ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৫৫ কোটি টাকা। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এই সংসদ সচিবালয়কে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করতে সময় লাগবে অন্তত এক বছর। এর মধ্যে সংসদ সচিবালয়ের নিজস্ব খাতের ক্ষতি হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সংসদ সচিবালয়ের দায়িত্বে থাকা গৃহায়ন ও গণপূর্তের ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি।
৫ আগস্টের পর সংসদ সচিবালয় ও গণপূর্তের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির হিসেবে এ তথ্য উঠে এসেছে। ওই কমিটি সংসদ সচিবালয়ে কর্মরত সব উইংয়ের কাছে তাদের ক্ষতির বিবরণ নিয়েছে। সে অনুযায়ী ক্ষতির আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ১৫৫ কোটি টাকার মতো।
সংসদ সচিবালয়ের আর্থিক ক্ষতি প্রসঙ্গে সচিব ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে ১৫৫ কোটি টাকার পরিমাণ পেয়েছি। এর মধ্যে সংসদ সচিবালয়ের আইটি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন আমাদের যে বাজেট আছে তা দিয়ে অল্প কাজ শুরু করেছি। বিশেষ করে কিছু কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ঠিক করা হচ্ছে। বাকি কাজ করবে গণপূর্ত। তিনি বলেন, ১০০ কোটির বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণপূর্তের অধীনে থাকা ভবন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। ওইসব কাজ তারা করবে। এসব কাজ শেষ করতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে।
সম্প্রতি সরেজমিন সংসদ সচিবালয়ের ভিতরে গিয়ে এখনো ধ্বংসস্তূপের নিদর্শন দেখা গেছে। ৯ তলার বিভিন্ন করিডোরে স্তূপ করে রাখা আছে ভাঙচুর করা বিভিন্ন আসবাবপত্র ও কাচের টুকরো। দেয়ালে নানা বিকৃত ভাষায় লেখা রয়েছে স্লোগান। আঁকানো আছে বিভিন্ন ধরনের গ্রাফিতি। এরই মধ্যে সংসদ সচিবালয়ের উদ্যোগে পরিষ্কার-পরিছন্ন করা হয়েছে। তবে এসব গ্রাফিতি মোছার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে সংসদ সচিবালয়ের কয়েক কর্মকর্তা বলেন, প্রথম দিকে এসব মোছার উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে তা বন্ধ করা হয়। ছাত্র-জনতার স্মৃতি ধরে রাখতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সংসদ চালু হলে এসব গ্রাফিতি মুছে ফেলা হবে। তারা আরও বলেন, দেয়ালে কিছু অশ্লীল চিত্র ও স্লোগান রয়েছে। সেগুলো শিগগিরই মুছে ফেলা হবে। এদিকে সংসদ সচিবালয়ের আসবাবপত্র ও বিভিন্ন বিভাগের ফাইল অগোছালো থাকার কারণে বাইরের দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। একই কারণে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশেও। সংসদ সচিবালয়ের মূল গেটে সংসদের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস ছাড়াও সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তা দিচ্ছেন। এ ছাড়া সংসদ সচিবালয়ের ভিতরের কয়েকটি ফ্লোরে সেনা সদস্যদের নিরাপত্তা দিতে দেখা গেছে। আপাতত কিছু ফ্লোরে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ শেষ হলেও এখনো বেশির ভাগ ফ্লোর রয়েছে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সংসদ সচিব রুটিন করে সব ধরনের কাজের তদারকি করছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করতে সংসদ সচিবালয় থেকে সব উইংয়ে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব চেয়ে ৫ নভেম্বর চিঠি পাঠানো হয়। সহকারী মেইনটেইন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার প্রবীর কুমার সিকদার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আইট সামগ্রী-ডেস্কটপ কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হারানো গেছে। সংসদ সচিবালয়ে বিভিন্ন দপ্তরে ব্যবহৃত কিংবা অচল অবস্থায় পড়ে থাকা এসব আইটি সামগ্রীর তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন। চিঠিতে আরও বলা হয়, এ ছাড়া বিভিন্ন অনুবিভাগ/অধিশাখা/শাখায় অচল অবস্থায় পড়ে থাকা আইটি ডিভাইসসমূহ পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জরুরিভিত্তিতে আইটি অধিশাখায় বুঝিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জাতীয় সংসদ ভবন চত্বর ও ভবনের ভিতরে ঢুকে পড়ে হাজারো মানুষ। এ সময় তারা স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ, হুইপদের কক্ষসহ নয় তলা ভবনের প্রায় সব কক্ষ তছনছ করে। ওই এলাকায় অবস্থিত মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের কার্যালয়, কর্মকর্তাদের বাসভবনও ভাঙচুর করা হয়। এ সময় জনতা কম্পিউটার, আসবাবপত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ ও দামি জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। সংসদ ভবনের গেটে প্রথমে দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রবেশে বাধা দিলেও লোকসমাগম বাড়লে আর তাদের আটকানো যায়নি। সংসদ ভবন চত্বরের দক্ষিণ প্লাজা, খেজুরবাগান মাঠ, টানেলে ঢুকে পড়ে অসংখ্য মানুষ। এর পরই অনেকে সংসদের মূল ভবনে প্রবেশ করতে থাকে। এ সময় অধিবেশন কক্ষে গিয়ে তারা সংসদ নেতা, স্পিকার, সংসদ সদস্যদের চেয়ারে বসে উল্লাস প্রকাশ করেন, ছবি তোলেন। অধিবেশন কক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তুমুল আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন। সেই খবরে জনতা গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং সংসদ ভবনে ঢুকে উল্লাস প্রকাশ করে।