১ এপ্রিল, ২০২৩ ০৯:৫২

মার্চ জুড়েই ছিল নিউইয়র্ক সিটিতে বাঙালির বিজয়গাঁথা

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

মার্চ জুড়েই ছিল নিউইয়র্ক সিটিতে বাঙালির বিজয়গাঁথা

বাঙালির স্বাধীনতার মাস এবারের মার্চে নিউইয়র্ক সিটি জুড়েই ছিল বাঙালির বিজয়গাঁথা আর জয় বাংলা স্লোগান। রাজপথ, অডিটরিয়াম, সিটি হল, বরো হল, মেয়রের সরকারি বাসভবন-সর্বত্র লাল-সবুজের জয়ধ্বনি। ৫৩ তম স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে বিশ্বের রাজধানী খ্যাত নিউইয়র্ক সিটি এক বর্ণিল আমেজে ভরে উঠেছিল। 

রাজনৈতিক, সামাজিক, পেশাজীবী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, কূটনীতিক এবং মার্কিন প্রশাসন ও জাতিসংঘেও একাত্তরে বাঙালির অসাধারণ বীরত্বের কথা বিবৃত হয়েছে। এই সিটির দুটি রাস্তার নতুন নামকরণ হয়েছে ‘বাংলাদেশ স্ট্রিট’ এবং ‘লিটল বাংলাদেশ ওয়ে’ হিসেবে। এ মাসেই নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলে রেজ্যুলেশন পাশ হয়েছে ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে। 

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এই প্রথম নিউইয়র্ক সিটি মেয়রের উদ্যোগে একটি সমাবেশ হয়েছে। সিটি কাউন্সিলে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সর্বশেষ, নিউইয়র্ক সিটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘বায়োলিং পার্ক’-এ ৩০ মার্চ সিটি মেয়র উত্তোলন করলেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। বিশ্বের রাজধানী খ্যাত এবং জাতিসংঘের শহর নিউইয়র্কে পুরো মার্চ জুড়েই ছিল বাঙালির বিজয়গাথা উপাখ্যান। স্বাধীনতার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের ধারাবিবরণী। মার্কিন রাজনীতি ও প্রশাসনে জড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের পাশাপাশি নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেলের ঐকান্তিক আগ্রহে এবং লাগাতার তদ্বিরের সুফল হিসেবে স্থায়ী একটি শহীদ মিনার নির্মাণের বাজেটও ঘোষণা করেছে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানে কুইন্স বরো প্রেসিডেন্ট রিচার্ডস ডনোভ্যান। 

উল্লেখ্য, নিউইয়র্ক সিটিতে ৩ লাখের অধিক বাংলাদেশি বাস করছেন। এ যাবৎ কেবলমাত্র শাহানা হানিফ নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং বাঙালির চেতনা ধমনীতে প্রবাহিত থাকায় একের পর এক প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার পরিপূরক কাজ সম্পন্ন করছেন। 

এবারের মার্চে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে জ্যাকসন হাইটসে ৩৭ এভিনিউ এবং ৩৭ রোডের মধ্যেকার ৭৩ স্ট্রিটের নতুন নাম ‘বাংলাদেশ স্টিট’ হওয়া। এর নামফলকও উম্মোচন করা হয় ২৬ মার্চ ভর দুপুরে উৎসবের আমেজে। জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশি বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের বহু পুরনো দাবির পরিপূরক এই নামকরণের বিল সিটি কাউন্সিলে উত্থাপন ও পাশে সরব ছিলেন এলাকার কাউন্সিলম্যান ভারতীয় আমেরিকান শেকর কৃষ্ণান। সর্বস্তরের প্রবাসীরা তাঁকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন নামফলক উম্মোচনের সমাবেশে। 

ওজোনপার্কে মার্চের ১০ তারিখে বাংলাদেশি অধ্যুষিত একটি সড়কের নতুন নামকরণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। সেখানেও সর্বস্তরের প্রবাসীরা উল্লাস করেছেন। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ২১ মার্চ মেয়রের সরকারি বাসভবন ‘গ্র্যাসী ম্যানসনে’ সংবর্ধনা সমাবেশ হয়েছে শতশত উৎফুল্ল বাঙালির সমাগমে। এর আগেরদিন সন্ধ্যায় কুইন্স বরো হলে অনুষ্ঠিত হয় স্বাবাধীনতা দিবসের সমাবেশ। সেখানেও বাঙালি এবং বাংলাদেশের জয়গান ধ্বনিত হয়েছে সকলের বক্তব্যে। সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় বাঙালির এগিয়ে চলার ধারাবিবরণী ৩০ মার্চ বায়োলিং গ্রীন পার্কে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকার পরই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময়। 

