২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৮:৪৬

বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন

অধ্যক্ষ মোকছেদ আলী

বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়। বাংলার বন্ধু বঙ্গবন্ধু আজীবন বাঙালি জাতির মুক্তি নিয়ে বাংলার মানুষের অধিকার, আত্মসম্মান, সুখশান্তি, সমৃদ্ধি, শিক্ষা সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে ভেবেছেন এবং এই লক্ষ্যে লড়াই, সংগ্ৰাম আন্দোলন জেল, জুলুম, কারা বরণ করেছেন মাসের পর মাস। সর্বদা এই জনপদের চিরচেনা মানুষের জন্য তার প্রাণ ছিল উৎসর্গকৃত। পিতা-মাতা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা এক কথায় পরিবার, নিজের সুখশান্তি, আরাম আয়েশ এবং জনগণের ন্যায়সঙ্গত ও অধিকার আদায় বিষয়ে তাঁর কোন পিছুটান ছিল না। তাইতো তিনি ব্যক্তি মুজিব থেকে দেশের জনগণের বন্ধু এবং এক মহীরুহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। বঙ্গ বন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করা যায় না।

ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সৃজিত হয়েছিল বাংলাদেশের অভ্যূদয়। ভাষা আন্দোলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। তার আত্মোপলব্ধির জায়গা থেকে একথা মনে প্রাণে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, মাতৃভাষা মানুষের মুখের লালার মত। যত সুস্বাদু ও উপাদেয় পুষ্টিকর খাবার হোক না কেন মুখের লালা নিঃস্মরণ ব্যতিরেকে যেমন বদহজম ও পেটের পীড়া হয় তেমনি মায়ের ভাষা চর্চা ছাড়া মানুষ জ্ঞান আহরণে বিকলাঙ্গ হয়ে অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতিতে আসক্ত হয়, শিক্ষা সংস্কৃতি সভ্যতার বিকাশ, সমৃদ্ধি ঘটে না। জগৎ ও জীবনের যেকোন বিষয়ে অন্য ভাষায় জ্ঞানার্জন করতে গেলে মাতৃভাষার মাধ্যমেই অনুধাবন করতে হয়। শেখ মুজিব একদিনে 'বঙ্গবন্ধু' এবং 'জাতির পিতা উপাধিতে ভূষিত হননি। প্রভাবশালী ও শাসক শ্রেণী যখন সাধারণ মানুষের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন, জুলুম, অত্যাচার এবং অধিকার হরণ করার চেষ্টা অথবা ষড়যন্ত্র করেছে তখনই আদ্যপান্ত চিন্তা না করেই নিজের জীবনে কী দুঃখ, যন্ত্রণা বা ঝুঁকি পূর্ণ হয়ে উঠবে কোন রূপ ভ্রুক্ষেপ না করে পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং মোকাবেলা করতে অন্যান্যদের ক্যারিসমাটিক ভাবে উদ্বুদ্ধ করে সাংগঠনিক রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। এজন্যই বঙ্গবন্ধু এক অনন্য অসাধারণ কিংবদন্তি নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর সাথে অন্যকোন নেতার তুলনা হয় না। বৃটিশ বিরোধী, পাকিস্তান সৃষ্টি, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট, ৬-দফা, আগরতলার ষড়যন্ত্রমূলক মামলা, গণ অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে তিনি অনেক বর্ষিয়ান প্রবীণ, নবীণ সহযোদ্ধা, ঝানু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছেন, উপলব্ধি করেছেন, নিকট থেকে দেখেছেন, পরামর্শ নিয়েছেন কিন্তু সিদ্ধান্তের বিষয়ে, সময়োপযোগী সাহসী পদক্ষেপ গ্ৰহনে তার দূরদর্শিতা, কৌশলী পদচারণা নিঃসন্দেহে সুদক্ষতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে। যেকোন পরিস্থিতিতে তিনি তাৎক্ষণিক বাস্তব মুখী সময়োপযোগী নির্ভুল সিদ্ধান্ত দিতেন। তিনি সবকিছু দিব্যজ্ঞান, সুক্ষ্ম দূরদৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করতেন। দূরদর্শী দক্ষ শিল্পীর রংতুলি দিয়ে আঁকা ছবি যেমন করে হৃদয়ের মাঝে আঁচড় কাটে, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু স্বীয় হস্তে সময়ের বাঁকে বাঁকে বাঙালি জাতিকে মন-মানসিকতায়, চিন্তা-চেতনায় স্বাধীনতার জন্য মনোবল চাঙ্গা রাখতে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। বিশেষ করে জাতির নিকট তাঁর নেতৃত্ব, দলের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে, ধর্য্য, ত্যাগ-তিতিক্ষা, ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা, শাসক দলের পেটিয়াদের মূখোশ উন্মোচন করতে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছে তাকে। মা, মাটি ও মানুষের সাথে মিশে তিনি একাকার হয়েছিলেন।

পত্র পল্লব যেমন করে বৃক্ষশাখা থেকে খসে পড়ে, রেফারি হুইসেল বাজিয়ে দিলে খেলা শুরু হয় এবং যবনিকা ঘটে, ঠিক সেভাবে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়নি। অনেক লড়াই সংগ্রাম,ত্যাগ-তিতিক্ষা, এক সাগর রক্ত ও ইজ্জত-সম্ভম দিয়ে অর্জিত এই দেশ বাংলাদেশ। একটুখানি পিছনে ফিরে গেলে জানা যায় স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠিত করতে এ বাঙালি জাতিকে হাজার বছর ধরে সংগ্ৰাম চালাতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে অনেক জানা, না-জানা স্বাধীনচেতা বীরদের। সূদুর পশ্চিমা, মুঘল, পাঠান, ইংরেজ, ফরাসী, পর্তুগীজ নানা জাতি-উপজাতি বছরের পর বছর ধরে শাসন, শোষণ, জুলুম, নির্যাতন করেছে। বিদেশীরা শুধুমাত্র অর্থ লুন্ঠন, শোষণ করেনি বরং বাঙালি জাতির চরিত্রকে একেবারে ধংস করেছিল এবং স্বাধীনতা, আত্মসম্মান বোধ, প্রতিবাদ করার মনোভাব সর্বোপরি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভুলতে বসেছিল মনে প্রাণে। ঘুমন্ত, নিরীহ গোবেচারা শান্ত, ভীরু কাপুরুষের মত নিজেদেরকে মনে করত। দীর্ঘদিন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকায় এবং বিশেষকরে ক্ষুদিরাম, তিতুমীর, প্রীতিলতা, মাষ্টারদাসূর্যসেন, ঈলা মিত্র, দাদা ভাই ও হাজি শরিয়তুল্লাহ সংগ্ৰাম সফল না হওয়াই স্বাধীনতার যে স্বাদ, আত্মসম্মান বোধ বিস্মৃতিতে পরিনত হিয়েছিল। বিদেশীরা স্বীয় স্বার্থ হাছিলের জন্য হীন মনোবৃত্তি সৃষ্টি করেছিল যেন জাতি-জাতিতে, ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে একে অপরে দ্বন্দ্বে, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে।

অবশ্য তাদের এই মিশন পুরোপরি ব্যর্থ হয়নি। আমাদের পরশ্রীকাতরতা ও হিংসা বিদ্বেষ মনোভাব, প্রতিপত্তি, বিত্ত প্রভাবশালী, অধিনস্তদের প্রতি প্রভূ-ভৃত্য সম্পর্ক, শক্তি-অর্থ, বুদ্ধিতে পারদর্শি ব্যক্তি অপরাপরদের প্রতি প্রজা-মুনিব ব্যবহার, ক্ষমতাধরদের প্রতি অতিমাত্রায় তোষামোদ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। বিশেষ করে এক শ্রেণির মানুষ নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে শাসকদের তোষামোদকারী সুবিধাজনক অবস্থান দেখে, নীতি জ্ঞান সম্পন্ন প্রতিবাদীগন শুধু হতাশায় নয়, মননে-মানসিকতায় উৎসাহ উদ্দীপনা মন থেকে মুছে ফেলতে শুরু করে। স্বাধীনতার স্বপ্ন বাঙালিরা একে বারে ছেড়ে দিয়েছিল। তাইতো লাহোর প্রস্তাবে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুয়োগ থাকলেও তারা প্রতারিত হয়। ভৌগলিক দিক থেকে ১২০০ মাইল দূরে অবস্থিত ভূ-খণ্ডকে নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই অবস্থা অত্যন্ত গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এজন্য তিনি ভাবতেন কি করে স্বধীকার আন্দোলন বেগবান করা যায়। তাই তো তিনি স্বাধীকার আন্দোলন গড়ে তুলতে সদা সচেষ্ট ছিলেন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে তাকে দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। নাম করা অনেক নেতা সহমত পোষণ করেনি বরং বিরোধিতা করেছেন, অনেকেই শাসক শ্রেণির পক্ষে সহায়তা করছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অধিকার বঞ্চিত, প্রতিবাদ করতে ভুলতে বসা নিরীহ, নম্র, ভীরু, কামার-কুমার, জেলে তাঁতি, শ্রমিক, মজুর, কৃষক, যারা পরিবারের সদস্যদের দুমুঠো ভাত-কাপড়ের চিন্তার প্রাসঙ্গিকতায় সার্বক্ষণিক নিমগ্ন থাকতেন। তাদের নিকট স্বাধীনতা, আন্দোলন, প্রতিবাদী হওয়া, মানসিক ভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকা এই গুলো ছিল যাদের কাছে শুধু কল্পনা তাদের সুসংগঠিত করে প্রস্তুত করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য। অধিকাংশ মানুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণের মত কোন ট্রেনিং তথা অভিজ্ঞতা কিছুই ছিল না মননে-মানসিকতায় শুধু মাত্র লক্ষ্য কোন মতে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা। এ ধরনের ঘুমন্ত জন গোষ্ঠিকে জাগ্রত করা সত্যিই চ্যালেঞ্জ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য। ভাষা আন্দোলন শিখিয়েছিল অন্যায়ের নিকট মাথা নত না করে-প্রতিবাদ করতে শেখা, দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলা। একুশের পথ বেয়ে এসে ছিল আমাদের সব অর্জন। একুশের প্রেক্ষাপট পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র দুই মাসের মধ্যেই সূচিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের ইতিবৃত্ত ব্যাখ্যা করতে একটু খানি পিছনে ফিরে তাকাতে হয়।

দেশ ভাগ হল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় আসলেন। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের পুরানো কর্মীদের নিয়ে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনা সমালোচনার জন্য কনফারেন্স ডাকলেন শামসুল হক ও শওকত মিয়া। তরুণ কর্মীরা ছত্রভঙ্গ যেন না হয় এই লক্ষ্যে যুব প্রতিষ্ঠান গঠনে ঐক্যমত হলেন তারা। সিদ্ধান্ত হল এই মুহূর্তে রাজনৈতিক কোন কর্মসূচি গ্রহণ করবে না। যে কোন দলের নেতা এই যুব সংগঠনে যোগদান করে সভ্য হতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য হবে, নাম দেওয়া হল “গণতান্ত্রিক যুবলীগ”। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কোনরূপ দাঙ্গা হাঙ্গামা নয়, হিন্দুরা যেন দেশত্যাগ না করে-যাকে ইংরেজিতে বলে Communal Harmony (সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি) তার জন্য কাজ করা। কিন্তু কিছু সদস্য (কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন) রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো দিলে মুসলিমলীগ (শামসুল হক, শওকত মিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) তাদের এই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করে তা হতে বেড়িয়ে আসলেন এবং অপরিণামদর্শীতার জন্য অল্পসময়ে তা অকার্যকর হয়ে পড়ল। কারণ পাকিস্তান সৃষ্টির এক মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করলে জনগণ ভালো চোখে দেখবে না-এই ভেবে যুবলীগ সংগঠন বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ গঠন নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। 

পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত তৎকালীন ছাত্রসমাজ কাউন্সিল না ডেকে এবং কলকাতা ও অনান্য জেলার ছাত্রদের ব্যতিরেখে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ “নাম বদলিয়ে” নিখিল পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ' গঠন করে। তাই বঙ্গবন্ধু কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও বিভিন্ন জেলার অনেক জায়গা থেকে বহু ছাত্রর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় যারা তাদের প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত না হয়ে আলাদা ছাত্র সংগঠন গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন। তার এই প্রস্তাবে আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহ, অলি আহাদ, আব্দুল হামিদ চৌধুরী, দবিরুল ইসলাম, নইম উদ্দিন, মোল্লা জালাল উদ্দিন, আব্দুর রহমান চৌধুরী আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অনেক ছাত্রনেতা ঐক্যমত পোষন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলে অ্যাসেম্বলি হলে সভায় নইম উদ্দিনকে কনভেনার করে “পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ” গঠন করা হয়। ছাত্রলীগ গঠনের পর ব্যপক সাড়া মিললো জেলায় জেলায়। প্রতিটি জেলায় কমিটি গঠন করা হলো। নইম উদ্দিন কনভেনার হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ গঠনে চষে বেড়াতেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া রূপসা থেকে পাথুরিয়া পযর্ন্ত। মুসলিম ছাত্রলীগের এই কমিটিকে পূর্বপাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠি সু-নজরে দেখতন না বরং গোয়েন্দা সংস্থার নজরে রাখত সর্বদাই। তাছাড়া পাকিস্তান মুসলিম লীগ ও পূর্বপাকিস্তান মুসলিম লীগ ভেঙে দিল খাজা নাজিমুদ্দিনকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং মুসলিম লীগের উপরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যে প্রভাবতা চিরতরে মুছে ফেলতে। কারণ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিখিল অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নেতা ছিলেন এবং মুসলিম লীগকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। শহীদ সাহেবের জনপ্রিয়তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মনে মনে হিংসা করতেন। পূর্বপাকিস্তানে শহীদ সাহেবের অনুপস্থিতিতে সরকারের একগুঁয়েমি নীতি গ্রহণের জন্য মুসলিম লীগ এই ভাবে জনপ্রিয়তার পরিবর্তে জনবিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব চিফ অর্গানাইজার মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে যাদের অফুরন্ত শ্রম, মেধা, ত্যাগ অনবদ্য অবদান তা মুছে ফেলতে শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুসহ শহীদ সাহেবের সমর্থকদের মুসলিম লীগ থেকে চলে যেতে হলো।

১৯৪৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে (Constitute Assembly) সংবিধান সভায়  রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে আলোচনায় মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী ছিলেন। শুধুমাত্র কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে ও রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ৫৬% ভাষা হলো বাংলা। বাংলাকে বাদ দিয়ে মাত্র ৭% লোকের ভাষা উর্দু রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেল। পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশ এর প্রতিবাদ দাবি করল যে, বাংলা ও উর্দূ দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করা হোক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন যুক্তভাবে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে কামরুদ্দীনের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্ৰাম পরিষদ' গঠিত হয়। পুরনো লীগ কর্মীদের মধ্যে থেকে কামরুদ্দিন সাহেব, শামসুল হক সাহেবসহ অনেকে সংগ্রাম পরিষদে যোগদান করেন। সভায় ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চকে “বাংলাভাষা দাবি দিবস” ঘোষণা করা হয়।

দিবস পালন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন নেতা বিভিন্ন জেলায় গণসংযোগ শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু ফরিদপুর, যশোর, দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশাল জেলার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ১১ মার্চে এক এক জনের দায়িত্ব এক এক জায়গায় পড়ল। সেই সময় বঙ্গবন্ধু জেনারেল পোস্ট অফিসে পিকেটিং এর দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশ ঢাকা শহরে জগন্নাথ, মিটফোর্ড, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ইডেন বিল্ডিং এর সামনে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করতে থাকে। শামসুল হক সাহেবকে‌ ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে আটক করা হয়েছে সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক গ্রেফতার, লাঠিচার্জ উপেক্ষা করে সেখানে অবস্থান গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুসহ ৭০/৭৫ জনকে বন্দী করে জেল কারাগারে পাঠানো হয়। ইতিমধ্যেই সরকারি কর্মচারি, জনগণ সোচ্চার হয়েছেন বাংলা ভাষার দাবিতে এবং রাজশাহী, খুলনা দিনাজপুর ফরিদপুর যশোর দৌলতপুরসহ বিভিন্ন জেলায় এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য এই সময় শেরে বাংলা, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী, ডা. মালেক, সবুর খান, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন ও আরও অনেক মুসলিম লীগ নেতা প্রতিবাদ করেন। নাজিমুদ্দিন সাহেব বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা, সকল রাজ বন্দিদের মুক্তি ও পূর্ব বাংলায় অফিসিয়াল ভাষা বাংলা চালু করার চুক্তি করেন এবং ১৫ই মার্চ সন্ধ্যায় সকল বন্দীদের মুক্তি দেন। ১৬ তারিখে সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র সভায় বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে ভাষা আন্দোলনের সভা অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর মাত্র কয়েক মাসের মাথায় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে শাসকগোষ্ঠি তালবাহানা শুরু করে এবং মুসলিম লীগ উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার বদ্ধপরিকর হয়। তারা মনে করে উর্দু হল ইসলামী ভাষা, ধর্মের নামে মুসলিম লীগ সরকার ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্ম ভীরুদের ভুল বোঝাতে শুরু করে। তাদের লক্ষ্য ছিল উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিয়ে বাঙালিদের আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে পিছিয়ে দেয়া, হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্কৃতি ধ্বংস করা। মজার ব্যাপার বাঙালি হয়ে মুসলিম লীগের সদস্যরা রাষ্ট্র ভাষা বাংলা পরিবর্তে উর্দু প্রস্তাব করেন। পাকিস্তান সৃষ্টিতে যে সমস্ত বাঙালি নেতা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের উপেক্ষা করা হয়। ১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। বাংলার জনগণ তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান কিন্তু তিনি জনসভায় ঘোষণা করেন "উর্দু" হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু তার সহযোদ্ধারা প্রতিবাদ করেন 'মানি না' তারপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তব্যে দিতে গিয়ে আবার ও বললেন "উর্দু " পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা"--তখন সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু ও উপস্থিত সকল ছাত্ররা সামনে বসে থেকে চিৎকার করে উঠলেন 'না 'না 'না'--তীব্র প্রতিবাদ হল। তখন বিরোধী দল না থাকায় ছাত্ররাই এক মাত্র সরকারের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ সমালোচনা করতো। ১৯৪৮ সালে ১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইন্তেকাল করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন এবং লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতাধর ব্যক্তি বনে যান। কিন্তু তারা বিরোধী দলের বিন্দুমাত্র  সমালোচনা সহ্য করতেন না। 

সরকারের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করায় রাজশাহী, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, বহিষ্কার করতে শুরু করে। ১৯৪৯ সালে গোড়ার দিকে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) ছাত্রদের বহিষ্কার নির্যাতন অত্যাচারের বিরুদ্ধে, মুক্তির দাবিতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কনভেনার করে 'জুলুম প্রতিরোধ দিবস' করার সিদ্ধান্ত হয়। মুসলিম লীগ নেতারা দেশময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে সদাসচেষ্ট হয়ে, একাজে গুণ্ডা লেলিয়ে দিতো। মুসলিম লীগ সরকার ভাষা এবং অধিকার বিষয়ে যেভাবে দমন নিপীড়ন চালিয়ে যেত তাতে সচেতন নাগরিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে বাংলার মাটির সাথে ছিল যার নাড়ির টান, যার গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দীন এক দিন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিল বাংলা রাষ্ট্র ভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, ঐতিহ্যপূর্ণ হাজার বছরের সমৃদ্ধশালী সভ্যতা তার মাধুর্য, মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে এই অনুভূতির কথাগুলো বঙ্গবন্ধুকে আন্দোলিত ও উদ্বেলিত করেছিল। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খেয়ে না খেয়ে চষে বেড়াতেন এবং জেলায় জেলায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উপর যে জুলুম অত্যাচার চলছিল মনোবল চাঙ্গা রাখতে, সাহস জোগাতে সাহায্য করতেন।

বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সময়ে ২৮/২৯ বছরের তরুণ এবং কলিকাতায় বৃটিশ বিরোধী এবং পাকিস্তান সৃষ্টিতে তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে রাজনীতির ইতিহাস উজ্জ্বল নক্ষত্র বলে পরিচিত ছিলেন। তৎকালীন সবচাইতে দেশপ্রেমিক জনদরদী, জনপ্রিয় নিখিল ভারতের অবিংসবাদিত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের একনিষ্ঠ অনুগত, বিশ্বস্ত, রাজনৈতিক কর্মী, বিশিষ্ট ছাত্র নেতা হিসেবে ঢাকায় পরিচিত ছিল না বললেই চলে। তাই তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে হিসাব করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। কারণ তার পরিচিত প্রবীণ সকল মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ সরকার গঠনে অংশগ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে শহীদ সাহেবের সাথে সম্পৃক্ততার জন্য খাজা নাজিমুদ্দিন, নূরুল আমিন ও লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কেহই তাকে সু-নজরে দেখতেন না বরং গতিবিধি গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখতেন। বঙ্গবন্ধু পুলিশি রক্ত চক্ষুকে কখনো ভয় পেতেন না। মজার বিষয় তিনি পালিয়ে বেড়ানো একেবারে অপছন্দ করতেন। ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের বহিষ্কার দেশ প্রত্যাহার করার আন্দোলনের জন্য তাকে আবার জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়।

টাঙ্গাইলে উপ-নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলে তারা আরও ক্ষীপ্ত হয়। এতোদিন ছাত্রলীগ বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে আসছিল। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন এবং পুরানো লীগ কর্মীদের সঙ্গে আলাপ চারিতায় প্রস্তাব করেন যে, ছাত্রলীগ দিয়ে সব সময় বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয় তাই রাজনৈতিক দল গঠন করা অত্যাবশ্যক। জেলখানায় থাকা অবস্থায় ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে জয়েন্ট সেক্রেটারি করে হুমায়ূন সাহেবের 'রোজগার্ডেন' বাড়িতে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, আল্লামা মওলানা রাগীব আহসান, খয়রাত হোসেন, বেগম আনোয়ারা খাতুন, আলী আহমদ খান, হাবিবুর রহমান চৌধুরী এবং অনেক জেলার প্রবীণ নেতাদের উপস্থিতিতে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, দেশ রক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করে সর্বসম্মতিক্রমে দলীয় ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করা হয়। মাওলানা হামিদ খান ভাসানী সভাপতি ও শামসুল হক সাহেব সেক্রেটারি ছিলেন তথাপি পার্টির বেশির ভাগ কাজ বঙ্গবন্ধুই করতেন। মুসলিম লীগ সরকার কোনো ভাবেই বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে মেনে নিত না এবং বিরোধী দল গঠন হোক মুসলিম লীগ তা কখনোই চাইতো না। জামালপুরে প্রথম সভায় ১৪৪ ধারা জারি হয়। 

আওয়ামী লীগের যে কোনো কর্মসূচিতেই সরকার পক্ষ বাধাসৃষ্টি করতো, বিশেষ করে ১৯৪৯ সালে ১১ অক্টোবর মাসে লিয়াকত আলী খান ঢাকা আসবেন, সেইদিন আরমানিটোলার ময়দানে সভা এবং শোভা যাত্রা হল। সেদিন শামসুল হক সাহেব সহ কয়েকজন গ্রেফতার হয়। বঙ্গবন্ধু আহত হন ও গ্রেফতার থেকে কোনভাবে রক্ষাপান। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পরামর্শে লাহোর গিয়ে শহীদ সাহেবের কাছে পূর্বপাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ধরলেন এবং করণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন। তৎকালীন নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত বলে প্রস্তাব করলেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান টাইমস, ইমরোজ পত্রিকায় পূর্ব বাংলায় কি হচ্ছে তার উপরে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাহেবের কারাগারে বন্দিত্ব, রাজনৈতিক কর্মীদের উপর নির্যাতন ও খাদ্য সমস্যা নিয়ে বিবৃতি প্রদান করলেন এবং বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হওয়া উচিত তার সমর্থনে সম্পাদক ও বিখ্যাত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ তার সহকর্মী মাজহার সাহেবের সাথে ও রাজনৈতিক মহলের সমর্থন আদায়ে লক্ষ্যে এবং “ভাষার দাবিতে নায্যতা” পাকিস্তানের সুধী মহলে, বুদ্ধিজীবিদের বুঝাতে, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণে সচেষ্ঠ হন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আসলে গ্রেফতার হলেন, ডিভিশন ছাড়াই জেলখানায় বন্দী হন। শামসুল হক ও ভাসানী সাহেব কয়েক মাসের মধ্যেই জামিন পেলেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাগ্যে কারাগারের অন্তরীণ থেকে বন্দীদশার পরিসমাপ্তি ঘটলো না। নিরাপত্তা বন্দী আইনে তাকে ১৭/১৮ মাস কারাগারে আটক থাকার পর গোপালগঞ্জ থাকা অবস্থায় জামিন পান, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আনন্দ, মিছিল, শোভাযাত্রা করলেন কিন্তু কয়েক ঘণ্টাপর নিরাপত্তা আইনে আবার ও গ্রেফতার কর হয়। বঙ্গবন্ধুকে দিনের পর দিন ঢাকা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, খুলনার কারাগারে বন্দি থাকায় অসুস্থ হয়ে পড়লে, ১৯৫১ সালের শেষ দিকে তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলী করা হয়।

তার চোখের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হওয়ায় সরকার বেকায়দায় পড়ে কারাগার হতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব বঙ্গবন্ধু'র মুক্তির জন্য জোর দাবি তুলেছিলেন এবং হাসপাতালে শহীদ সাহেব আতাউর রহমান সাহেব দেখা করেন। ছাত্রলীগ কর্মীরা ও শওকত সাহেব তার মুক্তির জন্য গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে মুক্তিদাবি করেন। ৫১ সালে অক্টোবরে লিয়াকত আলি খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিন বড়লাট পদ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন এবং কিছু দিন পর ৫২ সালের জানুয়ারিতে পল্টনে জনসভায় আবার ঘোষণা করেন "উর্দু পাকিস্তানের এক মাত্র রাষ্ট্রভাষা‌' হবে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের সাথে যে চুক্তি করে ছিল এবং নিজেই পূর্ব বাংলার আইনসভায় প্রস্তাব পাস করেছিলেন পূর্ব বাংলার অফিসিয়াল ভাষা হবে "বাংলা"। তিনি নিজেই তা ভঙ্গ করলেন। এর ফলে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদ করে। হাসপাতালে মোহাম্মদ তোয়া, অলি আহাদ বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করলে ভাষা আন্দোলন বিষয়ে গুরুত্ব পূর্ণ আলোচনা হয় এবং রাত গভীর হলে হাসপাতালের পিছনে ছাত্র নেতা খালেক নওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুবসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে দেখা করতে বলেন। 

পরামর্শ মোতাবেক ছাত্র নেতৃবৃন্দ সেখানে আসলে বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের মূলপরিকল্পনা এবং করনীয় দিক নির্দেশনা সহ "সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ" গঠন করতে পরামর্শ দেন। এবং তার কথামত ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কারণ ঐদিন পূর্ব বাংলায় আইনসভা বসবে। তিনি বলে দিলেন ছাত্রলীগ থেকে কনভেনার করে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে ‌কাজ করতে হবে। কারণ তখনকার সময়ে ছাত্রলীগ ছিল খুব জনপ্রিয় সংগঠন। সরকারের নির্যাতন, জুলুম, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজের এবং সকল রাজ বন্দিদের মুক্তির দাবিতে অনশন করবেন তাও জানিয়ে দিলেন। ছাব্বিশ মাস বিনা কারণে জেলে আটক থাকায় ১৬ ফেব্রুয়ারি হতে বঙ্গবন্ধু অনশন ধর্মঘট করবেন তা পহেলা ফেব্রুয়ারি কারা কর্তৃপক্ষের নিকট জানিয়ে দিলেন এবং শপথ নিলেন "Either I will go out of the jail or my deadbody will go out" এই সংবাদটি ছাত্রলীগ জেলায় জেলায় পাঠালে তার মুক্তির দাবিতে মিটিং মিছিল অব্যাহত থাকে। কাজী গোলাম মাহাবুবকে কনভেনার করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ২১ ফেব্রুয়ারি "বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা" করার দাবিতে দিন ধার্য করা হয়। জেল বন্দি মহিউদ্দিন অনশনে বঙ্গবন্ধুর সাথে সহমত হওয়াই ১৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে এবং বরিশালের মহিউদ্দিন যিনি মুসলিম লীগের লিয়াকত আলী খানপন্থী ছিলেন কিন্তু নূরুল আমিন রুষ্ট থাকায় জেলহাজতে পাঠানো হয় বলে একসাথে তাদের ঢাকা জেলাখানা হতে স্থানান্তর করা হয়। বঙ্গবন্ধু ১৬ ফেব্রুয়ারি হতে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ফরিদপুর জেলখানায় অনশনে ৬ দিন অতিবাহিত হলে তার শারীরিক অবস্থার অত্যন্ত অবিনতি হয় কিন্তু মুক্তি পায় না। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তাদের মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদের মুখে ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি প্রদান করেন। অপরদিকে নির্ধারিত ২১ ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা/বেলতলা হতে ১০ জন ১০ জন করে ছাত্র-ছাত্রী মিছিল বের করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। মিছিলে সরকারি পুলিশ বাহিনী সামনা সামনি টিয়ার গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে এতে রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ, শহীদ হলেন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত ও সালাম। তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতার বীজ বপন হলো। নিরীহ, নম্র ও ভদ্র জনসাধারণ সরকারের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতে, সাহসী হতে প্রয়োজনে নিজের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে অধিকার, আত্মসম্মান আদায়ে বদ্ধপরিকর হল।

অবশেষে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক আইন সভা ঘেরাও করলে বিরোধী দলের প্রস্তাবে, সরকারি দলের অনেক সদস্যের সমর্থনে প্রাদেশিক আইন সভায় নূরুল আমিন সরকার উপায়ান্তর না পেয়ে বাধ্য হয়েই “বাংলা” কে প্রাদেশিক সরকারি ভাষা হিসেবে এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করায় প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই দিন রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা গুলিবিদ্ধ স্থানে শহীদ মিনার নির্মাণ করে। শহীদ মিনার নির্মাণের সংবাদে প্রভাত থেকে শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ অর্থাৎ সর্বস্তরের মেহনতী জনতা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শুরু করে। ভাষা আন্দোলন সফলতার মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতি পরবর্তী বিভিন্ন আন্দোলনে সফলতা অর্জন করে এবং চূড়ান্ত বিজয় স্বাধীনতা (বাংলাদেশের অভূদ্যয়) অর্জনে সচেষ্ট হয়। একুশ মানেই অন্যায়ের কাছে মাথানত না করা, একুশ আমাদের চেতনা, একুশ আমাদের প্রেরণা, একুশ আমাদের গর্ব, একুশ আমাদের অহংকার। তাই কবির ভাষায় বলতে হয় “বল বীর -চির উন্নত মম শির, শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর  হিমাদ্রীর! বল বীর....”। মায়ের ভাষার জন্য এই আত্মোৎসর্গ করে বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের পাতায় নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করল। বঙ্গবন্ধু জেলখানায় বন্দি থাকার কারণে শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিলেন না বটে কিন্তু “বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষা” করার পিছনে তার অবদান ছিল অবিস্মরনীয়। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে হিসেবে বিশ্বের সকল দেশে উদযাপিত হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাধ্যমে বাংলার কৃষ্টি, ঐতিহ্য হাজার বছরের সমৃদ্ধশালী সভ্যতা তার মাধুর্য্য, মর্যদা বিশ্ব দরবারে আলোচিত ও সম্মানের সাথে সমাদৃত।

(তথ্যসূত্র:- অসমাপ্ত আত্মজীবনী-শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন-ড. আতিউর রহমান, ভাষা আন্দোলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা-ড. অজিত কুমার দাস।)

লেখক: অধ্যক্ষ, আক্কেলপুর মুজিবর রহমান সরকারি কলেজ, জয়পুরহাট।

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

সর্বশেষ খবর