মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম বীরপ্রতীক বলেছেন, জুলাই যোদ্ধাদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোনো কোটা থাকছে না। গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। জুলাই যোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারকে সরকারিভাবে ফ্ল্যাট দেওয়া হবে বলে শোনা যাচ্ছে। একইভাবে তাদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা বরাদ্দ করা হবে এমন তথ্যও আসছে। এসব তথ্য সঠিক কি না জানতে চাইলে উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাদের পুনর্বাসনের কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। সে অনুসারে মন্ত্রণালয় যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করবে। এই কার্যক্রমের মধ্যে ফ্ল্যাট দেওয়া কিংবা চাকরিতে কোটা দেওয়া এসব বিষয় নেই। পুনর্বাসন কর্মসূচি আছে। পুনর্বাসন নানাভাবে হতে পারে। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী তিনি যেভাবে পুনর্বাসিত হতে চান সেভাবে করা হবে। আত্মকর্মসংস্থানের জন্য যদি হাস-মুরগি কিংবা পশু পালন, মৎস্য পালন যেভাবে তিনি জীবিকার সংস্থান করতে চাইবেন সে ধরনের সুবিধাদি সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে। সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য কোনো কোটা থাকবে না। তারা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাবেন। মুক্তিযোদ্ধারা এখন ভাতা পাচ্ছেন ২০ হাজার টাকা, জুলাই যোদ্ধারাও পাচ্ছেন ২০ হাজার টাকা। দুটি সমান হয়ে গেল কি না আর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানো হবে কি না সাংবাদিকরা জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গটা এখানে না আসাই উচিত। মুক্তিযোদ্ধারা মহান। তাদের অবদান অনস্বীকার্য। এটা সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য। এখানে এই প্রসঙ্গ নিয়ে আসা উচিত না। জুলাই যোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সমকক্ষ করা হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ওইভাবে (সমকক্ষ) কেউ দেখছে না। আমরাও দেখছি না। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা পেতে ৩০-৩৫ বছর লেগেছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভাতাই পাননি, তালিকাই হয়নি। অথচ ২০০৫ সালেই শহীদের তালিকা হয়েছে। এগুলো সব রেকর্ডেড। তাহলে এত বছর ধরে হলো না কেন? আমি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গ এখানে আনতে চাচ্ছি না। সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা জুলাইয়ের শহীদ ও আহতদের বিষয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরেন।
উপদেষ্টা জানান, স্বৈরশাসন এবং সব ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার এক রক্তক্ষয়ী গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় এবং ৮ আগস্ট বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান সরকারিভাবে জুলাই গণ অভ্যুত্থান নামে অভিহিত হয়। ১২ ডিসেম্বর জুলাই গণ অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের কল্যাণ এবং যাবতীয় বিষয়াদির প্রশাসনিক দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত করা হয়। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা চূড়ান্তকরণ, আহতদের চিকিৎসা ব্যয় এবং তাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তাসহ পুনর্বাসন করার উদ্দেশ্যে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য ২৮ এপ্রিল ‘জুলাই গণ অভ্যুত্থান অধিদপ্তর’ গঠন করা হয়। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে নিহতদের জুলাই শহীদ এবং আহতদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে সরকার ‘জুলাই গণ অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছে।
উপদেষ্টা বলেন, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তালিকা অনুযায়ী ১৫ জানুয়ারি ৮৩৪ জন এবং ৩০ জুন আরও ১০ জন সর্বমোট ৮৪৪ জন শহীদের তালিকা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গেজেট আকারে প্রকাশ করে। আহত হওয়ার ধরন অনুসারে জুলাই যোদ্ধাদের তিনটি শ্রেণিভুক্ত করে ২৭ ফেব্রুয়ারি ৪৯৩ জন জুলাই যোদ্ধাকে ‘ক’ শ্রেণিতে, ৯০৮ জনকে ‘খ’ শ্রেণিতে এবং ৪ এবং ৫ মার্চ ১ হাজার ৬৪২ জনকে ‘গ’ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। সম্প্রতি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে ‘ক’ শ্রেণির ১১৪ জন, ‘খ’ শ্রেণির ২১৩ জন এবং ‘গ’ শ্রেণির ১৪৪২ জন সর্বমোট ১৭৬৯ জনের তালিকা পাওয়া গেছে, যা যাচাইবাছাই শেষে শিগগিরই গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। উপদেষ্টা বলেন, বিধিমালা অনুযায়ী, সরকার প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে সঞ্চয়পত্রের আকারে এককালীন ৩০ লাখ টাকা অনুদান দেবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭৭২টি শহীদ পরিবারের প্রত্যেক পরিবারকে (স্বামী বা স্ত্রী, ঔরসজাত বা গর্ভজাত সন্তান/মাতা ও পিতা) উত্তরাধিকার আইন অনুসারে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র মোট ৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৭২ শহীদ পরিবারের মধ্যে পারিবারিক ও ওয়ারিশগত জটিলতা নিরসন করে সঞ্চয়পত্র প্রদানের প্রক্রিয়া চলমান। শহীদ পরিবারের এককালীন অনুদানের অবশিষ্ট ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই মাস থেকে দেওয়া হবে। ‘ক’ শ্রেণির জুলাই যোদ্ধাগণ এককালীন নগদ ৫ লাখ টাকা অনুদান পাবেন, যার ২ লাখ টাকা করে সর্বমোট ৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। ‘খ’ শ্রেণির জুলাই যোদ্ধাগণ এককালীন নগদ ৩ লাখ টাকা করে অনুদান পাবেন, যার ১ লাখ টাকা করে মোট ৯ কোটি ৮ লাখ টাকা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। ‘গ’ শ্রেণির জুলাই যোদ্ধাগণ এককালীন নগদ ১ লাখ টাকা করে অনুদান পাবেন, যার পুরো অর্থ মোট ১০৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত এককালীন অনুদান হিসেবে সরকার মোট ২০২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা প্রদান করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুসারে ৫ আগস্ট থেকে অদ্যাবধি ৭৫ জন জুলাই যোদ্ধাকে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, তুরস্ক এবং রাশিয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে ৪৬ জন বিদেশে চিকিৎসাধীন এবং আরও ৩২ জন চিকিৎসার জন্য অপেক্ষমাণ। বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকার এ পর্যন্ত ৭৮ কোটি ৫২ লাখ ৯৫ হাজার ৮৮২ টাকা ব্যয় করেছে বলেন উপদেষ্টা।