ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করার পর ২০১৯ সালে অবসরে যান আছাদুজ্জামান মিয়া। অবসরে যাওয়ার সময় চাকরির সুবিধা হিসেবে তিনি প্রায় এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা নিয়ে যান। কিন্তু তাতে তার সম্পদের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। বাস্তবতা হলো, তিনি এবং তার পরিবার অনেক আগেই অনেক ধনী হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে তার চেয়ে ধনী তার স্ত্রী আফরোজা।
আছাদুজ্জামান মিয়ার পাঁচ সদস্যের পরিবার, যার মধ্যে তিন সন্তান রয়েছে। রাজধানীর দুটি আবাসিক এলাকায় অন্তত দুটি বহুতল ভবন, রাজধানী ও সাভারে অন্তত চারটি অ্যাপার্টমেন্ট এবং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর ও ফরিদপুরে অন্তত ২০ একর খামার ও অকৃষি জমির মালিক পরিবারটি। একটি ইংরেজি দৈনিকের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। অনুসন্ধান বলছে, পরিবারটি ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত কমপক্ষে দুটি পরিবহন সংস্থা এবং একটি আইটি ফার্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারের মালিক হয়েছে।
আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও দুর্নীতি দমন কমিশন এখন তার পরিবার এবং তাদের পাঁচজন আত্মীয়ের অন্তত ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে বলে জানা গেছে, বর্তমানে যার আনুষ্ঠানিক তদন্ত চলছে।তাদের সাম্প্রতিক ট্যাক্স ফাইল অনুযায়ী আসাদুজ্জামান মিয়া দম্পতি এবং দেশে-বিদেশে ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা তাদের তিন সন্তানের সমন্বিত ঘোষিত সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২৩ কোটি টাকা। আসাদুজ্জামান মিয়া গত জুন মাসের শেষের দিকে একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার পারিবারিক সম্পদের কোনোটি অবৈধভাবে অর্জিত হওয়ার কথা অস্বীকার করেছিলেন। তিনি ওই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমরা আমাদের ট্যাক্স রিটার্নে আমাদের সম্পদ ঘোষণা করেছি।
২০২২-২০২৩ কর বর্ষে আসাদুজ্জামান মিয়া তার নামে ছয় কোটি এক লাখ টাকার সম্পদ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার হাতে নগদ এক কোটি ৬৯ লাখ টাকা দেখালেও কোনো ব্যাংক জমা দেখাননি। পরিবারটির জমির দলিল ঘেঁটে দেখা গেছে, আছাদুজ্জামান মিয় গাজীপুরের ছোট গোবিন্দপুরে তার ছোট ছেলে আসিফ মাহদিনের সঙ্গে যৌথভাবে দেড় বিঘা জমির মালিক। কিন্তু তিনি তার ট্যাক্স ফাইলে জমির তালিকা দেননি। স্ত্রী আফরোজা জামান, ঘোষণা অনুযায়ী যিনি একজন গৃহিণী, ২০২৩-২০২৪ করবর্ষে নিজেকে ৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার সম্পত্তির মালিক বলে উল্লেখ করেন। তিনিও আয়কর রিটার্নে তার ব্যাংক ডিপোজিটের তথ্য গোপন করেছেন। তবে নথি দেখাচ্ছে ভিন্ন তথ্য। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত কমপক্ষে দুটি ব্যাংকে তার এক কোটি ৫৪ লাখ টাকার বেশি জমা ছিল বলে জানা গেছে।
আছাদুজ্জামান মিয়া ২০২২-২০২৩ করবর্ষের রিটার্নে তার জন্মস্থান ফরিদপুর, ঢাকার বাড্ডা, সাভার ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ১৬ একরের বেশি কৃষিজমি দেখিয়েছেন। এসবের বেশিরভাগই তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, হেবা জমি (দান) এবং আবাসিক প্লট হিসেবে দেখিয়েছেন। নথি অনুয়ায়ী, সাবেক এই পুলিশ কমিশনার ২০১৩ সালে হঠাৎ তার দুই বোন এবং অন্য একজন অজ্ঞাতনামা দাতার কাছ থেকে ‘হেবা' (দান) মূলে ছয় একর কৃষিজমি পান। তার কর ফাইল অনুযায়ী ‘হেবা' জমি ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমি ছাড়া অন্য সব জমির ঘোষিত মূল্য দুই কোটি ১৮ লাখ ৩৫ হাজার ১৪০ টাকা। রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর সূত্র মতে, এই সম্পত্তির বর্তমান মূল্য কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি।
রাজধানীর অদূরে সাভারে আসাদুজ্জামান মিয়ার ৯০ বর্গফুট পার্কিংসহ ১ হাজার ৯১৩ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ২০২০ সালে কেনা ওই ফ্ল্যাটের মূল্য ট্যাক্স ফাইলে দেখানো হয়েছে তিন লাখ টাকা, যা প্রতি বর্গফুটে ১৫৬ টাকা। স্টক, ডিবেঞ্চার মিলিয়ে তার ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে এবং ৬৮ লাখ টাকা মূল্যের একটি টয়োটা হ্যারিয়ার রয়েছে।
স্বামীর চেয়ে ধনী আফরোজা
২০১১ সাল থেকে মাত্র এক দশকে আফরোজা ঢাকার জোয়ার সাহারা, রূপগঞ্জের পূর্বাচল, গাজীপুর ও ফরিদপুরে একাধিক জমি কিনেছেন। এসব সম্পত্তির মোট সম্মিলিত দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে দুই কোটি ২০ লাখ টাকা। তিনি শুধু ২০১৭-২০১৯ সালেই গাজীপুর ও রূপগঞ্জে ২১০ ডেসিমেল জমি কিনেছেন। এর মধ্যে নিজের নামে ১০০ ও জোবাইদা বিনতে জাফর নামে এক নারীর সঙ্গে মিলে ১১০ ডেসিমেল জমি রয়েছে। এসব জমির মোট মূল্য দেখানো হয়েছে ৩৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা বা প্রতি ডেসিমেল ১৬ হাজার ৬৫৬ টাকা।
২০২৩-২০২৪ আয়কর ফাইল অনুযায়ী আফরোজার সম্পদের পরিমাণ ৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা এক বছর আগে তার স্বামীর মোট সম্পদের চেয়ে ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা বেশি। ওই বছরে সাউথইস্ট ব্যাংকে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৪২ হাজার ৮১৬ টাকা এবং কৃষি ব্যাংকে ১৫ লাখ ৮ হাজার ৮৪০ টাকা ছিল আছাদুজ্জামান মিয়ার পত্নী আফরোজার, যা ট্যাক্স রিটার্নে দেখানো হয়নি।
প্রকৃত সম্পত্তির তথ্য গোপন করতে বিভিন্ন কৌশল নেওয়া আফরোজা জমির দলিলে ডাকনাম ব্যবহার এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্বাক্ষর করেছেন।
দুর্নীতি ঢাকার কৌশল হিসেবে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় ২০১৯ সালে একটি জমির দলিলপত্রে আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রী তার স্বামীর নাম লিখেছেন মো. মিন্টু মিয়া। মিন্টু আছাদুজ্জামানের ডাকনাম বলে তার স্বজনরা দাবি করেছেন। তবে সরকারি কাগজপত্রে ডাকনাম ব্যবহারের অনুমতি না থাকলেও পুলিশের প্রভাব খাটিয়ে তিনি এটা করেছেন।
আফরোজা তার চারটি জমির দলিলে নিজের নাম ‘আলপনা বেগম' (ডাক নাম) এবং স্বামীর নাম ‘মিন্টু মিয়া' উল্লেখ করেছেন। চারটি দলিলে ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে আলফাডাঙ্গায় ৩৯ শতক জমি কিনেছেন তিনি, যার উল্লেখ নেই সর্বশেষ ট্যাক্স ফাইলে। নানা কৌশলের আশ্রয় নেওয়া আফরোজা বেশ কিছু জমির দলিলে ভিন্ন ভিন্ন স্বাক্ষর দিয়েছেন। কখনো ‘আফরোজা জামান' কখনো ‘আফরোজা বেগম' হিসাবে স্বাক্ষর করেছেন। যদিও তার পাসপোর্ট এবং এনআইডি উভয় ক্ষেত্রেই তিনি তার অফিসিয়াল স্বাক্ষর হিসেবে ‘আফরোজা জামান' ব্যবহার করেছেন।
অনুসন্ধানের তথ্য অনুযায়ী, আফরোজা এবং তার দুই বড় সন্তান আরজেএসতিতে নিবন্ধিত অন্তত তিনটি কোম্পানির সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারের মালিক। তবে তাদের ট্যাক্স ফাইলে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাফায়ার কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামে মাত্র একটিতে তাদের শেয়ারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আফরোজা ও আসিফ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠিত মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড ও ২০১৮ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠিত গুলশান চাকায় বিনিয়োগ করেন। আছাদুজ্জামান যখন রুট পারমিট অনুমোদনকারী কমিটির প্রধান ছিলেন তখন তাদের রুট পারমিট দেওয়া হয়েছিল। মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান আফরোজা এবং এ কোম্পানিতে শেয়ার রয়েছে ৪ হাজার। অন্য শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছেন আফরোজার ভাই নুর আলম (১০০০ শেয়ার) এবং সৎ ভাই হারিছুর রহমান সোহান (১৫০০ শেয়ার)। আরজেএসসির নথিপত্রে দেখা যায়, এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোপালগঞ্জের পরিবহন নেতা মো. কালু শেখ। তার শেয়ার রয়েছে দুই হাজার।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আছাদুজ্জামান মিয়া হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তার পরিবারের সদস্যদের পাওয়া যায়নি নিকুঞ্জের বাড়িতে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল