১৯ মার্চ, ২০২২ ১৪:৪০

এ যেন সুন্দরী ববিতা

আসিফ ইকবাল

এ যেন সুন্দরী ববিতা

আসিফ ইকবাল

মনে হচ্ছিল পুঁথি পড়ছে! 
মনোযোগ দিয়ে শোনার পর বুঝলাম, পুঁথি পাঠের মতো ছন্দের তালে তালে চুলের ক্লিপ বিক্রি করছে। 
একটি লাঠির মাথায় পুতুল বসানো। রঙচঙা কাপড় পড়া পুতুলটির চুল বেশ লম্বা। ছেলেটা পেছনে দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিতে পুতুলটির চুল আঁচড়ে বাঁধছে। আর সুর করে গাইছে-
"এখন দেখুন অপু বিশ্বাসকে।"
আবার নতুন করে চুল আচড়ে দিচ্ছে আর বাঁধছে। সুর করে বলছে-
"এ যেন সুন্দরী ববিতা।"
ছেলেটিকে ঘিরে ঝটলা করে দাঁড়িয়ে আরও ১৫/২০ জন লোক। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছি ছেলেটির ক্লিপ লাগানোর নানা কসরত। ছেলেটির হাতের কাজ দেখে আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম!

রাতের ব্যস্ত নগরী। রাত ১০টা। মিরপুর ১১ নম্বর ব্র্যাক ব্যাংকের সামনে ছোট্ট জটলা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি। আইল্যান্ডের মাঝে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে ছেলেটি সুর করে বলে যাচ্ছে। আমার মতো উৎসুক লোকের ভিড়ই বেশি। ২/৩ জন গার্মেন্টকর্মী ক্লিপ কিনে আবার শিখে নিচ্ছে কীভাবে লাগাতে হয়। ছেলেটিও শিক্ষকের মতো শিখিয়ে দিচ্ছে খরিদ্দার লক্ষ্মী ভেবে!

ছেলেটির নাম কোহিনুর। বাহি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পড়াশোনা এসএসসি। বুড়ি মা, ছোট বোন নিয়ে তার সংসার। বাসা টঙ্গী। আগে ভ্যান চালাতো। পায়ে ব্যথা পাওয়ার পর পুতুল দেখিয়ে মিরপুর, উত্তরায় ঘুরে ঘুরে ক্লিপ বিক্রি করে।

প্লাস্টিকের ক্লিপ ডজন হিসেবে কিনে আনে চকবাজার থেকে। প্রতিটি ক্লিপ ৮ টাকা করে কিনে ২০ টাকায় বিক্রি করে। কোহিনুর ক্লিপ বিক্রি করে যেখানে সেখানে আবার গার্মেন্টস বেশি। প্রতিদিন ৮/১০ কিলোমিটার হেঁটে ৫০/৬০টি ক্লিপ বিক্রি করে। দুপর, আর বিকালের খাবার খরচ ছাড়া প্রতিদিন ৫০০ টাকার মতো থাকে। এতেই খুশি কোহিনুর-

"ভ্যান চালিয়ে একইরকম টাকা আয় করতাম। কিন্তু স্বাধীন ছিলাম না। সময়মত ডেলিভারি দিতে না পারলে মালিক বাজে ভাষায় বকা দিত। এখন আমি স্বাধীন। নিজের মতো করে ব্যবসা করি। আল্লাহ ভালো রাখছেন।"

সত্যি ভালো আছে কোহিনুর। স্বাধীন। কারও কথা শুনতে হয় না। বকা খেতে হয় না। চাপ নেই কারও।

কোহিনুর ফেরিওয়ালা। অথচ বুদ্ধি করে, অভিনব উপায়ে ব্যবসা করছে। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় মানিয়ে নিতে নতুনত্ব এনেছে ব্যবসায়... 
বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় শুধু বললো-
"কারো অধীনে চাকরি করার চেয়ে ব্যবসা করে অল্প টাকা কামাই করা অনেক শান্তির। মিথ্যা বলা লাগে না। জবাব দিতে হয় না কাউকে। আল্লাহ ভালোই রাখছেন।"

বিরক্তিকর জনারণ্যে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, আমরা সবাই যদি কোহিনুরের মতো স্বাধীন চিন্তা করতে পারতাম সবাই যদি নিজের কর্মের উপর আস্থা রাখতে পারতাম! সবাই যদি সৎ মানসিকতার হতাম!

লেখক : জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর