লন্ডন প্রবাসী লেখক, স্কলার, সাংবাদিক গোলাম মুর্শিদকে এ বছরের ‘মুক্তধারা-জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করা হয়েছে। এই পুরস্কারের অর্থমান তিন হাজার ডলার।
চার দিনব্যাপী নিউইয়র্ক বইমেলার তৃতীয় রাতে বিপুল করতালির মধ্যে পুরস্কারপ্রাপ্ত গোলাম মুর্শিদের নাম ঘোষণা করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক, বিজ্ঞানী বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নুরুন্নবী।
এর আগে এই পুরস্কারের প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করেন বইমেলা কমিটির আহবায়ক গোলাম ফারুক ভূইয়া। তিনি বলেন, এই সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তনের প্রথম বছরেই পেয়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। এরপর পেয়েছেন যথাক্রমে বাংলা একাডেমির প্রয়াত মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ, উপন্যাসিক দিলারা হাসেম ও সেলিনা হোসেন এবং গত বছর পেয়েছিলেন সমরেশ মজুমদার।
‘নিউইয়র্ক বইমেলা’য় ৫ হাজার নতুন বইয়ের স্টল সাজিয়েছেন ঢাকা ও আমেরিকার প্রকাশক, পুস্তক বিক্রেতা এবং ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে কর্মরত সংগঠনসূহ। মেলার দ্বিতীয় রজনীতে ‘শহীদ কাদরী গ্রন্থ পুরস্কার-২০২২’ প্রদান করা হয় ‘দেশী কবিতা-গ্রন্থ’র জন্য মুজিব ইরমকে। এই ঘোষণা দেন একুশে প্রদকপ্রাপ্ত লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নুরুন্নবী এবং মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন ফেরদৌস সাজেদিন। পুরস্কার হস্তান্তর করেন নীরা কাদরী।
‘বই হোক বিশ্ব বাঙালির মিলন সেতু’ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মোট ২২টি প্রকাশনা সংস্থা ও বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে ২৮ জুলাই শুরু হয়েছে ‘৩১তম নিউইয়র্ক বইমেলা’। নিউইয়র্ক সিটির বাঙালি অধ্যুষিত কুইন্সে ‘জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টার’র মনোরম পরিবেশে মেলা প্রাঙ্গণে এই মেলার উদ্বোধন করেন কথা সাহিত্যিক অমর মিত্র।
মেলার আহবায়ক গোলাম ফারুক ভূইয়া স্বাগত বক্তব্যে গত ৩০ বছরের মতো এবারের মেলাকেও সফল করতে সর্বস্তরের প্রবাসীর আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বলেন, বইমেলা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের একক সম্পত্তি নয়, এটি সকল নিউইয়র্কবাসীর। তাই বলতে চাই যে, বইমেলার সার্থকতা হবে নিউইয়র্কবাসীর সার্থকতা, আর ব্যর্থতা হবে নিউইয়র্কের বাসিন্দাগণেরই ব্যর্থতা। মেলা চলাকালে কোন ভুল-ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে সাথে সাথে আমাদেরকে জানাবেন, যাতে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সংশোধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। তিনি বলেন, ফ্লোরিডা, ওয়াশিংটন ডিসি, কানাডার টরন্টো প্রভৃতি স্থানের বইমেলার পথিকৃত হচ্ছে এই বইমেলা।
শফিক মিয়ার ঢোলের সাথে উপস্থিত নারী-পুরুষ ভিন্ন এক আমেজে আবিষ্ট হন। রানু ফেরদৌসের ব্যবস্থাপনা এবং আল্পনা গুহ, জাকিয়া ফাহিম, পারভিন সুলতানা, রূপা খানম, মাকসুদা আহমেদের সহায়তায় আদিত্য শাহীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয় মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জলনের পর্ব। এতে অংশ নেন দেশ ও প্রবাসের ৩১ জন কবি-লেখক-সাহিত্যিক।
মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন ফেরদৌস সাজেদিন, কথা সাহিত্যিক অমর মিত্র, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির প্রাক্তন নির্বাহী মনিরুল হক, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত কন্সাল জেনারেল এস এম নাজমুল হাসান, লেখক-গবেষক একুশে প্রদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নুরুন্নবী শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন।
বইমেলার উদ্বোধনী সন্ধ্যায়ই ‘মুক্তধারা সম্মাননা’ প্রদান করা হয় জাতিসংঘের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ড. নজরুল ইসলাম ও শিল্পপতি ও ফ্রিলেনথ্রপিস্ট সৈয়দ জাকি হোসেনকে। এ পর্বের সঞ্চালনা করেন আহবায়ক গোলাম ফারুক ভূইয়া।
তারপর গুণী শিল্পী ড. নিরুপমা রহমানের একক সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। এভাবেই মধ্যরাতে প্রথম দিনের কর্মসূচির সমাপ্তি ঘটে।
দ্বিতীয় রজনীর স্নিগ্ধ সমাপ্তি টানেন উপমহাদেশের খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। এর আগে কবিতা কেন লেখেন, কোত্থেকে অনুপ্রাণিত হলেন ইত্যাদি বিষয়ে কবিরা নিজের কথা উপস্থাপন করেন ‘কবিতা লেখার অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক এক আলোচনায়। এ পর্বের সঞ্চালনা করেন প্রবাসের জনপ্রিয় কবি ও কলাম লেখক ফকির ইলিয়াস। অংশ নেন কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি, কবি শামস আল মমীন, কবি তমিজউদ্দিন লোদি, ড. হুমায়ূন কবীর এবং অভিক বসু। তার আগে নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটর লুইস সেপুলভেদা শুভেচ্ছা বক্তব্যে উদীয়মান কম্যুনিটির সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের প্রশংসা করেন এবং করোনার আগে বাংলাদেশ সফরকালে বাঙালির সমৃদ্ধ কালচারের ওপর আলোকপাত করেন।
লেখক-প্রকাশক মুখোমুখি পর্বে বাংলা বইয়ের ডিজিটাইজেশনে প্রকাশকেরা শঙ্কিত কিনা- তা নিয়ে মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। কবি আনিস আহমেদের সঞ্চালনায় এতে অংশ নেন অনন্যার মনিরুল হক, আকাশ প্রকাশনীর আলমগীর শিকদার লোটন, কথা প্রকাশের জসিমউদ্দিন, বাতিঘরের জাফর আহমেদ রাশেদ, অন্বয় প্রকাশের হুমায়ূন কবীর ঢালি, অনুবাদক নাজমুননেসা পিয়ারি এবং অঙ্কুর প্রকাশনীর মেজবাহউদ্দিন আহমেদ।
‘বইমেলা দেশে বিদেশে’ শীর্ষক আলোচনায় অতিথি বক্তা ছিলেন ভারতের অমর মিত্র, জার্মানির নাজমুননেসা পিয়ারি, বাংলাদেশের লায়লা হাসান, ড. জালাল ফিরোজ, যুক্তরাষ্ট্রের ড. ফাহমিদুল হক, সুইডেনের দেলওয়ার হোসেন, কানাডার জসীম মল্লিক, সালমা বাণী এবং অষ্ট্রেলিয়া থেকে আগত ড. নিরুপমা রহমান। সঞ্চালনা করেন রোকেয়া হায়দার।
মেলায় স্টল দিয়েছে অঙ্কুর প্রকাশনী, অন্বয় প্রকাশ, অনন্যা প্রকাশনী, আকাশ প্রকাশনী, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, কবি প্রকাশনী, কাকলী প্রকাশনী, নালন্দা, প্রথমা প্রকাশন, বাতিঘর, সময় প্রকাশন, স্বদেশ শৈলী, মুক্তধারা নিউইয়র্ক, ঘুংঘুর, ইসলাম ইন্টারন্যাশনাল পাবলিকেশন্স, ছড়াটে, পঞ্চায়েত, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব, কালের চিঠি ও তিন বাংলা।
বিগত বছরগুলোতে যারা মেলার অতিথি ছিলেন কিন্তু এখন বেঁচে নেই তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এরা হলেন শঙ্খ ঘোষ, রফিকুল ইসলাম, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, দিলারা হাশেম, দেবেশ রায়, ড. আনিসুজ্জামান, শামসুজ্জামান খান, রাহাত খান, আবুল হাসনাত এবং হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমানে নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. বিরুপাক্ষ পাল এবং ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন দুটি পর্বে নিজের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়োগে সাহিত্য সৃষ্টির প্রসঙ্গ টানেন।
ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজির চ্যান্সেলর আবুবকর হানিপ বলেন, বই পাঠের মধ্য দিয়ে জীবনের গতি পাল্টে যায়, মন-মানসিকতা হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত হয়।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা