১ মার্চ, ২০২২ ১৫:৩৪

নিজ গৃহে বাংলা কী আজ উপেক্ষিত?

আতি-উন-নাহার

নিজ গৃহে বাংলা কী আজ উপেক্ষিত?

আতি-উন-নাহার

ভাষা আমাদের আবেগ আর ভালোবাসার জায়গায় অবস্থান করে। ভাষা সংস্কৃতির বাহন। ভাষার প্রতি আবেগ না হলে ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া অসম্ভব হোত। ভাষা, স্বদেশ, মা, মাতৃভূমি সবকিছুই আমাদের ভালোবাসা থেকে উৎসারিত। আর এই মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রাণ দিয়েছে এদেশের আপামর জনগণ। ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর পূর্ণ হলো। এই পূর্ণতার দ্বারে এসে আজও আমরা দ্বিধাবিভক্ত। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে বিরাট ফারাক! বাংলা কি আজও উপেক্ষিত? স্বাধীন দেশে মাতৃভাষা বাংলা কি পরবাসী? সুধীজনের মাঝে নানান হতাশা!
 
১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে নারী পুরুষ, ছাত্রজনতা দেশের সকল মানুষ এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের পিয়ন ছিলেন শহিদ সালাম। তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। শহিদ জব্বার ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার গ্রাম্য বালক জব্বার গিয়েছিলেন মায়ের চিকিৎসা করাতে ঢাকা মেডিকেলে। তিনিও সেই মিছিলে শরীক হয়েছিলেন। এমনি করে সাধারণ জনতা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এই দাবিতে সেদিন মিছিল করেছিল। পাকিস্তানি জান্তা সরকারের নির্দেশে পুলিশ সেই মিছিলে অতর্কিত এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করে। অসংখ্য তাজা প্রাণের রক্তে লাল হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। মুহূর্তেই সারা দেশে আগুনের ফুলকির মতো এই সংবাদ পৌঁছে যায়। জেগে উঠে সমগ্র দেশ আন্দোলনের দাবিতে। অসংখ্য মায়ের বুক শূন্য হয়েছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় আমাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। কিন্তু তার আগে ৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদদের তাৎক্ষণিক মূল্যায়নের তাগিদে রাতের অন্ধকারে গড়ে উঠেছিল প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ। কলেজ বিল্ডিংয়ের কাজে যে সমস্ত মিস্ত্রিরা ছিল তাদের সহায়তায়  ইট, বালু ও সিমেন্ট দিয়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত হয়েছিল এক স্মৃতিস্তম্ভ। এই স্মৃতি স্তম্ভের আইডিয়া এবং ডিজাইন সবই ছিল এক রাতের মধ্যে তৈরি করা। এর সঙ্গে জড়িত ছিল গভীর আবেগ এবং ভালোবাসা। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা শহীদ মিনারকে চেনে, হামিদুর রহমানকে চেনে, কিন্তু জানেনা শহীদ মিনারের অঙ্কুরোদগমের ইতিহাস। সবচেয়ে গৌরবের বিষয় হচ্ছে যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজেই বাংলাদেশ জন্মের বীজ বপন করা হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আর তারই ফলশ্রুতিতে নির্মিত হয়েছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে স্মৃতিস্তম্ভ। ভাষা সংগ্রামী ডা. বদরুল আলমের নকশায় আঁকা এক রাতের মধ্যেই নির্মিত হয় একুশের প্রথম মিনার।
 
এই ইতিহাস আমাদের সকলের জানা। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত সেই ঘটনার পর আমরা বাংলাভাষাকে পেয়েছি  রাষ্ট্রভাষারূপে। এরপর অতিক্রান্ত হয়েছে দীর্ঘ ৭০টি বছর! বাংলা ভাষার রয়েছে একটি সোনালী ঐতিহ্য। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে আজ সমগ্র বিশ্বে। মাতৃভাষা ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে বাংলা ৫ম স্থানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এ মহাপরিচালক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী বলেছেন বাংলাদেশে মাতৃভাষা রয়েছে ৪১টি। সর্বশেষ ভাষাটির নাম রেংমিটচ্য। যার জনসংখ্যা আছে মাত্র ৬জন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির ভাষাগুলোকেও সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। আর সে লক্ষ্যে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কাজ করে যাচ্ছে সরকারের নির্দেশে। বাঙালি সংস্কৃতিকে আজ ছড়িয়ে দিতে হবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগ আমাদেরকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বাংলা আজ সমগ্র বিশ্ব দরবারে সম্মানের সাথে বিরাজ করছে। আর এই সত্যটাকে উপলব্ধি করে বাংলাকে ভালোবেসে তাকে আমাদের ব্যক্তি জীবনে এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে মর্যাদার আসনে স্থান দিতে হবে। এই জায়গাটাতে আমরা কতটা সফল আজ?
 
সমগ্র বিশ্বে বাংলার অবস্থান/বিশ্বজুড়ে বাংলা: বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত হয়েছে। চর্যাপদের মধ্য দিয়ে শুরু আমাদের ভাষার পথচলা।  
 
মধ্যযুগের বিখ্যাত বাঙালি মুসলিম কবি আব্দুল হাকিম(১৬২০-১৬৯০) তার নূরনামা কাব্যগ্রন্থে  বাংলা ভাষার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাপূর্ণ বাণী রচনা করেছেন-‘ যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি’। 
 
অতুল প্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতে উনবিংশ শতাব্দীতে একজন বিশিষ্ট বাঙালি গীতিকার। তার গানগুলোর মূল উপজীব্য বিষয় ছিল দেশপ্রেম, ও ভক্তি। বাংলা ভাষা নিয়ে কবি অতুল 
প্রসাদ সেন গেয়েছেন: 
মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা
তোমার কোলে তোমার বোলে কতই শান্তি ভালোবাসা!
 
যুগে যুগে কালে কালে কবি সাহিত্যেকেরা বাংলাকে ভালোবেসে ভাষাকে নিয়ে রচনা করেছেন গান, কবিতা। বিদেশি শক্তির অনুপ্রবেশে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ইংরেজি বেশ প্রভাবশালী ভাষা হয়েে উঠে। সমাজের অভিজাত শ্রেণি ও ধনীরাও সে প্রভাব মেনে নিয়ে তাদের সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। এক পর্যায়ে বিদেশি ভাষা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি ধারণ করে এদেশের যুবসমাজ উচ্ছৃংখলায় গা ভাসিয়েছিল। সাহিত্যক বঙ্কিম সমাজের এহেন পরিবর্তন দেখে আক্ষেপ করে বলেছিলেন: ‘বাঙালি ভদ্রলোক সন্তানরা পরস্পর কথা বলে ইংরেজিতে, চিঠিপত্র লেখে ইংরেজিতে, হয়তো সেদিন বেশি দূরে নয় যখন লোকে দূর্গাপুজার আমন্ত্রণপত্রও  ইংরেজিতে লিখবে।’
 
মাইকেল মধুসূদন দত্ত(১৮২৪-১৮৭৩) ইংরেজি শিক্ষিত ধনীর দুলালদের উচ্ছৃঙ্খলতার বর্ণনা দিয়ে প্রহসন লেখেন,একেই কি বলে সভ্যতা?(১৯৬০) বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মর্মবেদনায় উনবিংশ শতকে মধুসূদন লিখেছেন বঙ্গভাষা সনেট। 
‘হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিধি রতন:-
 তা সবে (অবোধ আমি) অবহেলা করি,
 পর-ধন-লোভে মত্ত,  করিনু ভ্রমণ
পরদেশে,ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার আঁতুড়ঘর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে থেকেও রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপরে ইংরেজি শেখার পত্তন। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্তার প্রাপ্তি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। তারপর বাংলাভাষা একের পর এক প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বের দরবারে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিরাজ করছে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, আন্দামান নিকোবর, মানভূম, সাঁওতাল পরগণা প্রভৃতি এলাকায় বাংলা ভাষার প্রচলন আছে। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষী অভিবাসী ও প্রবাসীরা রয়েছেন। বাংলা ভাষায় শিক্ষা গবেষণা এখন বিশ্বময়। বাংলা ভাষা শিক্ষাদান ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, লালন সাই, চর্যাপদ এবং মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে বাংলা সাহিত্য গবেষক ক্লিনটন বুথ সিলি, উইলিয়াম রাদিচে বেশ জনপ্রিয় নাম।
 
ভাষা সতত পরিবর্তনশীল। সমগ্র বিশ্বে বাংলার অবস্থান মাতৃভাষার দিক থেকে পঞ্চম আর জনসংখ্যার দিক থেকে ৭ম অবস্থানে আছে। ৭০ বছর পর বাংলাদেশের বর্তমান ভাষা পরিস্থিতি কেমন? বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। রাষ্ট্রভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ অনেক উন্নতি করেছে। যেমন- ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, জাপান, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার ভাষানীতি আমাদের গ্রহণ করতে হবে। তারা ইংরেজিকে বাদ দিয়ে নিজেদের রাষ্ট্রভাষাকে গ্রহণ করে উন্নতির শিখরে ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে গ্রহণ করা হয়নি। রাষ্ট্রভাষার উন্নতিতে আমাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল নিহিত। তাই বাংলা ভাষার সচেতন ব্যবহারে  যত্নবান হতে হবে নিজেদের কল্যাণের জন্য। বিচার বিভাগে, উচ্চশিক্ষায়, গবেষণায়, ব্যাংকিং- এ বাংলা চালু করতে হবে। কয়েকটি দেশ বাদে পৃথিবীর আর কোথাও ইংরেজিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয় না। 
 
ভাষা পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, মোহাম্মদ আজম, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক রেজাউল করিম ফকির লিখেছেন বাংলাদেশের বিপর্যস্ত ভাষা ও উন্নয়নে করণীয় দিক সম্পর্কে। আমাদের উচিত এসব বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা বাংলা ভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ভাষিক উন্নতির কথা বলেছেন। চিন্তা ও জ্ঞানের উন্নতির সাথে ভাষিক উন্নয়ন জড়িত। বর্তমান পুথিবীতে কেবল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য,কানাডা,অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এ ইংরেজি প্রথম ভাষা। দক্ষিণ আফ্রিকা ও তানজানিয়ায় ইংরেজি রাষ্ট্রপরিচালনার ভাষা। 
 
ভারতেও ইংরেজি সব ভাষার ঊর্ধ্বে স্থান করে নিয়েছে। কারণ ইংরেজি হচ্ছে আন্তর্জাতিক লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা ভাষা। তবে এছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও ইংরেজি রাষ্ট্র পরিচালনায় ও প্রথম ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ইংরেজি ভাষা গ্রহণ করলেই কোন জাতি জ্ঞান বিজ্ঞানও শিল্পসাহিত্যে সৃষ্টিশীল ও উন্নত হয় এটা মোটেও ঠিক নয়। এটা মনে করার কোন যুক্তসঙ্গত কারণও নেই। 
 
গবেষণায় দেখা গেছে, মাতৃভাষায় জ্ঞান অর্জন অধিক কার্যকরী। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে ইতালি ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকা রাষ্ট্রগুলোর ভাষানীতি কি? আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। নিজেদের রাষ্ট্রভাষাই কল্যাণময় এই সত্যকে অনুধাবন করতে হবে। দুঃখের বিষয় দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারকেরা বাংলার প্রতি উদাসীন। তাদের অনেকেরই ধারণা বাংলা শুধু গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাসের বিষয়। জ্ঞান বিজ্ঞানের জন্য বাংলাভাষা উপযোগী নয়। রাষ্ট্র ভাষারূপে বাংলা স্বীকৃতি পেলেও সরকার চলছে ভিন্ন পথে। তাই সরকার ইংলিশ মিডিয়ামের সাথে ইংলিশ ভার্সন চালু করেছে। উচ্চশিক্ষায় বাংলা আজও উপেক্ষিত। 
 
অনুবাদের স্বল্পতা আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। বিচার বিভাগের উচ্চ পর্যায়ে ঔপনিবেশিক যুগের ভাষাকেই গ্রহণ করছি আমরা। প্রকৃত রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশে বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ভাষা শিক্ষায় অব্যবস্থাপনা ভাষায় দক্ষতা অর্জনে অবনতি ঘটাচ্ছে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাংলা ভাষার বিকৃত চর্চা রোধ করতে হবে। শুদ্ধরূপে প্রমিত ভাষার চর্চা করতে হবে সকলকে। শুদ্ধভাবে বাংলা শিক্ষার কাজটা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শুরু করতে হবে। শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণকে শিক্ষার সঙ্গে সমন্বিত করে নিতে হবে। এমন ধারনা অনেকে পোষণ করেন যে, শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা পশ্চাৎপদতা আর ইংরেজি বাংলার মিশ্রণে কথা বলা মানে আধুনিকতা। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন শৃধু কাগজে কলমে থাকলেই হবে না। সকলকে আইন মেনে চলতে হবে। বিকৃত ভাষার অনুষ্ঠান আইন করে বন্ধ করতে হবে। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষার ব্যবহার নেই বললেই চলে। এটা জাতি হিসেবে খুব দুঃখজনক। 
 
জাতি হিসেবে সমৃদ্ধ একটি ভাষা এবং উন্নত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও আমরা উচ্চশিক্ষায় বাংলা প্রচলন করতে পারছি না! বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বলে মাত্র দুশো বছরেই বাংলা গদ্য তৎসম শব্দের খোলস ছেড়ে সরস ও নমনীয় হয়ে উঠেছে। সেই ভাষা আজ জ্ঞান বিজ্ঞানের বাহন হতে পারছে না? ঔপনিবেশিক আমলের সমাপ্তি এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও বাংলা আজ উপেক্ষিত কেন? ভাষার ক্ষয় বন্ধ করতে হলে আমাদের অন্তরের মধ্যে তৈরি করতে হবে আলোবাসা। বছর ব্যাপী ইংরেজি চর্চা করে শুধু ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বাংলার প্রতি মায়াকান্না দেখিয়ে লাভ নেই।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘ভাষা দূষণ নদী দূষণের মতোই বিধ্বংসী’। আমাদের দেশে সুনির্দিষ্ট কার্যকরী কোন ভাষানীতি নেই। ইংরেজি হচ্ছে একটি ঔপনিবেশিক ভাষা। ব্রিটিশ আমলে যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। কিন্তু আজ আমরা স্বাধীন দেশে বাস করি। জাতি হিসেবে সভ্যতার অগ্রগতিতে শামিল হতে হলে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন একটি দেশের ভাষা পরিকল্পনা বিভাগ তৈরি। বিশ্ববিদ্যালয় বা ইনস্টিটিউট দ্বারা পরিচালিত হবে। 
 
বাংলাদেশের বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানীরা মিলে তৈরি করবেন একটি উপযোগী বাংলা ভাষা পরিকল্পনা। ইতোমধ্যেই অনেক ভাষা গবেষক ভাষা পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তর গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিদেশি ভাষা বিজাতীয় সংস্কৃতিকে কেন প্রাধান্য দিচ্ছি? রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে মনসুর মুসা পর্যন্ত বাংলা ভাষার বিভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানীরা বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ গেছেন। একটি সুনির্দিষ্ট ভাষা পরিকল্পনা প্রণয়ন আর সদিচ্ছাই পারে পরিস্থিতি বদলে দিতে। 
 
তথ্য সূত্র:
১.   রেজাউল করিম ফকির: বাংলাদেশের বিপর্যস্ত ভাষা পরিস্থিতি উন্নয়নে করণীয় (অধ্যাপক,আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০২১)
২. ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর: বাংলঅদেশের ভাষা পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রভাবনা (অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০২০)
৩. অধ্যাপক সাখাওয়াত আনসারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: সংবিধানের ভাষা বিষয়ক আলোচনা ও সেমিনার, ২০২২)
৪. ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা (বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক আয়োজিত ওয়েবিনার,২০২২)
৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: বাংলা ভাষা পরিচয়।
৬. মনসুর মুসা: বাংলা ভাষা:  প্রসঙ্গ ও পরিধি।
৭. অধ্যাপক খালেদ হোসাইন, জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয় (ভাষা বিষয়ক সেমিনার,২০২২)
 
লেখক: সিনিয়র প্রভাষক, গণ বিশ্ববিদ্যালয়
 
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

সর্বশেষ খবর