সাইফুজ্জামান চৌধুরী ওরফে জাভেদ অর্থ পাচারের সব অভিনব পন্থার আবিষ্কারক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি দুর্নীতি এবং অর্থ আত্মসাৎ করেছেন অভিনব পন্থায়, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে। ব্যাংক, শেয়ার মার্কেট থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, নানান দুর্নীতিতে তাঁর বাহক ছিলেন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। যারা পর্দার আড়ালে থেকে লুটপাট করতেন এবং লুটের অর্থের সিংহভাগ সাইফুজ্জামান চৌধুরীর জন্য বিদেশে পাচার করতেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন জাভেদের অর্থ পাচারের সহযোগীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশে অর্থ পাচারে সহায়তার অভিযোগে তিনজনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন এ আদেশ দেন। সাবেক ভূমিমন্ত্রীর পূর্বপরিচিত যে তিনজনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তাঁরা হলেন উৎপল পাল, আবদুল আজিজ ও সৈয়দ কামরুজ্জামান। দুদকের পক্ষ থেকে আদালতকে লিখিতভাবে বলা হয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ তুলে তা উৎপল পাল, আবদুল আজিজ ও সৈয়দ কামরুজ্জামানের সহায়তায় বিদেশে পাচার করেছেন। এ তিনজন বিদেশে পালিয়ে যেতে পারেন বলে দুদক জানতে পেরেছে। শুনানি নিয়ে আদালত এ তিনজনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন। এর আগে ৯ মার্চ সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের নামে থাকা ২৩টি কোম্পানির ১০২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা মূল্যের শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে ৯৫৭ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দেওয়া হয়। এর আগে ৫ মার্চ সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ৩৯টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন আদালত। দুদকের পক্ষ থেকে আদালতে বলা হয়, সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ অনুসন্ধানে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর অর্থ পাচারের সবচেয়ে বড় এজেন্ট ছিলেন তাঁর এক নিকটাত্মীয়। তিনি হলেন ডা. জুনায়েদ শফিক।
স্বৈরশাসকের দোসর হিসেবে তাঁর পরিচিতি এবং বিত্তবৈভবের বিস্তৃতি ঘটে গত এক দশকে। চিকিৎসক পেশা ছাপিয়ে বনে যান আর্থিক খাতের মাফিয়াদের একজন। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের এই ‘কাজিন’ হলেন জাভেদের অর্থ পাচারের প্রধান সহযোগী, যিনি সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে সহায়তা করতে করতে নিজেই একজন মাফিয়া হয়ে উঠেছিলেন। নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের নামে ব্যাংক ও পুঁজিবাজার থেকে তিনি তুলে নিয়েছেন ৫০০ কোটি টাকার বেশি। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে আবাসন খাতে তাঁর বিপুল বিনিয়োগের তথ্য রয়েছে। ডা. জুনায়েদ শফিক দেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক, পেইন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) পেইন মেডিসিন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা ডা. শফিক জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালেরও অন্যতম কর্ণধার। কিন্তু এখন তাঁর চিকিৎসক পরিচয় খুঁজে পাওয়া দায়। সেবকের পরিচয় ছাপিয়ে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য খাতে পরিচিত মুখ তিনি। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর অর্থ পাচারে অন্যতম ভূমিকা ছিল এই চিকিৎসকের। জানা যায়, পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি উদ্যোক্তা ও ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে তিনি দেশের আর্থিক খাতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। অভিযোগ আছে, এসব অর্থ তিনি প্রতিষ্ঠানের কাজে না লাগিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন, যা দিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী। নথিপত্রে দেখা যায়, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি। তাঁর স্ত্রী ইমরানা জামান চৌধুরী পরিচালক। নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. জুনায়েদ শফিক। স্ত্রী মাসুমা পারভীন পরিচালক। প্রয়াত শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের উত্তরসূরিদের হটিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে এখন একক আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে ডা. শফিক-রনি-আদনান সিন্ডিকেট। আর জহুরুল ইসলামের ছেলে মনজুরুল ইসলাম এখন একজন শেয়ারহোল্ডার মাত্র।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের ২০২০ সালের জুন শেষে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৫ কোটি টাকা। ডা. জুনায়েদ শফিক পর্ষদে যোগ দেওয়ার পর থেকেই কোম্পানিটির ঋণ বাড়তে থাকে। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আগে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ শেষে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯২ কোটি টাকায়। চলতি বছরের মার্চ শেষে কোম্পানিটির ঋণ ৪৭৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আইপিওতে আসার আগে ২০২০ সালের জুন শেষে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র ৮ লাখ ১ হাজার ৫০০ টাকা। তবে এক বছর পরই তা বেড়ে ৮০ কোটি ২৩ লাখ ১ হাজার ৫০০ টাকায় দাঁড়ায়। প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলত আইপিওর আগে কোম্পানিটির মূলধন ৮০ কোটি টাকার বেশি বাড়ানো হয়েছে। উদ্যোক্তা পরিচালকসহ ২৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় এ মূলধন। এর মধ্যে এনএমআই হোল্ডিংস লিমিটেডের অনুকূলে ৫৬ লাখ ১৬ হাজার ১১০, স্ট্যাটাস হোল্ডিংস লিমিটেডের অনুকূলে ৮৭ লাখ ১৪ হাজার ৯৫৩ ও মন্টেনিয়া হোল্ডিংস লিমিটেডের অনুকূলে ৫৫ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯টি শেয়ার ইস্যু করা হয়েছে। এর মধ্যে এনএমআই হোল্ডিংসের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে সেন্ট পিটার রোড, গার্নসে এবং স্ট্যাটাস হোল্ডিংস ও মন্টেনিয়া হোল্ডিংসের ঠিকানা সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই দেওয়া হয়েছে। একই ঠিকানা ব্যবহার করে দুবাইয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী। স্ট্যাটাস হোল্ডিংস নামে যুক্তরাজ্যেও কোম্পানি রয়েছে। ব্রিটিশ নাগরিকদের দিয়ে বেনামে এ কোম্পানির নামে অর্থ পাচার করে সেখানে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। আর এনএমআই হোল্ডিংসের ক্ষেত্রে গার্নসের যে ঠিকানা দেওয়া, সেটি অফশোর লিকসে থাকা বিভিন্ন কোম্পানির নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে। মূলত কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য এসব দেশে কোম্পানির নিবন্ধন করা হয়। আরও জানা যায়, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ার ধারণ কাঠামোয় দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশিদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ দেখানো হচ্ছে ২৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আগস্ট শেষেও এর পরিমাণ অপরিবর্তিত রয়েছে। আইপিওর আগে প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু করা এ তিন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা শেয়ারই মূলত বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আইপিওর পর এ তিন কোম্পানির কাছে থাকা শেয়ারের পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। এ ছাড়া বুক বিল্ডিং পদ্ধতির আইপিওর মাধ্যমে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস পুঁজিবাজার থেকে ২০২২ সালে ৭৫ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ২১ কোটি ১৮ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। এ বছরের মার্চে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য কোম্পানিটিকে ১৫০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সব মিলিয়ে গত চার বছরে পুঁজিবাজার ও ব্যাংক থেকে ৫৫০ কোটি টাকা নিয়েছে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে ২০২৩ সালে দেশের শীর্ষ ওষুধ বিক্রেতা ২০ কোম্পানির তালিকায় নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের নাম নেই। চিকিৎসকরা কোম্পানিটির চর্মরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ তুলনামূলক বেশি লেখেন। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগে কোম্পানিটির বিক্রয় প্রতিনিধিরা তাঁদের গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের বিষয়টিই চিকিৎসকদের কাছে প্রচার করেন। কোম্পানিটি পশু ও পোলট্রির চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধও উৎপাদন করে। তবে এ ক্ষেত্রেও শীর্ষ কোম্পানিগুলোর তালিকায় নেই নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস। জুনায়েদ শফিক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। তিনি বর্তমানে মেঘনা ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিরও ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ডেল্টা লাইফের পর্ষদে আসেন। জেনেক্স ইনফোসিসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমাম, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামসহ পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গেই সখ্য গড়ে তোলেন তিনি। মূলত বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যানের সঙ্গে সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে নিজের কোম্পানিকে আইপিওতে অনুমোদনের পাশাপাশি এ বছর বন্ড ইস্যুর অনুমোদন নিয়েছেন। অভিযোগ আছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কাজিন হিসেবে বিগত সময়ে বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা নিয়েছেন জুনায়েদ। বিশেষ করে আইপিও ও বন্ডের অনুমোদন, ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব কাজে লাগিয়েছেন। ব্যাংক ঋণের অর্থ কোম্পানির স্বার্থে ব্যবহার হয়েছে নাকি তিনি ও তাঁর সহযোগীরা ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করেছেন, সে বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছিল নীরব। তাঁর কাছে অনেক নগদ অর্থ থাকার বিষয়টি তিনি প্রায়ই ঘনিষ্ঠদের গর্ব করে বলতেন। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে তাঁর সম্পদ রয়েছে বলেও ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন। এগুলো আসলে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বেনামি সম্পদ। এভাবেই নানান মাধ্যমে অর্থ পাচার করেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী। যেন কেউ অর্থের উৎস সম্পর্কে জানতে না পারে।