নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে স্পিকারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠনের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধানের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে একমত হতে পারেনি অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে এ আলোচনা শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে কমিশন।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সংলাপের ১৮তম দিনে নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
নির্বাচন কমিশনার নিয়োগসংক্রান্ত নতুন প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন থাকবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্ধারিত সংখ্যক নির্বাচন কমিশনারদের সমন্বয়ে। তাদের মনোনয়নের জন্য একটি নির্বাচন কমিটি গঠিত হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার। কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত), প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি হিসেবে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। এ কমিটি বিদায়ি কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে প্রার্থী অনুসন্ধান শুরু করবে। যোগ্যতা-অযোগ্যতা, প্রার্থী আহ্বান ও অনুসন্ধান পদ্ধতি নির্ধারিত হবে সংসদে প্রণীত আইনের মাধ্যমে। কমিটি অনুসন্ধানে প্রাপ্ত প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত স্বচ্ছভাবে যাচাইবাছাই করে সর্বসম্মতিক্রমে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং প্রতিটি কমিশনার পদের জন্য একজন করে নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। রাষ্ট্রপতি তাদের পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন। এতে আরও বলা হয়েছে, স্পিকারের অধীনে সংসদ সচিবালয় এ কমিটিকে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেবে। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের ২, ৪, ৫ (ক) এবং ৬ উপ-অনুচ্ছেদ অপরিবর্তিত থাকবে। তবে ৫ উপ-অনুচ্ছেদে একটি নতুন অংশ যোগ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, যেখানে জাতীয় সংসদের জবাবদিহির আওতায় কমিশনের জন্য একটি আইন ও আচরণবিধি প্রণয়নের বিধান যুক্ত হবে।
সংলাপ শেষে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের আগের অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছাড় দিয়ে আজ যে একমত হয়েছে, তা একটি স্বাধীন ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করবে। আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংলাপে সব পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বাছাই কমিটি গঠনের প্রস্তাব চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। প্রতিটি সাংবিধানিক এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের জন্য সংবিধানে আলাদা করে নিয়োগ প্রক্রিয়া না এনে, সংশ্লিষ্ট আইনের মাধ্যমে সেসব প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আচরণবিধি নিশ্চিত করতে হবে। তবে নির্বাচন কমিশনের বিষয়টি সংবিধানে আলাদা করে উল্লেখ করা যায়, এ ক্ষেত্রে আমরা একমত। আমরা এমন একটি নির্বাচন কমিশন চাই, যারা কার্যত স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। তাই তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে কার্যক্রম পর্যন্ত সব খানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে। তিনি বলেন, বাছাই কমিটি নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রার্থী খুঁজে বের করতে একটি অনুসন্ধান প্রক্রিয়া পরিচালনা করবে, যেখানে সিভিল সোসাইটি, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণ নাম জমা দিতে পারবে। সংসদে একটি আইন প্রণয়ন করে এ অনুসন্ধান বা সার্চ কমিটির কাঠামো নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, নির্বাচন কমিশনকে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠনের প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেক মতপার্থক্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই একমত হয়েছি, নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং এটির গঠন একটি সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে হবে। তিনি বলেন, এখানে রাষ্ট্রপতির নিজস্ব মতামতের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এ অংশে আমরা একটি গঠনমূলক ও সম্মানজনক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন গঠনের ভিত্তি তৈরি করতে পেরেছি। আগে নির্বাচন কমিশনের প্রধান ও চারজন কমিশনার থাকলেও নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী সংখ্যাটি আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী কমিশনারের সংখ্যা বাড়তেও পারে, কমতেও পারে। কমিশন গঠনের পাশাপাশি কমিশনারদের আচরণবিধি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিষয়েও ঐকমত্য হয়েছে। আমরা প্রস্তাব করেছি, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের পর একটি নতুন ধারা যুক্ত করে আইন প্রণয়ন করতে হবে, যা নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের স্বচ্ছতা ও অপসারণ প্রক্রিয়া নির্ধারণ করবে।
সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের প্রক্রিয়া সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগের বিধি সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যকে ঐতিহাসিক বলে মনে করে এনসিপি। তবে নির্বাচন কমিশনের মতো অন্যান্য সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। এসব বিধানকে সংবিধানে সন্নিবেশ করতে হবে। শুরুতে ৯ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসির প্রস্তাব ছিল। তবে পরে সেটি বাদ দিয়ে নিয়োগ কমিটিভিত্তিক প্রস্তাবনায় আলোচনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জুলাই মাসের মধ্যে জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা সম্ভব, যদি রাজনৈতিক দলগুলো মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবগুলোতে পিছু না হটে। তবে সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করার চেষ্টা হলে এনসিপি এ প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করবে। সংলাপ শেষে কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন গণঅধিকার পরিষদের ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। এ কমিশন জনগণের, একক কোনো দলের নয়। কিন্তু কমিশন দু-একটি দলের হয়ে কাজ করছে। তাদের দিকে হেলে পড়ছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এভাবে জাতির আশাআকাঙ্খা পূরণ হবে না। এভাবে চলতে থাকলে গণঅধিকার পরিষদ আগামীতে বৈঠক বয়কট করবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের প্রস্তাবে বলেছে, সংবিধানের ১৩৭ সংশোধন কিংবা বিলুপ্ত করে তিনটি সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) করতে হবে। প্রতিটি কমিশনে একজন চেয়ারম্যান ও সাতজন সদস্য থাকবেন। নির্বাচন কমিশনের ন্যায় বাছাই কমিটির মাধ্যমে ওই কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ দেওয়া হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের বিষয়ে তারা বলছে, চার সদস্যের কমিশনের মেয়াদ হবে চার বছর। সেটাও হবে বাছাই কমিটির মাধ্যমে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের নিয়োগও বাছাই কমিটির মাধ্যমে করতে চায় ঐকমত্য কমিশন। সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর মতো করে ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। কমিশন মনে করে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মতো বিষয়সমূহ সরাসরি সংবিধানেও উল্লেখ করা যেতে পারে। পাশাপাশি যোগ্যতা-অযোগ্যতা, বয়সসীমা, কাজের শর্ত ও কর্মপরিধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা, পদত্যাগ ও পুনর্নিয়োগ লাভের সুযোগ কিংবা অধিকার ইত্যাদি নিয়ে আইন হবে।