২২ মার্চ, ২০২২ ১৮:১০

বাংলাদেশ ও ডিজিটাল কৃষি পদ্ধতি

ড. খালিদুজ্জামান এলিন

বাংলাদেশ ও ডিজিটাল কৃষি পদ্ধতি

ড. খালিদুজ্জামান এলিন

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বা কৃষি-প্রযুক্তি হল কৃষি-খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পূর্বশর্ত। বিশেষ করে, কৃষিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বাস্তবায়নের জন্য। ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদার কারণে কৃষি-খাদ্য খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রযুক্তির ব্যবহারে একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশের প্রাথমিক উৎপাদনের বিশাল একটা অংশ আসে এই কৃষিখাত থেকে। ২০২০ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১২.৯২ শতাংশই আসে এই সেক্টর থেকে। যদিও বাংলাদেশ অনেক বছর যাবত অনেক কৃষি পণ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০ তালিকায় অবস্থান করছে কিন্তু জনসংখ্যার বৃদ্ধি, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক মহামারীর কারণে অস্থিতিশীল বিশ্ব অর্থনীতি আগামী দিনগুলিতে এই খাতের উৎপাদনশীলতা এবং বৃদ্ধিকে ধীর করে দিতে পারে। এছাড়াও, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, ২০২১ সালে বিশ্বের ৭.৯ বিলিয়ন লোকসংখ্যা যা ২০৫০ সালে বেড়ে আনুমানিক ৯.৭ বিলিয়ন এ পৌঁছাবে । আগামী ৩০ বছরে, বিশ্ব এই বিরাট জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরনে একটি বড় চ্যালেঞ্জর মুখোমুখি হবে এবং অনেক দেশ ও মহাদেশ খাদ্য সংকটে ভুগবে। কৃষি উৎপাদনকে সর্বাধিক করতে এবং এটিকে টেকসই করার জন্য, কৃষি প্রযুক্তি এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ধারণা দ্রুত আধুনিক কৃষির (স্মার্ট ফার্মিং সিস্টেমের) দিকে পরিবর্তিত হচ্ছে। স্মার্ট ফার্মিং হল কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উন্নত সংস্করণ যা শুধুমাত্র শস্য পদ্ধতিতে নয় বরং মাছ চাষ এবং হাঁস-মুরগির উৎপাদন ব্যবস্থায়ও ব্যবহার করা সম্ভব। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ ইতিমধ্যে এই আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা শুরু করেছে।

যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সাথে একত্রিত করা হয়, তখন একে স্মার্ট ফার্মিং সিস্টেম বলা যায়। ক্লাউড কম্পিউটিং, আইওটি এবং আইওটি ভিত্তিক সেন্সিং সিস্টেম, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, এগ্রিকালচারাল রোবোটিক্স, পয়েন্ট-ক্লাউড, লাইডার এবং ডেপ্ত-ইমেজিং এর সমন্বিত প্রয়োগ এর আরও অগ্রগতি সাধিত করতে পারে। মূলত সেই জায়গা থেকেই, ডিজিটাল টুইনস এর ধারণাটি এসেছে এবং সম্ভবত শীঘ্রই এটি বিশেষকরে উন্নত বিশ্বে সমগ্র কৃষি কার্যক্রমের জন্য একটি যুগান্তকারী হিসাবে কাজ করবে। আমাদের দেশ এটি বাস্তবায়নে দিকে অগ্রসর হলে প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত কর্মসংস্থানের সংখ্যা বাড়বে এবং প্রযুক্তিবিদরা যথাযথ কাজের সুযোগ পাবে।

চিত্র-১: কৃষি ব্যবস্থায় প্রযুক্তির বিবর্তন

সহজভাবে বললে,  ডিজিটাল টুইনস (ডিটি) হল একটি বস্তুগত সিস্টেমের ভার্চুয়্যাল যমজ। এটি দূরবর্তী স্থান থেকে একটি খামারের ডিজিটাল উপস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। ডিজিটাল টুইনসকে স্মার্ট ফার্মিং সিস্টেমের পরবর্তী প্রজন্ম বা ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই ডিটি বাস্তবায়ন শুধুমাত্র দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্যই কাজ করবে না (যেমন সার, সেচ ও কীটনাশক অপ্টিমাইজেশান, কীটপতঙ্গ এবং আগাছা দমন ইত্যাদি), উপরন্তু কৃষি-খাদ্য পণ্য এর উপর আস্থা এবং স্বচ্ছতা ব্যবস্থাপনা তৈরিতেও কাজ করতে পারে।

ডিজিটাল টুইনস কে একটি সাইবার-ফিজিক্যাল ইন্টারফেস হিসাবে দেখা যেতে পারে যা নির্বিঘ্নে সংবেদন, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, পরিকল্পনা এবং সমস্ত কৃষি খামার কার্যক্রমের স্মার্টলি নিয়ন্ত্রণকে একীভূত করবে। কৃষকরা রিয়েল-টাইম ডিজিটাল তথ্যের উপর ভিত্তি করে টএঠ এবং টঅঠ ব্যবহার করে দূরবর্তীভাবে সমস্ত কার্যক্রম নিরীক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে সরাসরি খামারে না যেয়ে। অতএব, ডিটি ব্যবহারে কৃষক তাদের ক্ষেতে বা উদ্ভিদ কারখানায় ফসলের বৃদ্ধি, রোগ, পরিপক্কতা,  আবহাওয়া এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার ক্রমাগত তথ্য পেতে পারে এবং একইভাবে, কৃষক দ্রুত প্রয়োজনীয় বাবস্থা নিতে সক্ষম হবে ভার্চুয়াল পরিবেশ থেকে। সাইটে স্থাপন করা এবং মোবাইল এগ্রিকালচারাল রোবোটিক্স বা ড্রোনের সাথে সংযুক্ত বিভিন্ন সেন্সর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্লাউড এ তথ্য পাঠাবে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উক্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেবে এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি ব্যবহার করে তৈরিকৃত দূরবর্তী ভার্চুয়াল পরিবেশে এটিকে দেখাবে।

চিত্র-২: কৃষিতে ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল টুইনস সিস্টেমের ধারণাগত চিত্র

রিয়েল টাইম মনিটরিং এবং দূর থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য মাছ এবং হাঁস-মুরগির খামারের মতো অন্যান্য কৃষি খাতে ডিটি প্রয়োগ করা সম্ভব। পোল্ট্রি খামারিরা তাদের মুরগির বৃদ্ধি এবং রোগের লক্ষণ, খাবার ব্যবস্থা, খামারের পরিবেশ ও  অবস্থার বিভিন্ন গুণগত এবং পরিমাণগত তথ্য দূর থেকে পেতে পারেন এবং অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এটি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পেও প্রয়োগ হতে পারে যাতে খাদ্যের মান এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। বাংলাদেশের ভবিষ্যত কৃষিতে ডিটি স্থাপন অনেক সুবিধা দিতে পারে, যেমন দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা (ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম), দক্ষ ব্যবস্থাপনা, কম খরচে উৎপাদন বৃদ্ধি  এবং পরিবেশ এর ক্ষতিকর প্রভাব কমানো (সার ও কীটনাশক এর পরিমিত ব্যবহারের মাধ্যমে) ইত্যাদি। ডিটি স্থাপনে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য নিচের পদক্ষেপ গুলি একান্ত বিবেচনাযোগ্য:

* শিক্ষিত বা তরুণ প্রজন্মকে কৃষি খাতে নিয়ে আসতে হবে এবং বিনিয়োগ করতে হবে। ইতিমধ্যে একটি প্রবণতা শুরু হয়েছে যে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এখনকৃষি-খাদ্য খাতে তাদের আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিষয়ে অনেক উদ্যোগ নিচ্ছে।
* প্রযুক্তিবিদ ও  কৃষি প্রকৌশলীদের এই ডোমেনের সাথে কাজ করার সুযোগ প্রদান করা একান্ত দরকার । এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সিলেবাস এর সংস্করণ ও পরিমার্জন করা।
* ডিজিটাল কৃষিতে আগ্রহী ও জড়িত বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
* ডিটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য এবং পরিষেবা তৈরির জন্য স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া।
* ধারণাটিকে বাস্তবে রূপান্তর করতে সরকার, একাডেমিয়া এবং শিল্পখাত এর মধ্যে সহযোগিতা, সমন্বয় ও একত্রে কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
* এ সম্পর্কিত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি।

ডিজিটাল টুইনস এর বাস্তবায়ন এবং আমাদের কৃষিকে আধুনিকায়ন বৈশ্বিক কৃষিতে আমাদের অবস্থান আর সুদৃঢ় করতে পারে।  বহির্বিশ্বে আমাদের কৃষি পণ্যের গ্রহনযোগ্যতা ও রপ্তানি আরও সহজ ও বৃদ্ধি করতে পারে । যদিও এখনও আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি, আমরা আশাবাদী যে সঠিক পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আগামী দিনে এর বাস্তবায়ন দেখতে পারব।

লেখক: শিক্ষক, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষক, আকিতা প্রিফেকচারাল ইউনিভার্সিটি, জাপান।


বিডি প্রতিদিন/হিমেল

সর্বশেষ খবর