৫ এপ্রিল, ২০২১ ০৮:৫৩

লিরার চোখে জল..

জসিম মল্লিক

লিরার চোখে জল..

প্রতীকী ছবি

লিরা থাকে আলবেনি। নিউইয়র্কের রাজধানী হচ্ছে আলবেনি। নিউইয়র্ক অসংখ্যবার গেলেও আলবেনি কখনো যাইনি। টরন্টো থেকে সড়কপথে নিউইয়র্ক যেতে পথেই পড়বে আলবেনি। চার ঘণ্টার ড্রাইভ সাকুল্যে। আর নিউইয়র্ক পর্যন্ত ড্রাইভ করে গেলে আট ঘণ্টার মতো লাগে, বাসে লাগে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। ইমিগ্রেশনের ফর্মালিটি এবং নিউইয়র্কের বিখ্যাত ট্রাফিকের কারণে ম্যানহাটনের পেন স্টেশন পর্যন্ত যেতে দিন পার। সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে প্লেন। মাত্র সোয়া ঘণ্টার ফ্লাইট। নিউইয়র্কের লাগোরডিয়া এয়ারপোর্ট আমার ফেবারিট। আর টরন্টোর পীয়ারসন এয়ারপোর্ট। জেএফকে এয়াপোর্টের কথা ভুলেই গেছি। ২০০০ সালে যখন ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক ঘুরতে গেছিলাম তখন জেএফকে দিয়ে প্রথম যাই। আলবেনিতে আমার কয়েকজন বন্ধু আছে। বরিশালের বন্ধু দুলাল আছে, ইউনিভার্সিটির বন্ধু নাসরিন আছে। দুলাল লাপাত্তা হলেও নাসরিন খোঁজখবর করে। নাসরিন জেসমিনেরও বন্ধু।

লিরা আমার নতুন বন্ধু। ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। প্রায় হাজার খানেক রিকোয়েস্ট অপেক্ষমান কিন্তু স্পেস আছে ১৯টা। তারমধ্যেই লিরা আমার বন্ধু হয়ে গেলো। দৈবচয়ন বলা যায়। লিরা একদিন আমাকে বলল, আপনার সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলতে পারব! মাত্র পাঁচ মিনিট। যদি অনুমতি দেন।
-আমি বললাম, ঠিক আছে, সমস্যা নাই।
-ম্যাসেঞ্জারে ফোন করব নাকি নম্বর দেবো!
-নম্বর দেন।
-আমাকে তুমি করে বলেন।
-ওকে, ঠিক আছে।
আমাদের ফোনালাপের সারাংশ..
-আপনি কতদিন কানাডা এসেছেন সেটা আপনার লেখা পড়ে জেনেছি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কেনো এসেছেন বিদেশে!
-এমনি এসেছি। বিশেষ কোনো কারণ নাই। কোনো চিন্তা ভাবনা করেও আসিনি।
-আপনার ফ্যামিলি সম্পর্কে জানি। অর্ক, অরিত্রি, জেসমিন..। আপনার সংগ্রামী জীবনের কথাও জেনেছি লেখা পড়ে।
-হ্যাঁ, আমিতো সবসময় লিখি ওদের কথা, আমার নিজের কথা।
-আমি কিন্তু আপনাকে চিনতাম, দেখেছি। 
-মানে! কোথায় দেখেছো!
-বরিশালে।
-কবে!
-তখন আপনি বিএম কলেজে পড়েন। ১৯৮০/৮১ সাল সেটা। আপনার একটা বাই সাইকেল ছিল। সেটা নিয়ে খুব ঘুরতেন শহরে।
 -তারপর! আমি বিস্ময় লুকাতে পারি না।
-আমরা থাকতাম আপনাদের বাড়ির পাশেই সিএন্ডবি কলোনিতে। আমার বাবা পিডব্লিউডিতে চাকরি করতেন। বাবার বদলির চাকরি। আমরা মাত্র আড়াই বছর বরিশাল ছিলাম।
-কিন্তু আমাকে কীভাবে চিনেছো! আমার কৌতূহল বাড়তেই থাকে।
-আমাদের কলোনিতে প্রায়ই পানি থাকত না। আপনার এক কাজিন আর আমি সদর গার্লস স্কুলে পড়ি তখন। ওর সাথে আপনাদের বাড়িতে যেতাম গোসল করতে। তখন প্রথম দেখি আপনাকে।
-এতো বছর পরও কেনো আমার কথা মনে থাকল!
-মেয়েরা সহজে কিছু ভোলে না বুঝছেন! আপনি তখন বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপণ দিতেন, আমাদের বাসায় বিচিত্রা রাখত। চিঠিপত্র লিখতেন পত্রিকায়। আপনাকে নিয়ে আলোচনা করত আমার বোনেরা।
-ও মাই গড!
লিরা হেসে বলল, দেখেছেন খুঁজে পেলাম আপনাকে! পৃথিবী গোল!
এসব ক্ষেত্রে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলি। কি বলতে হয় বুঝতে পারি না। 
-বললাম, তোমার কে কে আছে। কত বছর আমেরিকায়!
-আমি ১৩ বছরের মতো হয় এসেছি। আমার সাথে আমার মা বাবা আছে, আর বাচ্চারা। একটু থেমে লিরা বলল, আমার হাজবেন্ড মারা গেছেন গত বছর ডিসেম্বরে, ক্যান্সারে!
-ওহ্‌ সরি টু হিয়ার।
-সে ছিল আইরিশ। আমাদের অনলাইনে পরিচয়। সেখান থেকেই ভালবাসা। তারপর সে বাংলাদেশে যায়। সেখানেই ১৯ মার্চ ২০০৭ সালে আমাদের বিয়ে হয়। তারপর আমাকে স্পন্সর করে।
-মনে হচ্ছে একটু দেরি করেই বিয়ে করেছো! 
আমি অপ্রসাঙ্গিকভাবে কথাটা বলি।
-বিয়ে হচ্ছিল না। বার বার বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছিল।
-কেনো!
-কারণ আমি দেখতে সুন্দর না, তাই। কোনো ছেলেই আমাকে পছন্দ করে নাই। আমাকে দেখতে এসে আমার বোনকে পছন্দ করত। কিন্তু আমার হাজবেন্ড পার্কার আমাকে অনেক ভালবেসেছে। আমি ছিলাম ওর পৃথিবী। কিন্তু ভাগ্য খারাপ আমার। আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে। সে অনেক সম্পদ রেখে আমার জন্য এবং তার আগের ঘরের সন্তানদের। আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু সে ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন হয়ে গেছে.. এই বলে লিরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল…।
টরন্টো, ২ এপ্রিল ২০২১

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর