৪ জুন, ২০২০ ২০:০২

সম্পর্কের ভাঙা-গড়ায় চাই স্বাভাবিকতা

বাণী ইয়াসমিন হাসি

সম্পর্কের ভাঙা-গড়ায় চাই স্বাভাবিকতা

বাণী ইয়াসমিন হাসি

একটা মন কেমন করা দুপুর, বিষন্ন বিকাল কিংবা মাঝরাতে ঘুম ভেঙে কাউকে মনে পড়া। একটা মানুষের সবচেয়ে নরম ব্যাপার এগুলো। কাউকে ভেবে মন খারাপ করা কিংবা কারো মুখ মনে পড়লে গোটা পৃথিবীটা আলোয় ভরে যাওয়া- ব্যাপারগুলো বেশ মায়াময়। এই মায়াময় ব্যাপারগুলোই মানুষকে সংসারে গেঁথে রাখে।

মনকে খুউব যত্নে রাখতে হয়। অল্পতেই মেঘ জমে। অভিমান জমে জমে পাহাড় হয়ে যায়। আর পাহাড়কে তো অতি সহজে ডিঙানো যায় না!

পৃথিবীর কোন সম্পর্কই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত না। আজকের ভালো সম্পর্ক কাল বিষিয়ে যেতেই পারে। সম্পর্ক ভাঙা এবং গড়া হোক সে বিয়ে বা প্রেম সমাজ যদি এটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে শিখতো তাহলে পারিবারিক সহিংসতা এবং খুনোখুনির ব্যাপারটা কমে যেত। সমাজ সম্পর্ক ভাঙাটাকে সহজ ভাবে নেয় না বলেই হয়তো নতুন সম্পর্কে জড়াতে দীর্ঘদিনের সংগীকে খুন করার মত ব্যাপার ঘটছে। একটু মাথাটাকে কাজে লাগান। একটা মৃত সম্পর্ক বয়ে নেওয়ার চেয়ে আলাদা হয়ে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা টা কি খুউব দোষের ?

কোন মানুষই জীবনের সাথে জড়িয়ে যাওয়া সবগুলো সম্পর্ক উপভোগ করতে পারে না এক জীবনে, এটাই নিয়তি। আজ আপনি যাকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলাটাও অসম্ভব মনে করছেন। একদিন হয়তো আপনার মৃত্যুর খবরটাও সে পাবে না। জীবন সময় আর সম্পর্ক বড়ই অদ্ভুত!

যে কোন সম্পর্কের মাঝে আস্থা বিশ্বাস আর প্রতিজ্ঞা থাকাটা খুউব জরুরি। যখনই এই বিষয়গুলো অনুপস্থিত হয়ে যায়, তখনি সে সম্পর্কটা হয়ে দাঁড়ায় স্থুলতার সম্পর্ক। যেখানে থাকে কেবল উদারতার আড়ালে ব্যবহার করা অথবা ব্যবহৃত হওয়া। নারী-পুরুষ ঘটিত যেকোন ঘটনা বিশ্লেষণে একটা জায়গায় আমরা বারবার ভুল করি। আর তা হচ্ছে প্রেম দাঁড়িয়ে থাকে দুজন মানুষের একের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধাবোধের উপর। সেই শ্রদ্ধাবোধের থেকেই ভরসা জন্মায়, বিনিময়ের বিষয়গুলো ঘটে। নিজেকে সমর্পণ করে একে অন্যের কাছে। তাই জীবনের কোন একটা স্তরে গিয়ে সে সম্পর্ক থাকবে কি থাকবে না সেটা বিবেচ্য নয়।

একটা সম্পর্কে দু'জনেরই সমান দায় থাকে। সম্পর্ক টা বিছানা পর্যন্ত গড়ানোর আগে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা সেই লেভেলের হওয়া উচিত। একটা সম্পর্কে থেকে সেই সম্পর্কের দায় অস্বীকার করাটা শুধু প্রতারণা নয় রীতিমত আইনগত অপরাধ। আবার সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর প্রতারণার অভিযোগ আনাটাও অন্যায়। দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্পর্কে দুজনের সম্মতিতে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। আর তার দায় কিন্তু দুজনেরই। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর দায়টা একজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার যে অপচেষ্টা সেটা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

দুইটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পারস্পরিক সম্মতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে পরবর্তীতে ইস্যু করা কোনভাবেই কাম্য নয়। কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করার অধিকার আপনার নেই। আগে সম্পর্ককে সম্মান করতে শেখেন। আজকের ভালো সম্পর্ক কাল বিষিয়ে যেতেই পারে। তাই বলে অতীত হয়ে গেলেই সম্পর্ককে অসম্মান করতে হবে! এটাও এক ধরনের বিকার!

ঘরে থাকতে থাকতে বউয়ের সঙ্গে প্রেম আর গার্লফ্রেন্ডের সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়া পুরুষের দেখা শুধু ফেসবুক আর গল্পেই মেলে। কিন্তু বাস্তবতা খুউব নির্মম। ভয়ঙ্করভাবে বেড়েছে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স। আগে কেন জানাননি? এমন প্রশ্নের কমন উত্তর-আগে তো বাইরে ব্যস্ত থাকতো, অত্যাচারটা ছিল সহনীয় মাত্রায়। এখন পান থেকে চুন খসলেই গায়ে হাত। অধিকাংশ বাসায়ই সাহায্যকারী বিদায়। সমস্ত গেরস্থালী আর বাচ্চা সামলিয়ে মেয়েটা হয়তো সারাদিনে দম ফেলারও সময় পায় না। আর বাবুটি পায়ের উপর পা তুলে টিভির রিমোট চাপতে চাপতে ফোনে বন্ধুদের সাথে দেশজাতি উদ্ধার করে। আর একটু পরপর ছুঁড়ে দেয় হাজারো ফরমায়েশ।

মানুষের মনের অসুখ বেড়েছে। কেউ খবর রাখি না তার। প্রকৃতি আপনাকে একটা সুযোগ দিয়েছে সেটার সদ্ব্যবহার করুন। নিজের পার্টনারের মনের খবর নেন। তার আশ্রয় হয়ে উঠুন। আমি বিশ্বাস করি যে মানুষ তার বউ বাচ্চা পরিবার বা সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত ও দায়িত্বশীল সে কখনো অন্যের জানমালের ক্ষতির কারণ হবে না। মায়া ছড়ান। মায়ায় বাধেন আপনার চারপাশকে। প্রাণভরে উপভোগ করেন বেঁচে থাকার প্রতিটা মুহূর্তকে।

একটা অসম সম্পর্কে পারস্পারিক বোঝাপড়া আর টানটা থাকে অনেক বেশি। যতটা স্বপ্ন, ভালোলাগা আর উচ্ছ্বাস নিয়ে একটা সম্পর্ক শুরু হয় সারাজীবন সেটা একই থাকবে এমন কোন কথা নেই। আজকের পাগলপারা সম্পর্ক কাল বিষিয়ে যেতেই পারে। সম্পর্ক বোঝা হয়ে দাঁড়ালে সেটা অহেতুক টেনে না নিয়ে মাঝপথে ছেড়ে যাওয়াই ভালো। নিজেকে মেরে ফেলা বা অন্যের মৃত্যূর কারণ হওয়া কোনভাবেই কাম্য নয়। হায় প্রেম। বিষিয়ে গেলে এর চেয়ে বিষাক্ত আর কিছু হয় না।

প্রিয় মানুষের সাথে সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর বিদায় নেয়ার সময় সে বলবে -ভালো থেকো।

বন্ধু দূরে চলে গেলে সেও বলে যাবে -ভালো থাকিস।

আপনি হয়তো কারও কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছেন, যাওয়ার আগে আপনিও বলবেন-ভালো থেকো।

সবাই চায় সবাই ভালো থাকুক। কিন্তু ভালো থাকার জন্যই তাকে পাশে প্রয়োজন ছিল, এই সহজ সত্যিটা হয়তো কাউকেই বোঝানো যায় না। তাই ভালো থাকাটাই আর হয়ে ওঠে না।

সেদিন এক অনলাইন আড্ডায় কথা হচ্ছিল ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে। মন তো কোন সীমানা মানে না। একটা মানুষ জীবনের যে কোন পর্যায়ে এসে যে কারো প্রেমে পড়তে পারে। সেটা দোষের না। দোষের হচ্ছে সেই ব্যাপারটা; যখন প্রেমের নামে প্রতারণা চালিয়ে যাওয়া হয়। আরে বাবা কারো সাথে শুধু বিছানায় যাওয়ার জন্য তো প্রেমের নাটক চালানোর দরকার নেই। যা টাকায় কিনতে পাওয়া যায় সেখানে মন নিয়ে অযথা টানা হ্যাচড়া কেন?

প্রেম করতে সাহস লাগে, সততা লাগে। বুক ফুলিয়ে বলতে জানতে হয়- ভালোবাসি। মানুষগুলো আসলেই খুব বোকা অথবা বেশি চালাক। মনের বিনিময় শুধু মনের সাথেই হওয়া উচিত।

দাম্পত্যে প্রেম বড় জরুরি। ঘোরলাগা সন্ধ্যে জরুরি। প্রেমে বুঁদ হয়ে রাতজাগা জরুরি। নিজের ভালো থাকার ইজারা কারো হাতে তুলে দেয়া হলো চরম বোকামি।

পৃথিবীতে একমাত্র বোকারাই ভালোবাসে। কোন চালাক মানুষ সেই বোকার ভালোবাসাটাকেই নিজের অধিকার ভেবে বসে। আর ব্যবহার করে দুই টাকার নোটের ন্যায় ইচ্ছেমতন!

অনুভূতি পুষে রাখতে নেই। দিনশেষে এটাই সবচেয়ে বড় দায় অথবা যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়। সহমরণ প্রথা উঠে গেছে সেই কবে। তারপরও এখনো কেউ কেউ এক মরণে দু’জন মরে।

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

সর্বশেষ খবর