বাংলাদেশ-ভারত স্থলবন্দরের কয়েকটিতে ভারতীয় উগ্রপন্থিদের নানা তৎপরতার কারণে আমদানি-রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হলেও বাকিগুলো স্বাভাবিক রয়েছে। গতকাল পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, সিলেটের তিনটি স্টেশন দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এতে তিনটি স্টেশনেই দেখা দিয়েছে ব্যবসায়িক অচলাবস্থা। বেনাপোলের ওপারে পেট্রাপোল বন্দর এলাকায় বিজেপি বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধের হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর সেখানে বাংলাদেশি নাগরিকদের উপস্থিতি কমেছে। হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আলু ছাড়া অন্যান্য পণ্য আমদানি হচ্ছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
সিলেট : ভারতীয়দের বাধায় সিলেট বিভাগের তিন শুল্কস্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। অপরদিকে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি বন্ধ রয়েছে। ফলে স্থবির হয়ে আছে এসব বন্দর ও শুল্কস্টেশন।
ভারতের আসাম রাজ্যের শ্রীভূমিতে (করিমগঞ্জ) ‘সনাতনী ঐক্য মঞ্চ’ নামের একটি সংগঠনের বিক্ষোভের মুখে গত রবিবার সিলেটের বিয়ানীবাজারের শেওলা স্থলবন্দর ও সোমবার জকিগঞ্জ শুল্কস্টেশন দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগে ভারতীয়দের বিক্ষোভের কারণে ৩০ নভেম্বর থেকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার চাতলাপুর শুল্কস্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে, শুল্কায়ন জটিলতায় তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে পাথর ও চুনাপাথর আমদানি বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা।
তামাবিল কয়লা, পাথর ও চুনাপাথর আমদানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস উদ্দিন লিপু বলেন, ‘ওজন জটিলতায় আমরা পাথর আমদানি বন্ধ রেখেছি। লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে পাথর আমদানি করতে গিয়ে আমাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। আমদানি বন্ধ থাকায় ওপারে ভারতে কয়লা-পাথরবাহী শত শত ট্রাক লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রপ্তানিকারকরা আমাদের কাছে পণ্যবাহী ট্রাকের ক্ষতিপূরণ দাবি করছে।
অন্যদিকে তামাবিল কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা তানভির হোসেন বলেন, আমাদের কার্যক্রম স্বাভাবিক আছে। ব্যবসায়ীরা পাথর আমদানি বন্ধ রাখায় এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
এদিকে জকিগঞ্জ শুল্কস্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফ উদ্দিন বলেন, এ স্টেশন দিয়ে মূলত কমলাসহ কিছু ফলমূল আমদানি হয়। গত সোমবার থেকে কোনো পণ্য আমদানি হয়নি।
বেনাপোল (যশোর) : গত চার দিন ভারত বাংলাদেশে কোনো পণ্য রপ্তানি করেনি। বেনাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, ভিসা বন্ধ থাকার কারণে পাসপোর্ট যাত্রীদের যাতায়াত অনেকটা কমে গেছে। দু-তিন মাস আগেও প্রতিদিন বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন পথে ৪-৫ হাজার যাত্রী যাতায়াত করত। এখন মেডিকেল ভিসাধারী যাত্রী বেশি যাতায়াত করছে। সব মিলে প্রতিদিন ১২-১৫ শ যাত্রী পারাপার হচ্ছে। যাত্রী কমে যাওয়ার কারণে ভ্রমণ কর খাতে সরকারের রাজস্ব বেশ কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে ব্যবসাবাণিজ্যে।
কুমিল্লা : ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশনে হামলার ঘটনায় বেড়েছে উত্তেজনা। এতে কুমিল্লার বিবির বাজার স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি ও যাত্রী পারাপার কমেছে। গতকাল বিবির বাজার স্থল বন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশনে হামলার পর বিবির বাজার স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়নি। তবে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি ও যাত্রী পারাপার আগের থেকে তুলনামূলক কমেছে। বিবির বাজার স্থলবন্দর শুল্কস্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা তারিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।’ তবে তিনি বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি।
চুয়াডাঙ্গা : চুয়াডাঙ্গার দর্শনা আন্তর্জাতিক রেলবন্দর দিয়ে ভারতীয় মালামাল আমদানি কমে গেছে। বর্তমানে স্বল্প পরিমাণে সিমেন্ট ও পোলট্রি ফিড তৈরির কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে। এ ছাড়া সব ধরনের আমদানি বন্ধ রয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব আদায় হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে বন্দরের শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অলস সময় পার করছেন সিএন্ডএফ এজেন্ট কর্মচারী এবং সারা দেশ থেকে আসা ট্রাকের চালক ও হেলপাররা। এদিকে, ভিসা জটিলতায় দর্শনা জয়নগর চেকপোস্ট দিয়েও কমেছে পাসপোর্টধারীদের যাতায়াত। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ মানুষও ভারতে যাতায়াত করছেন না।
দিনাজপুর : আলুবাহী ট্রাকের অনলাইন স্লট বুকিং বন্ধ করায় দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আলু রপ্তানি বন্ধ করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তবে এই স্থলবন্দর দিয়ে আলু বাদে পিঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। এ ছাড়া হিলি চেকপোস্ট দিয়ে দুই দেশের মধ্যে পাসপোর্টে যাতায়াতকারীদের চলাচলও স্বাভাবিক রয়েছে। হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন শিল্পী জানান, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলাদেশে আলু রপ্তানি না করার ক্ষেত্রে আলুবাহী ট্রাকের অনলাইন স্লট বুকিং বন্ধ রেখেছে। এ কারণে সোমবার থেকে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে দেশে আলু আমদানি হচ্ছে না। এতে আলু আমদানিকারকরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রতিদিনই আমদানিকারকদের ব্যাংক ঋণের সুদ গুনতে হচ্ছে।
লালমনিরহাট : বাংলাদেশ-ভারতের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্য লালমনিরহাটের বুড়িমারি স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। কমেছে যাত্রী পারাপার। দুই দেশের সীমান্তে চলছে কড়াকড়ি। এখন আমদানি-রপ্তানি চলছে, তা-ও কয়েক দিন আগের তুলনায় অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে বলে বন্দর সূত্রে জানা গেছে। গত সোমবার ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের লোকজনের বাধা ও পণ্য পরিবহন জটিলতায় লালমনিরহাটের বুড়িমারি স্থল ও শুল্কস্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম একেবারে স্থবির হয়ে পড়েছে। বুড়িমারি স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের ইনচার্জ ইমরান আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জেরে আমদানি-রপ্তানিতে অনেকটা ভাটা পড়েছে। যেখানে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ ট্রাক ভারত থেকে আসত। সেটি আর হচ্ছে না, বর্তমানে পণ্যবাহী গাড়ি আসছে মাত্র ১০০-১৫০টি। যাত্রী পারাপারেও ধস নেমেছে। ৫০ জনের বেশি যাত্রী গত এক সপ্তাহ থেকে পারাপার হচ্ছে না।
সাতক্ষীরা : প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে। ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে রাজস্ব আদায়। ১ ডিসেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত গত তিন দিনে ভারত থেকে এ বন্দর দিয়ে ৭৯৬ ট্রাক পণ্য আমদানি হয়েছে। সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রহিত ট্রেডাসের স্বত্বাধিকারী রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী জানান, আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা ও পতাকা অবমাননার ঘটনায় নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় বেনাপোল বন্দরসহ বিভিন্ন বন্দরের আমদানি-রপ্তানি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অনেক স্থানে আমদানি-রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু ভোমরা স্থলবন্দরের আওতামুক্ত থাকায় এখনো পর্যন্ত স্বাভাবিক রয়েছে বন্দরের সব কার্যক্রম।
ভোমরা স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা শফিউল বসর জানান, ভোমরা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে। সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী সংগঠন ভোমরা সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু মুসা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ইসুতে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বৈরী অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানি নিয়ে অনেকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে।
কক্সবাজার : মিয়ানমারে যুদ্ধ পরিস্থিতির পর থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে ধীর গতিতে চলছে আমদানি-রপ্তানি। কমে এসেছে রাজস্ব আয়। মাঝেমধ্যে ভারী গোলাবারুদের শব্দে কেঁপে ওঠে টেকনাফ সীমান্ত এলাকা। ব্যবসায়ীরা চাইলেও আগের মতো বন্দরে পণ্য পাঠাতে পারছেন না। যার ফলে কমে গেছে বন্দরের আমদানি-রপ্তানি। ব্যবসায়ীরা জানান, গেল চার দিনে মাত্র দুটি পণ্যবোঝাই কার্গো এসেছে। এতে রয়েছে শুঁটকি মাছ, বরই আচার, শুকনা বরই, টক তেঁতুলসহ নানা পণ্য। এ বিষয়ে স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেড টেকনাফের মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মেজর (অব.) সৈয়দ আনসার মোহাম্মদ কাউসার বলেন, মিয়ানমারে যুদ্ধ ও দেশের পট পরিবর্তনের পর আমদানি-রপ্তানি ধীর গতিতে চলছে।
ফেনী : সীমান্তে গত কয়েকদিনের উত্তেজনার পর বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। দুই পারের মানুষ যাতায়াত করছে নির্বিঘ্নে। সচল রয়েছে রপ্তানি কার্যক্রম।
পঞ্চগড় : বাংলাদেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। এই বন্দর দিয়ে ভারত থেকে পিঁয়াজ, চাল ছাড়াও নানা ধরনের পণ্য আমাদানি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, চলমান সংকটের প্রভাব এই বন্দরে এখনো পড়েনি। তবে ভারত থেকে পাথর আমদানি বন্ধ রয়েছে। পাথর আমাদানি বন্ধের কারণ হিসেবে তারা বলছেন পাথরের দাম সংক্রান্ত কিছু জটিলতা রয়েছে। তবে ভুটান থেকে নিয়মিত পাথর আমদানি হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী থানার সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে। গতকাল সকাল ১০টা থেকে প্রতিদিনের মতো ভারত থেকে বাংলাদেশে পাথরভর্তি ২১টি ট্রাক প্রবেশ করে। কয়েকদিন ধরে কোনো কয়লার ট্রাক প্রবেশ করেনি বলে জানা যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে আটটি ট্রাক গার্মেন্টস কাপড়, ঝুটসহ প্লাস্টিকসামগ্রী নিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এ ব্যাপারে সোনাহাট ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবুল হোসেন ব্যাপারী বলেন, ভারতের সঙ্গে ইসকন ইস্যুতে সোনাহাট স্থলবন্দরের কার্যক্রমে কোনো সমস্যা নেই। আমরা কোনো ক্ষতিকর প্রভাব দেখছি না। প্রতিদিনই পাথর, কয়লাসহ পণ্য আনা-নেওয়া হচ্ছে।