৭ মার্চ, ২০২২ ১৭:৩২

মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিত বিশ্লেষণাত্মক এবং সৃজনশীল

গুলজার হোসেন উজ্জ্বল

মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিত বিশ্লেষণাত্মক এবং সৃজনশীল

গুলজার হোসেন উজ্জ্বল

করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এমন খাত কম আছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিটা হয়েছে শিক্ষা খাতে। শিক্ষা খাতের ক্ষতির ধরনটা আবার আরেক রকম। এখানে যে  ক্ষতিটা হয়েছে তা আর্থসামাজিক বৈষম্যের ক্ষত মেনে কম-বেশি হয়েছে। 

একটু পরিষ্কার করে বলি। করোনায় টানা প্রায় দুইবছর স্কুল কলেজে ক্লাস হয়নি। একটা সময়ের পর ক্লাস শুরু হয়েছে অনলাইনে। সমস্যা হলো অনলাইনে ক্লাস করতে হলে তো শিক্ষার্থীদের স্মার্ট ফোন নয়ত ল্যাপটপ থাকতে হয়। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ পর্যায়ের কয়জন শিক্ষার্থীর স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপ আছে? যথাযথ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ আছে কয়জনের? ফলে অনিবার্যভাবেই শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছে। কেউ ক্লাস করতে পেরেছে,  কেউ পারেনি। 

এই বৈষম্যের ভেতর পাবলিক পরীক্ষায় প্রথমে অটোপাশ পরে সমালোচনার মুখে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হলো। ব্যাপক হারে এ প্লাস পেলো। পাশও করলো অনেক। কিন্তু আজকাল শিক্ষার্থীদের কাছে আসল পরীক্ষা হলো বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং অর্থাৎ স্নাতক পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষা। একে আমরা আজকাল ভর্তিযুদ্ধ বলি। একেকটি আসনের জন্য যে পরিমাণ শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতা করে তার পরিসংখ্যান শুনলে আঁতকে উঠতে হয়। ডাবল এ প্লাস পেয়েও ছেলেমেয়েরা যখন কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার সুযোগ পায় না স্বাভাবিকভাবেই তখন এই পড়ালেখা এবং এই এ প্লাস রেজাল্ট অর্থহীন ঠেকে।

করোনাকালীন লেখাপড়ায় যে বৈষম্যের শিকার হয়েছে শিক্ষার্থীরা তার একটি করুণ প্রতিফলন ঘটবে এই পরীক্ষায়। যে ছেলে মেয়েরা অনলাইনে ক্লাস করতে পেরেছে আর যারা পারেনি তাদের প্রস্তুতি সাধারণ যুক্তিতেই এক হবে না। মফস্বল পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা একরকম ফল করবে, শহরের শিক্ষার্থীরা আরেকরকম। এমনিতেই সমাজের স্বচ্ছল শ্রেণি ও অস্বচ্ছল শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগে থেকেই একধরনের বৈষম্য ছিল। এবার তা আরও প্রকট হবে। এই বৈষম্যের জন্য তাহলে কে দায়ী হবে? 

এবার আসি ভর্তি পরীক্ষার সিলেবাস প্রসঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা হবে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা হবে পূর্ণ সিলেবাসে। এর পেছনে সম্ভবত যুক্তিটি এই যে,  মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা একটি সংবেদনশীল বিষয়। এর উপর জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এটি একটি বিরাট ভুল ধারণা। মেডিকেল শিক্ষার্থীরা জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করে না। জাতির ভাগ্য নির্ধারণে তাদের অবদান তুলনামূলক  কম। যথেষ্ট কম। 

চিকিৎসা হলো একটি সেবাখাত। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই জাতির ভবিষ্যৎ ভাগ্য নির্ধারক। তারাই ভবিষ্যতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। তারাই আমাদের প্রশাসক, পরিচালক, আইনপ্রণেতা ও আইন সংরক্ষক হয়ে থাকেন। ফলে আলাদাভাবে মেডিকেল শিক্ষাকে সংবেদনশীল আর বাকিগুলো কম সংবেদনশীল ভাবা এক প্রকারের অদূরদর্শিতা। 

