রোহিঙ্গাসংকট শুধু বাংলাদেশের একক নয় বলে মনে করে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। বরং এটি একটি বৈশ্বিক সংকট। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাসংকট এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে মনে করে সংস্থাটি। সম্প্রতি বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসনবিষয়ক কমিশনারের কার্যালয়ে পাঠানো চিঠির মাধ্যমে এ মতামত তুলে ধরা হয়েছে। যদিও চিঠির মূল বিষয়বস্তু রোহিঙ্গা খাতে আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধিসংক্রান্ত। এজন্য এ রোহিঙ্গাসংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বৈশ্বিকভাবে একটি সিদ্ধান্ত আসা প্রয়োজন। তাই আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে রোহিঙ্গা, আন্তর্জাতিক শরণার্থী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীবিষয়ক বিশেষ অধিবেশন আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি জোরালোভাবে তুলে ধরা হবে বলে জানা গেছে। চীন ও ভারত আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করলে এ-সংকট সমাধান অনেকটা সহজ হয়ে যাবে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘এ দেশ দুটি বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিলে আন্তর্জাতিকভাবে নেগোসিয়েশন করা এবং রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি অনেক সহজ হতো।’
এদিকে ঢাকা সফররত জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি টম অ্যান্ড্রুজ মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গাসংকট নিয়ে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তাঁর বাসভবন যমুনায় সাক্ষাৎ করেছেন। সাম্প্রতিক সাক্ষাতে তাঁরা এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত ও চীনের অবস্থান এবং রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ-সংকট সমাধানে কতটা এগিয়ে আসছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। অবশ্য বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলছেন, ‘প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি আনতে আমরা নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছি, প্রতিবেশী দেশগুলোকেও সক্রিয়ভাবে সঙ্গে থাকার কথা বলে আসছি। রোহিঙ্গা ফেরত পাঠাতে জাতিসংঘের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে চাপ তৈরি করতে ভারত ও চীনের অবস্থানও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ-সংকটের অষ্টম বার্ষিকী হিসেবে আগামীকাল কক্সবাজারে স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একটি বিশেষ সংলাপ হতে যাচ্ছে। সে সংলাপে অংশ নেবেন টম অ্যান্ড্রুজ, উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।’
এদিকে খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে শরণার্থীদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের ঘোষণা দেওয়ার পাঁচ মাস পরও এ আলোচনার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এতে এক প্রকার হতাশ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা খাতের খরচ সামলাতেও বেকায়দায় পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। উল্টো এ পাঁচ মাসে আরও বিপুলসংখ্যাক রোহিঙ্গা নাগরিককে বলপূর্বক বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। আবার এ কাজের জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিকভাবেও চাপ প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। ফলে এ প্রক্রিয়া এখন ঝুলে গেছে। অর্থ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্র জানান, রোহিঙ্গাসংকটের আশু কোনো সমাধান তো দেখাই যাচ্ছে না, বরং এ খাতে সরকারের ব্যয়ের বোঝা বাড়ছে।
ব্যয় সামলাতে না পেরে ইউএনএইচসিআর ও বিশ্বব্যাংককে সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অবশ্য বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে উল্টো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি জানতে চাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে। এ ছাড়া আগামীকালের কনফারেন্সে রোহিঙ্গাসংকটের সামগ্রিক বিষয়ে একটি প্রেজেনটেশন উপস্থাপন করা হবে।
এতে রোহিঙ্গাদের আগমন, বাংলাদেশে তাদের অবস্থান, ব্যয় ব্যবস্থাপনা, কক্সবাজারসহ পুরো দেশে পরিবেশের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা নাগরিকদের দেশের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়া, বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোসহ নানান ইস্যু স্থান পাবে বলে জানা গেছে।