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাক্ষী এই পার্কে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ সঙ্গীতের সাথে লাল-সবুজের পতাকা উড্ডীন করার সময় সিটি মেয়র এরিক এডামসের সাথে উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধা, কন্সাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম, কাউন্সিলওম্যান শাহানা হানিফ, ডেমক্র্যাটিক পার্টির ডিস্ট্রিক্ট লিডার এটর্নি মঈন চৌধুরী এবং মাজেদা এ উদ্দিনও সরব ছিলেন। 

এ সময় মেয়র এডামস তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, আমেরিকান স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায় গোটাবিশ্ব থেকে বহু মানুষ প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রে আসছে। তাদেরই একজন বাংলাদেশি আমেরিকান মীর বাশার আজ সিটি হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন আমার মত আফ্রিকান আমেরিকান মেয়রের পাশে। আর এভাবেই নিউইয়র্ক সিটি তথা যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক সমাজের বলিষ্ঠ প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান হচ্ছে। 

সিটি মেয়র বলেন, বিশ্বের কোন প্রান্ত থেকে আপনি এসেছেন সেটি বিবেচ্য নয়, সকলেই অধিকার সমান যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে সম্পৃক্ত হবার। আমাদের সকলেই যুক্তরাষ্ট্র বিনির্মাণে অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। বিপুল করতালির মধ্যে মেয়র এডামস উল্লেখ করেন, এই বিশ্বে একটি মাত্র দেশ যেখানে সকলের স্বপ্ন একইনামে অভিহিত আর তাহচ্ছে ‘আমেরিকা’। এবং আমি খুবই খুশি যে, আমি হচ্ছি প্রথম মেয়র ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সাক্ষী এই পার্কে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড্ডীন করলাম। এর আগে আমিই সর্বপ্রথম বাঙালিদের সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি উদযাপনের ব্যবস্থা করেছি গ্র্যাসী ম্যানশনে বাংলাদেশের স্বাধীণতা দিবস উপলক্ষে। মেয়র এডামস আরো বলেন, তবে আমি বাঙালিদের নতুন বন্ধু নই। ব্রুকলীনের বরো প্রেসিডেন্ট থাকার সময় থেকেই প্রবাসীদের সাথে আমার সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে নানা কর্মকাণ্ডে। 

এ সময় বক্তৃতাকালে কাউন্সিলওম্যান শাহানা হানিফ তাঁর বক্তব্য শুরু করেন বাংলায় কথা বলে। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সিড়ি বেয়ে। শাহানা বলেন, আমি অত্যন্ত গৌরবান্বিত যে হাজারো বাংলাদেশীর প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছি-যারা নিউইয়র্ক সিটিকে আপন ভূবন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। উ

ল্লেখ্য, নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিল ডিস্ট্রিক্ট-৩৯ হচ্ছে ব্রুকলীনের চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড এলাকার মধ্যে। সেখানে বহু বাঙালি বাস করছেন। সেই এলাকার নয়া নামকরণ করা হয়েছে ‘লিটল বাংলাদেশ’। সেই বিলটিও উঠিয়েছিলেন শাহানা হানিফ। শাহানা বলেন, আমরা লিটল বাংলাদেশ করার পর অন্য এলাকার প্রবাসীরাও একটি দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন এবং বাংলাদেশ যুক্ত হচ্ছে সড়ক এবং সড়কদ্বীপের নয়া নামকরণে। অর্থাৎ বহুজাতিক এ সমাজে বাঙালিরা নিজের মেধা ও শ্রমের মধ্যদিয়ে বিশেষ একটি ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন, যা প্রশাসনে গুরুত্ব পাচ্ছে। শাহানা সবিস্তারে উল্লেখ করেন, ভাষার জন্যে বাঙালির রক্তদানের সিঁড়ি বিয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসের পরিচয় দিয়ে দেশটি স্বাধীন করেছেন। সেই সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সান্নিধ্য এখানেও পাচ্ছি। শাহানা বলেন, ঠিক তেমনিভাবে আমি সিটি প্রশাসনে প্রবাসী তথা অভিবাসীগণের অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে নিরন্তর লড়াইয়ে অবতীর্ণ রয়েছি। 

কন্সাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, ২১ মার্চ ছিল এইর সিটির বাঙালিদের জন্যে ঐতিহাসিক একটি দিন। নিউইয়র্ক সিটি তথা এই স্টেটের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে প্রবাসীদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সেই সমাবেশ হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কন্সাল জেনারেল মেয়রের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, প্রবাসীদের প্রতি তথা বাংলাদেশের প্রতি আপনার যে ভালবাসা, শ্রদ্ধা, এবং দরদ সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি বলতে চাই, মেয়র এডামস ইতিমধ্যেই প্রবাসীদের হৃদয়ের গভীরতম স্থানে নিজের আসন গাড়তে সক্ষম হয়েছেন। 

মেয়র অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে ২৫ বছর যাবত কাজ করছেন বাংলাদেশি আমেরিকান মীর বাশার। কিন্তু আগে কখনো তাকে পাবলিকলি সম্মান জানানো হয়নি। বর্তমান মেয়র এরিক এডামস এই প্রথম তাকে সম্মান জানালো বলে উল্লেখ করেন মীর বাশার। এভাবেই সকল ভাষা আর বর্ণের মানুষেরা সমাদৃত হচ্ছেন সিটির সর্বস্তরে এবং যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বের সেরা সিটির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হচ্ছে নিউইয়র্ক। 

ডেমক্র্যাটিক পার্টির ডিস্ট্রিক্ট লিডার এটর্নি মঈন চৌধুরী বলেন, সিটি মেয়রের আন্তরিকতায় আমরা সকলে অভিভূত। ডেমক্র্যাটিক পার্টির তৃণমূলের অন্যতম সংগঠক মাজেদা এ উদ্দিন বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছরে এই প্রথম সিটিতে প্রবাসী বাঙালিরা সম্মানীত হচ্ছেন মেয়র এডামসের কারণে। মেয়রের ইমিগ্রেশন বিষয়ক কমিশনার ম্যানুয়েল ক্যাস্ট্রো এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিশনার এডোয়ার্ড মারমেলস্টিনও কম্যুনিটির প্রতি শুভেচ্ছা জানান। 
ম্যানুয়েল ক্যাস্ট্রো এ সময় উল্লেখ করেন যে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নিউইয়র্ক কন্স্যুলেটে বহুজাতিক সমাবেশে যোগদানকালে কন্সাল জেনারেল মনিরুল ইসলাম তাকে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এমন একটি আয়োজনের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সেই অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি প্রবাসী বাঙালিদের কর্মনিষ্ঠা, সততা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধার কারণে। এর আগে এটর্নি মঈন চৌধুরী, মাজেদা এ উদ্দিনসহ অনেকেই এ নিয়ে দেন-দরবার করেছেন। কন্সাল জেনারেল মনিরুল ইসলাম নিউইয়র্ক অঞ্চলে বসবাসরত সকল প্রবাসীকে এ কৃতিত্ব দিয়েছেন। 
স্ট্রিটের নামফলক উম্মোচন, মেয়রের বাসা এবং কুইন্স বরো হলে স্বাধীনতা দিবসের সমাবেশেও প্রবাসে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের প্রতি বিশেষ সম্মান জানানো হয়। পতাকা উত্তোলনের এ অনুষ্ঠানেও সকল বক্তাই উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের প্রতি অভিবাদন জানান। 

এ সময় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা খান মিরাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা লাবলু আনসার, বীর মুৃক্তিযোদ্ধা আব্দুল মুকিত চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হুসেন তালুকদার এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আকবর রীচি। বাঙালি চেতনায় উজ্জীবিত প্রবাসীগণের মধ্যে ছিলেন শহীদ পরিবারের সন্তান মাসুদুল হাসান, এমটিএর ইঞ্জিনিয়ার মো. ফজলুল হক, কম্যুনিটি লিডার ওসমান চৌধুরী, বহ্নিশিখা সঙ্গীত নিকেতনের প্রধান সবিতা দাস, কন্ঠশিল্পী চন্দ্রা দে প্রমূখ।  

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর