যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন কারাগারে মুসলিম বন্দীদের ধর্মপালনে, বিশেষত রমজানে, প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি সম্প্রতি মাসলাহা নামক একটি মুসলিমবাদী সংগঠনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারা কর্তৃপক্ষ মুসলিম পরিচয়কে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে না; বরং কারাবন্দিদের মুসলিম পরিচয়টাই অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিভিন্ন নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
১৮ বছর বয়সী সোলাইমানকে লন্ডনের মিডল্যান্ডে গ্লেনপার্ভা কারাগারে পাঠানো হয় ২০০৯ সালে। তার ভাষ্য অনুযায়ী, সেখানে রোজা পালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাটি ছিল সময় জানা। কখন রোজা শুরু হতো আর কখন রোজা শেষ হতো, তা বোঝাই যেত না।
আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সোলাইমান বলেন, ‘সময় জানার জন্য কারাকক্ষে কোনো ঘড়ি ছিল না। সেহরিতে মুসলিম কারাবন্দিদের ঠাণ্ডা দধি, ফল ও খেজুর দেয়া হতো। বিকাল ৫টায় নির্ধারিত সময়ে কারাবন্দিরা গরম খাবার পেত।
তিনি বলেন, যদিও কারা কর্তৃপক্ষ সবসময় বন্দিদের ফ্ল্যাস্কে ভরে খাবার দেয়ার কথা, যাতে দীর্ঘ সময় থাকার পরও খাবার গরম থাকে; কিন্তু সেহরিতে মুসলিম বন্দীদের তারা সবসময় প্লেটে করে ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে তরকারি ও ভাত দিত। যদি কেউ বাইরে থেকে কোনো বন্দীর জন্য টাকা পাঠাত, তখনই কেবল সে ভালো খাবার কিনে খেতে পারত।
সোলাইমান আরও বলেন, ইফতারের সময় টিভির অনুষ্ঠান সূচি দেখে অনুমান করে আমরা ইফতার শুরু করতাম। আদম নামের আরেক ব্রিটিশ মুসলিমও ২০০৯ সালে কারাগারে ছিলেন।
তিনি বলেন, সত্যি বলতে আমার জন্য প্রথম রোজাটি ছিল সত্যিই কষ্টকর। আমি যে কারাগারে ছিলাম, সেটির ৯০ শতাংশই সাদা আলো বিশিষ্ট। তাই ঘড়ি না থাকার কারণে ও আলোর কোনো পরিবর্তন না থাকার কারণে সময় বোঝা যেত না।
মুসলিম বন্দীরা তাদের নিজ নিজ কারাকক্ষে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। আর জুমআর নামাজের জন্য কারাগারের ইবাদতের জায়গা খুলে দেয়া হতো। তবে সৌভাগ্যবশত আমি ছিলাম লেইসিস্টারে যেটি বহু সংস্কৃতি বিশিষ্ট একটি শহর। ফলে সেখানকার কারা কর্তৃপক্ষ ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি ভালোই বুঝতেন।
আদম আরও বলেন, কিন্তু যেসব কারাগারে মুসলমান বন্দীর সংখ্যা কম, সেখানে ধর্মপালনে বেশ বেগ পেতে হয়। মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হলেই সহজে জামাতে নামাজ আদায় করার সুযোগ পাওয়া যায়।
মাসলাহার পরিচালক রাহিল মুহাম্মদ আল-জাজিরাকে বলেন, কারাগারে মুসলমানদের দাড়ি রাখা, নামাজ আদায় করা এবং আরবি পড়ার মতো সাধারণ বিষয় গুলোকেও মৌলবাদ মনে করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গোটা ইংল্যান্ডে মাত্র ৫ শতাংশ মুসলিম বাস করে। মুসলমানদের সংখ্যা নিতান্ত কম হলেও সেখানকার কারাগারগুলোতে মোট বন্দীর ১৫ শতাংশই মুসলমান। এটি নিশ্চিতভাবে জাতি বৈষম্যের প্রমাণ বহন করে।
কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সোলাইমান অপরাধতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে তিনি অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে কর্মরত আছেন। যেখানে তিনি তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম কারাবন্দিদের ধর্মপালন সহজীকরণে কাজ করে যাচ্ছেন।
সোলাইমান বলেন, কারা কর্তৃপক্ষ যদি কোনো ধর্মকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে ও ভয়ের চোখে দেখে, তা হলে বুঝতে হবে, এটি তাদের বোধ শক্তি ও যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব।
মাসলাহার পরিচালক রাহিল দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এই প্রতিবেদনটি তৈরি করার আগে আমি একজন সাবেক মুসলিম কারাবন্দির সঙ্গে কথা বলেছি। সে আমাকে বলেছে-কারাগারে থাকাকালীন সে একবার টুপি পরিধান করেছিল। এটি দেখে সেখানকার এক কারা কর্মকর্তা মন্তব্য করেন-তোমার মাথার ওপরে কনডমের মতো দেখতে ওটা কী? মন্তব্যটি ওই কারাবন্দিকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছিল।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে কারাগারে মুসলিম বন্দীদের ব্যাপারে মাসলাহার পরিচালক রাহিল মুহাম্মদ ও সাবেক কারাবন্দি সোলাইমান উভয়েই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
রাহিল বলেন, এই বিশাল সংখ্যক মুসলিম বন্দীর জন্য কারা অভ্যন্তরে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন। এতে করে বন্দীদের মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়ার তীব্র আশঙ্কা রয়েছে।
মাসলাহার দেয়া তথ্যানুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই ১৭ বছরে কারাগার গুলোতে মুসলিম বন্দীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। যেখানে ২০০২ সালে মুসলিম বন্দী ছিল ৫৫০২ জন, সেখানে ২০১৯ সালে এদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৩৪১ জনে।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন