্যবসায়ী ও আড়তদার বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছেন। যেটা আমরা আগেও দেখেছি। বাজার মনিটরিং থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেও কোনোভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার জয়পুরহাটে ৩৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের আলু রোপণ করা হয়েছিল। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫০ মেট্রিক টন। সেখানে উৎপাদন হয়েছে ৮ লাখ ২৩ হাজার ১৩ মেট্রিক টন। জেলায় ১৯টি হিমাগারে এবার আলু সংরক্ষণ হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন।
পুনট কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক বিপ্লব কুমার ঘোষ বলেন, এবার এই হিমাগারে ৬০ কেজি ওজনের ২ লাখ ৫০ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ হয়েছিল। বুধবার বিকাল পর্যন্ত ৭০ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ আছে। এর মধ্যে কিছু বীজ আলু। এখনো হিমাগারগুলোতে গড়ে সংরক্ষণের ২৩-২৫ শতাংশ আলু আছে। ব্যবসায়ীরা যতই ধীরগতিতে আলু বিক্রি করুক না কেন, আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সংরক্ষণকৃত আলু হিমাগার থেকে বের করতেই হবে। হিমাগার মালিকরা আলু সংরক্ষণ করেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক হিমাগার মালিকই এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে তারা অক্টোবরের মধ্যে সব আলু বিক্রি করে দিয়েছেন। বর্তমানে যে আলু হিমাগারে আছে তা ব্যবসায়ীদের। আর কিছু বীজ আলু রয়েছে কৃষকের।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে কৃষকরা এক কেজি আলুর সর্বোচ্চ মূল্য পেয়েছেন গড়ে ১৪-১৫ টাকা। আলু ক্রয় করেছেন ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকরা। কিছু আলু বীজের জন্য হিমাগারে সংরক্ষণ করেছেন কৃষকরা। বর্তমানে আলুর মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছেন। হাত বদলে লাগামহীন হয়ে উঠছে আলুর দাম। সরকারিভাবে আলু সংরক্ষণের দাবি জানান কৃষকরা। তাহলে বাজার অস্থিতিশীল হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সহজেই।
কালাই পৌর শহরের আঁওড়া মহল্লার কৃষক মোক্তাদির রহমান বলেন, ‘১০ একর জমিতে আলুর চাষ করেছিলাম। মৌসুমের শুরুতেই জমি থেকে প্রায় আলু তুলে ১৪-১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। ছয় মাসের ব্যবধানে এখন বাজারে দাম বেড়েছে এই আলু চার-পাঁচ গুণেরও বেশি। যদি কৃষকরা সরাসরি আলু মজুত করতে পারত তাহলে বাজার এভাবে অস্থিতিশীল হতো না। ব্যবসায়ীরা অধিক লাভ করতে বাজারে যেভাবে সংকট সৃষ্টি করে আলু ছাড়ে অন্তত কৃষকরা এই কাজ করত না। তারা সহজেই আলু ছেড়ে দিত।’
আলু ব্যবসায়ী রোমজান আলী বলেন, ‘অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটই দায়ী। হিমাগার গেটেই বেশি দামে আলু বিক্রি হচ্ছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় দাম বাড়াচ্ছে। গত মঙ্গলবার কার্ডিনাল ৬০ কেজির এক বস্তা আলুর পাইকারি দাম ছিল ৩ হাজার টাকা। আজ সেই আলু ৩ হাজার ৩৫০ টাকা বস্তা। কেজিপ্রতি বেড়েছে ৫ দশমিক ৮০ টাকা। এ অবস্থায় বাজারে নয়, হিমাগারে অভিযান চালিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিলে বাজার স্বাভাবিক হতে বাধ্য।’
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, ‘আলুর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন কথাই শুনতে পাচ্ছি। বাজার নিয়ন্ত্রণে কৃষি বিপণনসহ বিভিন্ন দপ্তর নিয়মিত তদারকি করছে। হিমাগারে এখনো যে পরিমাণ আলুর মজুত আছে তাতে সংকট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে যা আছে তা হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মূলত তারাই বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।’