শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিবের পদত্যাগের দাবিতে গতকাল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়। লাঠিচার্জ করে পুলিশ। সংঘর্ষে অন্তত ৭০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নেন। এদিকে উত্তরায় মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে দুই উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবকে ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার করে নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বিক্ষোভ হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও।
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সোমবার বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় গতকাল এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের দাবি ওঠে। পরীক্ষা স্থগিতের সেই ঘোষণা আসে সোমবার রাত ৩টার দিকে। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে সেই খবর না পৌঁছানোয় কেন্দ্রে গিয়ে ফিরে আসতে হয়। এরপর শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার এবং শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জুবায়েরকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। বেলা আড়াইটার দিকে সচিবালয়ের প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। কয়েক ঘণ্টা সচিবালয় অবরুদ্ধ করে রাখে তারা। বিকাল পৌনে ৪টায় সচিবালয়ের ১ নম্বর গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এরপর ভিতরে থাকা গাড়ি ভাঙচুর করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ, কাঁদানি গ্যাস ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ঢিল ছোড়েন। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা মিলে শিক্ষার্থীদের সচিবালয় থেকে বের করে দিতে সক্ষম হন। এরপর শিক্ষার্থীরা জিরো পয়েন্টের দিকে অবস্থান নেন। জিরো পয়েন্টের দিকে পুলিশ কয়েক দফা সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। গুলিস্তান ও জিরো পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে অনন্ত ৭০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। আন্দোলনে আসা একাধিক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাইলস্টোন কলেজে লাশের মিছিল দেখেও এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করতে রাত তিনটা বেজেছে। এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন উপদেষ্টা সচিব দরকার নেই। তাদের পদত্যাগ চান তারা। শিক্ষার্থীরা বলেন, অনেকেই এইচএসসি পরীক্ষা দিতে সকালে বের হয়ে শুনেছেন পরীক্ষা স্থগিত। অথচ এমন ইস্যুতে সিদ্ধান্তটা বিকালেই জানাতে পারত। মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং সঠিক তথ্য প্রকাশেরও দাবি জানান অনেক শিক্ষার্থী। আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের ফটকে এসেছে। যারা এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের খাতা পুনর্মূল্যায়নের দাবিতে সচিবালয়ের সামনে এসে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

দিনভর মাইলস্টোনে বিক্ষোভ, ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ দুই উপদেষ্টা-প্রেস সচিব : মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের স্থান পরিদর্শনে গিয়ে গতকাল ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। সকাল সাড়ে ১০টায় গিয়ে তারা অবরুদ্ধ হন এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া প্রহরায় বের হতে সক্ষম হন। গতকাল সকাল থেকেই মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করতে থাকেন সহস্রাধিক ছাত্রছাত্রী। মাইলস্টোন ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা এতে অংশ নেন। এরই মধ্যে সকাল সাড়ে ১০টায় মাইলস্টোনের ক্যাম্পাসে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার। তাদের সঙ্গে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বিমান বিধ্বস্ত হওয়া ভবন দেখতে গেলে তাকে ঘিরে ধরেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীদের ‘ভুয়া’ ‘ভুয়া’ স্লোগান দিতে শোনা যায়। পরে আসিফ নজরুলসহ অন্যরা কলেজের ৫ নম্বর ভবনের নিচতলায় কনফারেন্স কক্ষে যান। মাইলস্টোনের শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে ৫ নম্বর ভবনের সামনে মাঠে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বিক্ষোভ করছিলেন। বেলা ১টার দিকে শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি সরকার মেনে নেবে বলে আশ্বাস দেন আসিফ নজরুল। কিন্তু শিক্ষার্থীরা জানায় সোমবার রাতে তাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর ‘গায়ে হাত তুলেছে’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কলেজ ক্যাম্পাসে এসে ক্ষমা চাইতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ছয় দফা মেনে নেওয়ার দৃশ্যমান পদক্ষেপ চান তারা। বিক্ষোভ কালে ছাত্ররা উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দেন। উপদেষ্টারা বের হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন খবর পেয়ে বিক্ষুব্ধদের একটি অংশ ৫ নম্বর একাডেমিক ভবনের প্রধান ফটকে ইটপাটকেল মেরে ভবনের বেশ কয়েকটি গ্লাস ভাঙচুর করেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা অভিযোগ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের লাশ গোপন করার চেষ্টা করছে। তারা নিহতদের তালিকা চান সরকারের কাছে।
এরপর উপদেষ্টারা দীর্ঘ সময় ৫ নম্বর একাডেমিক ভবনে অবস্থান করেন। দুপুর ২টার পর থেকে কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অনুরোধে বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাস ছাড়তে শুরু করেন। আড়াইটার মধ্যে তারা মাইলস্টোন ক্যাম্পাস ছাড়লেও অবস্থান নেন কলেজ গেটের সামনের মোড়ে। এরই মধ্যে কলেজে অবস্থান নেয় ৫ শতাধিক পুলিশ সদস্য, এপিবিএন, এন্টি টেরোরিজম ইউনিট ও র্যাব সদস্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কড়া প্রহরায় বিকাল ৩টার পর উপদেষ্টারা গাড়িতে উঠে মাইলস্টোন ক্যাম্পাস ত্যাগ করার চেষ্টা করেন। উপদেষ্টাদের বহনকারী গাড়ি মেইন গেট পার হয়ে গেলেও সেখানে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের গতিরোধ করেন। একপর্যায়ে বিকাল সাড়ে ৩টার পর এসব গাড়ি ফের কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। উপদেষ্টারা অবস্থান নেন কলেজের একাডেমিক ভবনে। কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। কলেজের বাইরে মোড়ে থেমে থেমে স্লোগান দিচ্ছিল বিক্ষুব্ধরাও। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া প্রহরায় বের হতে সক্ষম হন দুই উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব।
শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবির মধ্যে রয়েছে নিহতদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ, আহতদের নির্ভুল তালিকা, শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা, ক্ষতিপূরণ প্রদান, ঝুঁকিপূর্ণ প্লেন বাতিল, প্রশিক্ষণ পদ্ধতি সংস্কার।
শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার : গতকাল শিক্ষার্র্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিকালে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা ও জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব মাহফুজ আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক বার্তায় এ তথ্য জানিয়েছেন। এ তথ্য জানানোর কিছুক্ষণ পরই পৃথক এক স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির পূর্ণাঙ্গ তদন্তে শিগগির কমিটি গঠিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবিকে সমন্বয় করে তদন্ত কমিটি গঠিত হবে। এরই মধ্যে শিক্ষা সচিবকে অপসারণ করা হয়েছে। ন্যায্য যে কোনো দাবি মানতে সরকার দায়বদ্ধ।
ঢাকার বাইরেও বিক্ষোভ : শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে রাজধানী ঢাকার বাইরেও বিক্ষোভ হয়েছে। চট্টগ্রাম, সিলেট, ফেনী, কুমিল্লা, রাজবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেছেন শিক্ষার্থীরা।