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা পূর্ণ সিলেবাসে হলে গ্রামের এবং অস্বচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা চরম বৈষম্যের শিকার হবে। বিগত দুটি বছরে তারা লেখাপড়ায় যে বৈষম্যের কবলে পড়েছে তার কুফল দেখতে পাবে এই পরীক্ষায়। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হলে সেটা পুষিয়ে নেওয়ার একটা সুযোগ অন্তত থাকে। যদিও সেখানেও বৈষম্যের  ছাপ কিছুটা হলেও থাকবে। কিন্তু সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হলে পার্থিক্যটা কমিয়ে আনা যাবে, এটাই আসল কথা। 

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা সংবেদনশীল ও জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হওয়ার অজুহাতে যে পূর্ণ বা বিস্তৃত সিলেবাসের কথা বলা হচ্ছে তা কি আদৌ খুব জরুরি? যে সিলেবাসে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা হয় এবং যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয় তা কি চিকিৎসা পেশার জন্য উপযুক্ত ছাত্র বাছাইয়ে সঠিক ভূমিকা রাখছে?  

মেডিকেল সায়েন্সের একজন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক হবার সুবাদে আমার যে অভিজ্ঞতা; তার আলোকে বলছি, মেডিকেল সায়েন্সে পড়াশুনার পাশাপাশি যে মানসিক ও সামাজিক দক্ষতার প্রয়োজন হয় মেডিকেল শিক্ষার্থীদের অধিকাংশের মধ্যেই তা থাকে না। কারণ প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষা সঠিক শিক্ষার্থী বাছাই করতে পারে না। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি অধিকাংশ মেডিকেল শিক্ষার্থী এবং ডাক্তারই তার পড়াশুনা ও পেশা নিয়ে হতাশাগ্রস্ত। তারা এই পেশাকে হয় ভালবাসে না নয়ত নিজেদের বঞ্চিত এবং কখনো কখনো নিপীড়িতও মনে করে। কেউ কেউ নিজেকে মিসফিটও মনে করে। এর প্রভাব পড়ে রোগী সেবায়। আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগী আর ডাক্তারের মধ্যে সঠিক Rapport তৈরি হয় না। পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধার সম্পর্কটি তৈরি হয় না। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে সঠিক মেধা নির্বাচন করতে না পারাটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করি। 

আমাদের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি ও সিলেবাস গত তিরিশ বছরে প্রায় একইরকম। সিলেবাস বিস্তৃত করলেই সঠিক মেধা নির্বাচন হয় না। যে ধরনের সিলেবাস ও প্রশ্নপত্রে আমাদের দেশে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাটি হয় তা মূলত Bookish, কোচিং এ বার বার পরীক্ষা দেওয়া, মুখস্ত করতে পারঙ্গম ছাত্রদেরকেই বেছে নেয়। অথচ মেডিকেল সায়েন্স একটি দুর্দান্ত সৃজনশীল, বিশ্লেষণধর্মী, গতিশীল বিজ্ঞান। এর ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিত বিশ্লেষণাত্মক এবং সৃজনশীল। সমস্যা অনুধাবন করবার ক্ষমতা, সঠিক পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, মানসিক দক্ষতার প্রতিফলন পাওয়া যাবে এমন প্রশ্নের প্রয়োজন। সিলেবাস সংক্ষিপ্ত নাকি পূর্ণাঙ্গ সেটা নয়। বছরের পর বছর প্রায় একইরকম প্রশ্ন হচ্ছে। যা মুখস্ত বিদ্যাকেই উৎসাহিত করছে। প্রশ্ন নিয়ে নিরীক্ষা আমাদের দেশে তেমন হয় না। 

ব্রিটিশ রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান এক সময় তাদের জগৎবিখ্যাত এমআরসিপি পরীক্ষায় হাতে কলমে প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দিত। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ ও তার মান সমান হয় না। তারা এই মান সমানভাবে নিশ্চিতও করতে পারে না, নিরূপণও করতে পারে না। ফলে তারা প্রশ্ন পদ্ধতিতে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছে যেন অন্তত মৌলিক জ্ঞান, সমস্যা অনুধাবন ও  বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা, সমাধানের ক্ষমতাটি সমানভাবে নিরূপণ করা যায়। তারা প্রশিক্ষণের বাধ্যবাধকতাটিই বাদ দিয়ে দিল। প্রশ্নপদ্ধতিটিই এমনভাবে করল যেন তাদের মূল উদ্দেশ্যটি সফল হয়। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর