আলজাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘দ্য মিনিস্টারস মিলিয়নস’-এ মূলত যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের অবৈধ সম্পদের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিন আওয়ামী লীগের এ শীর্ষ অর্থ পাচারকারীর অর্থ পাচারের ব্যাপারে অনুসন্ধান করে দেখেছে, তাঁর অর্থ পাচারের সূচনা হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে তিনি যে অর্থ পাচার করেছেন সে টাকা গেছে সিঙ্গাপুর থেকে। আবার সিঙ্গাপুরে তিনি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু করেছেন দুবাইয়ের মাধ্যমে। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর অর্থ পাচার শুরু হয় ২০০৯ সালে। প্রথমে তিনি বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে দুবাইতে নিয়ে সেখানে কোম্পানি করেন। সেখান থেকে ওই সব কোম্পানির মাধ্যমে বৈধভাবে টাকা সরান সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুরে ব্যাংকের ঋণে সম্পদ কেনেন লন্ডনে। নতুন করে ফাঁস হওয়া সম্পত্তির তথ্যে দেখা যায়, সাইফুজ্জামান ইউএইতে ২৫০টির বেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের তালিকাভুক্ত মালিক। এ সম্পত্তির মূল্য ১৪ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। রেকর্ডগুলোতে উঠে আসে যে তাঁর স্ত্রী রুখমিলা জামান দুবাইতে ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের আরও ৫০টি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত মালিক। সাইফুজ্জামান দুবাইয়ের অভিজাত অপেরা এলাকায় একটি পেন্টহাউসের মালিক। জমির রেকর্ড যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তিনি সেখানে একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের তালিকাভুক্ত মালিক, এর মূল্য ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি।
সাবেক এই মন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রী ইউএইতে দুই শর বেশি উচ্চমূল্যের অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে প্রায় ১৭ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছেন। আর সামগ্রিকভাবে ওই দম্পতি বিশ্বজুড়ে ছয় শর বেশি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত মালিক। তাঁদের বিরুদ্ধেই বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তদন্ত চলছে। সাইফুজ্জামান দুবাইয়ে ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ৫৪টি সম্পদের মালিক হন। যুক্তরাষ্ট্রেও তাঁর সম্পত্তি আছে। সেখানে তিনি নয়টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। এর মধ্যে পাঁচটি ম্যানহাটানসহ নিউইয়র্কের প্রধান এলাকায় এবং চারটি নদীর ওপারে নিউ জার্সিতে।
২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে ডিবিএস সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কোম্পানিগুলোকে ২০টি ঋণ দিয়েছিল, যা তার সাম্রাজ্যকে অর্থায়নে সহায়তা করেছিল। এ ঋণ পেতে এবং সাইফুজ্জামানের অবৈধ অর্থ বৈধ করতে কাজ করে। ‘ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন’-এর তৎকালীন সিইও পুরো পাচারপ্রক্রিয়াকে বৈধতা দেন এবং পাচারকৃত অর্থ নতুন করে বৈধভাবে বিনিয়োগের পথ উন্মুক্ত করেন। এরপর তিনি যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে একাধিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
সাইফুজ্জামান সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০০৯ সালে অর্থ পাচার শুরু করেন বলে জানা যায়। দেশটিতে প্রথম ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবসা করার জন্য ‘র্যাপিড র্যাপ্টর এফজিই’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন তিনি। পরের বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি ভবন নির্মাণ ও নির্মাণসামগ্রী বিক্রির জন্য ‘জেবা ট্রেডিং এফজিই’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। এ ছাড়া গত বছরের শেষ দিকে তাঁর স্ত্রী রুখমিলা জামান চৌধুরীর নামে আল-বারশা সাউথ-থার্ড এলাকায় কিউ গার্ডেনস বুটিক রেসিডেনস-ব্লক বিতে দুটি ফ্ল্যাট কেনা হয়। এর মধ্যে ১৫ সেপ্টেম্বর ১১ লাখ ২৫ হাজার ৩০০ দিরহামে একটি এবং ৩০ নভেম্বর ১১ লাখ ২৫ হাজার ৬৯ দিরহামে অন্য ফ্ল্যাটটি কেনা হয়।
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে দুবাই ইসলামী ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এ ছাড়া দেশটির ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংকে একটি দিরহাম ও একটি ডলার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আর দেশটিতে কার্যরত জনতা ব্যাংকে রয়েছে একটি দিরহাম অ্যাকাউন্ট। সব মিলিয়ে এসব অ্যাকাউন্টে ৩৯ হাজার ৫৮৩ দিরহাম এবং ৬ হাজার ৬৭০ ডলার জমা আছে। লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আটটি কোম্পানি রয়েছে, যার বাজারমূল্য ২০ কোটি ৩১ লাখ পাউন্ড। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। দেশটিতে তাঁর স্ত্রী রুখমিলা জামান ও মেয়ে জেবা জামানের নামেও কোম্পানি রয়েছে। এ ছাড়া পারিবারিক মালিকানায় থাকা ব্যবসায়িক গ্রুপ আরামিটের নামে একটি কোম্পানি রয়েছে বলে জানা যায়।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সাইফুজ্জামান চৌধুরী লন্ডনে নিউ ভেঞ্চার (লন্ডন) লিমিটেড নামে প্রথম একটি কোম্পানি খোলেন ২০১০ সালের ১৩ জুলাই। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২২ জুলাই সাদাকাত প্রপার্টিজ লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এসব কোম্পানি আবাসন খাতের। সব কোম্পানির অবস্থান দেশটির ৮ ডেভোনশায়ার স্কয়ার, লন্ডনের ঠিকানায়। ২০১০ সালে খোলা তাঁর নিউ ভেঞ্চার (লন্ডন) লিমিটেডের মূল ব্যবসা বাড়িঘর কেনাবেচা। এ কোম্পানির স্থায়ী ও চলতি সম্পদের মূল্য ১ কোটি ১৭ লাখ পাউন্ড। তিনি জেডটিএস প্রপার্টিজ নামে কোম্পানি খোলেন ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। এর স্থায়ী ও চলতি সম্পদ রয়েছে ৭ কোটি ৩১ লাখ পাউন্ডের। ২০১৯ সালের ৬ জুলাই স্ত্রী রুখমিলা জামানের নামে কোম্পানি ‘রুখমিলা প্রপার্টিজ’ খোলেন তিনি। এ কোম্পানির স্থায়ী ও চলতি সম্পদ ২ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ডের। আরামিট প্রপার্টিজ নামে চতুর্থ কোম্পানি খোলা হয় ২০২০ সালের ৬ মে। এ কোম্পানির সম্পদ রয়েছে ২ কোটি ১৫ লাখ পাউন্ডের। জেডটিজেড প্রপার্টিজ খোলা হয় ২০২০ সালের ৩০ জুলাই। এ কোম্পানির সম্পদ ২ কোটি ৯৯ লাখ পাউন্ডের। তাঁর মেয়ে জেবা জামানের নামে ‘জেবা প্রপার্টিজ’ খোলা হয় ২০২১ সালের ২১ জুন। এ কোম্পানির সম্পদ ১ কোটি ২৯ লাখ পাউন্ডের। ‘জারিয়া প্রপার্টিজ’ নামে আরেক কোম্পানির সম্পদ ৬০ লাখ পাউন্ডের। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২২ জুলাই খোলা ‘সাদাকাত প্রপার্টিজ লিমিটেড’-এর সম্পদমূল্য প্রায় ২ কোটি পাউন্ড। আওয়ামী লীগের পতনের পর সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির প্রাথমিক অনুসন্ধানে ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ৪৮ লাখ ডলার (প্রায় ৫ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা) ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৬২০টি বাড়ি কেনেন বলে জানা গেছে। এ সম্পদের ব্যাপারে এখন তদন্ত করছে সিআইডি।
সিআইডির তদন্তে দেখা গেছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ‘নাহার ম্যানেজমেন্ট ইনকরপোরেটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। একই বছর তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের নামে যুক্তরাষ্ট্রে নয়টি ফ্ল্যাট কেনেন। ২০০৯ সালে কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবসা করার জন্য আমিরাতের দুবাইয়ে ‘র্যাপিড র্যাপ্টর এফজিই’ ও ‘জেবা ট্রেডিং এফজিই’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। এ ছাড়া রুখমিলা জামান চৌধুরীর নামে আল-বারশা সাউথ-থার্ড এলাকায় কিউ গার্ডেনস ও বুটিক রেসিডেনসে দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন; যার দাম ২২ লাখ ৫০ হাজার ৩০০ দিরহাম (প্রায় ৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা)।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আরব আমিরাতে ৬২০টি বাড়ি কেনেন বলে সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে; যার বাজারমূল্য প্রায় ৪৮ কোটি ডলার (প্রায় ৫ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা)। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নিজের ও স্ত্রী রুখমিলা জামানের নামে যুক্তরাজ্য ও দুবাইয়ে আটটি প্রতিষ্ঠান খোলেন; যার স্থায়ী ও চলতি সম্পদের মূল্য ২১ কোটি ৭২ লাখ ৬০ হাজার ডলার (প্রায় ২ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা)।
তদন্তে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ দিয়ে সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসব কোম্পানি খুলে বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত যে ২১ প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে, সে তালিকায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী বা তাঁর পরিবারের কারও নাম নেই। ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী যে সম্পদ বিবরণী জমা দেন, সেখানে তাঁর বিদেশে থাকা সম্পদের কোনো তথ্য নেই। অর্থ পাচার ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুসারে এটি অপরাধ। তাই সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট।