১১ জানুয়ারি, ২০১৯ ১৮:৫৬

ধর্ষণের মহোৎসব, এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?

অ্যাডভোকেট শেখ সালাহউদ্দিন আহমেদ

ধর্ষণের মহোৎসব, এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?

পত্রিকার পাতা খুললেই ধর্ষণের সিরিজ খবর। শিশু থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, গৃহবধূ কেউই বাদ যাচ্ছে না ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে। ধর্ষণের ঘটনাগুলো শুধু ধর্ষণেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, কখনও কখনও মেরেও ফেলা হচ্ছে ধর্ষণের শিকারকে।
বর্তমান কল্পনাতীত ধর্ষণ ও ধর্ষণপ্রবণতার বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে এখন বড় ধরনের সামাজিক গবেষণার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ কেন এতটা বেপরোয়াভাবে যৌনতাতাড়িত হয়ে পড়ছে, কেনই বা ধর্ষণপ্রবণদের মধ্যে কাজ করছে না কোনো ধরনের ভয়ভীতি, এটা এখন এক বড় প্রশ্ন। ধর্ষকদের কেউ কেউ গ্রেফতারও হচ্ছে। অথচ সেসব দৃষ্টান্ত কোনোই কাজে আসছে না। 
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণপ্রবণতা এক অপ্রতিরোধ্য মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, যা শুধু আইন প্রয়োগ করেই দমানো যাবে না। প্রকৃতপক্ষে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে এবং তাই সে মানতে চাইছে না কোনোকিছুই- আইন-আদালত, সামাজিক সম্মানবোধ, আত্মসম্ভ্রম। 
আমরা মনে করি, ধর্ষণ রোধে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি এই প্রবণতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। ধর্ষণপ্রবণতার পেছনে দেশের প্রচলিত রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা কতটা দায়ী সেটাও অনুধাবন করার প্রয়োজন পড়েছে। আর্থিক দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দেশ, এই দুর্নীতি হয়তো মানুষকে উৎসাহী করছে চারিত্রিক অন্যান্য স্খলনেও। অনেকেই বলছেন, সমাজটা যেহেতু ভোগবাদী হয়ে পড়েছে, তাই মানুষ নানা ধরনের ভোগে প্রলুব্ধ হতেই পারে। এই প্রলুব্ধতার পেছনে কোনো ধরনের নৈতিকতা কাজ করছে না।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় নব্বই শতাংশের উপরে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত হয় না। লোকলজ্জা, পারিবারিক ও সামাজিক লজ্জার কারণে এসব ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। যেসব ধর্ষণের ঘটনা জনসমক্ষে আসে এবং জানাজানি হয় কিংবা ধর্ষণের শিকার মহিলারা মামলা ও বিচারপ্রার্থী হয়, সেগুলোই কেবল প্রকাশিত হয়। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিতে মানুষের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের বিষয়টিই যে সামনে এসে পড়ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সমাজে যখন শাসন-বারণের শৈথিল্য, মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণুতা বৃদ্ধি পায় এবং আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নানা নেতিবাচক দিক মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। নিপীড়ন, নির্যাতন, বিচারহীনতা, খুন, ধর্ষণ, মান্যগণ্যহীণতা দেখা দেয়। দুর্বৃত্তের আস্ফালন বৃদ্ধি এবং সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। সময়ের সাথে জীবনযাপন এবং আচার-আচরণের পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক, তবে তা সমাজের মূল ছকের মধ্যে থেকেই হওয়া বাঞ্চনীয়। আমাদের পরিবার ও সমাজের যে হাজার বছরের মূল্যবোধ, তা সারা বিশ্বেই প্রশংসিত এবং অনুকরণীয়। দুঃখের বিষয়, যতই দিন যাচ্ছে তার পরিবর্তন নেতিবাচক দিকে ধাবিত হচ্ছে। পারস্পরিক সম্মানবোধ লোপ পাচ্ছে। ধর্ষণ এবং খুনের মতো নৃশংস ও বর্বর ঘটনা বৃদ্ধি তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এসব ঘটনার সাথে প্রধানত নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত প্রভাবশালী চক্র জড়িয়ে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরাই সমাজের চালক হয়ে আছে। অপরাধমূলক ঘটনার শিকার ব্যক্তি ঘটনার প্রতিকার চাইতে গেলে উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছে। একজন ধর্ষিতার ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়ার বিষয়টি আরও বেশি অবমাননাকর এবং কঠিন। 
এমনও দেখা গেছে, ধর্ষণকারীর বিচারের পরিবর্তে ধর্ষিতাকে বিচার এবং নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এটা সম্ভব হচ্ছে, সমাজের সুকুমারবৃত্তিসম্পন্ন বিবেকবানদের নীরবতা এবং ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার কারণে। তারা তাদের নিজ দায়িত্ব এবং প্রভাব সম্পর্কে উদাসীন। এ ধরনের মানসিকতার কারণে অপরাধী প্রশ্রয় পেয়ে আরও দোর্দন্ড প্রতাপশালী হয়ে উঠছে। এদের প্রভাবের দ্বারাই অনেক সময় আইনের গতিপথ নির্ধারিত হয়। 
দেশব্যাপী যে হারে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠে, এ কোন বর্বরতার মধ্যে আমরা বসবাস করছি? এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? অসভ্যতা ও বর্বরতা প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ধর্ষণের অভিযোগ এবং তা প্রমাণের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার করতে হবে। ধর্ষিতার সুরক্ষা নিশ্চিত করে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের মানুষকে সহমর্মী হয়ে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। অন্যদিকে ধর্ষণকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে আর কেউ এই অপকর্মে না জড়ায়। সমাজ থেকে ধর্ষণ ও অন্যান্য অনৈতিক অপকর্ম প্রতিরোধে পারিবারিক ও সামাজিক নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় বিধি-নিষেধ ও আচরণ মেনে চলতে প্রত্যেককে উৎসাহী করে তুলতে হবে। আধুনিকতা মানে উচ্ছৃঙ্খলতা বা নৈতিকতা হারানো নয়, বরং নিজেকে আরও সভ্য করে তোলার উপায়, এ মানসিকতা সবার মধ্যে জাগ্রত করতে হবে।

লেখক:অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, সভাপতি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আন্দোলন ও সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর