শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আহমদ রফিক সত্যনিষ্ঠ ও তত্ত্বনিষ্ঠ

যতীন সরকার

আহমদ রফিক সত্যনিষ্ঠ ও তত্ত্বনিষ্ঠ

আহমদ রফিকের প্রথম প্রকাশিত পুস্তক ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন’ (১৯৫৮) প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার হাতে এসে পড়ে। পুস্তকটি আমার চিন্তাকে ভীষণ নাড়া দেয়। বলতে গেলে বইটি পড়েই আমি মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিচার করার প্রেরণা লাভ করি।

১৯৬৭ সালে আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম-  ‘পাকিস্তানোত্তর পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা উপন্যাসের ধারা’। প্রবন্ধটির জন্য আমি বাংলা একাডেমি থেকে ‘ডক্টর এনামুল স্বর্ণপদক’ পাই। পাকিস্তানোত্তর কালের প্রথম দশকের উপন্যাসগুলো আলোচনা করতে গিয়ে আমি মূলত আহমদ রফিকের ভাবনা-ধারাতেই নিজেকে স্নাত করে নিয়েছি। সে সময়কার উপন্যাস সম্পর্কে আহমদ রফিক লিখেছিলেন- ‘গত আট-নয় বছরে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তার মহৎ সুপ্রকাশ শিল্পক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়নি। এ ক’বছরের শিল্পচর্চার ফলশ্রুতিতে আমরা যা পেয়েছি তার প্রধান অংশই ছোটগল্পের অন্তর্গত। কবিতার ক্ষেত্রে কিছু সুফল জন্মালেও উপন্যাস, প্রবন্ধ-সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমাদের সাহিত্য-প্রচেষ্টা নীচুস্তরেই রয়ে গেছে। যে বিপুল জীবন-সন্ধানী অভিজ্ঞতা ও নৈপুণ্য-নিয়ামক প্রজ্ঞা উপন্যাস-সৃষ্টির সহায়ক, বোধহয় তার অভাবই এর কারণ। অবশ্য কিছু কিছু প্রচেষ্টা যে হয়নি এমন কথাও বলছিনে। তবু স্বীকার করতে হয় তাদের অধিকাংশই অপূর্ণাঙ্গ। জীবন-রঙের বিচিত্র রূপ ফুটিয়ে তোলার কৃতিত্বে অসার্থক।’ মাত্র কয়েকটি বাক্যের আধারে সে সময়কার সাহিত্যের অত্যন্ত সার্থক মূল্যায়ন করেছেন তিনি। সে সময়ে আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সাহিত্য রসিকদের দ্বারা বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষিত ও অভিনন্দিত হয়েছিল। উপন্যাসটির নির্মোহ মূল্যায়ন করে আহমদ রফিক লিখেছিলেন-  ‘এ উপন্যাসে সৃষ্টির আয়োজন যতখানি, আচরণ সে তুলনায় অনেক নিষ্প্রভ। ঘটনাগতি বহিরঙ্গে যে পরিমাণে গতিশীল, চরিত্রানুগ অন্তরক্রিয়ায় ততখানি গভীর ও নিবিড় নয় বলেই উপন্যাসীয় গুণ অনেকাংশে ব্যাহত ও ব্যর্থ হয়েছে।’

বক্তব্যটি খুবই কড়া বটে, কিন্তু যথাযথ সত্যের ধারক। আহমদ রফিক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টি দিয়ে সব কিছুর বিচার-বিশ্লেষণ করেন বলে কোনো বিষয়েই একদেশদর্শী হন না। আমার তো মনে হয়, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনকে সঠিকভাবে অধিগত করতে পেরেছেন বলেই সব বিষয়ের ভিতরকার বৈপরীত্যসমেত সব কিছুই তার নজরে পড়ে। বলতে পারি, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদই তার জীবনদর্শন। এবং সেই জীবনদর্শনের ঘনিষ্ঠ অনুসারীরূপেই তিনি ‘স্কুলজীবন থেকে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং পঞ্চাশের দশকের শেষাবধি বাম রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন।’

এরপর তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখুন আর না-ই রাখুন, তার সমস্ত চিত্তপটজুড়ে জড়িয়ে আছে বাম রাজনীতির যে অন্তঃসার, সেই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন থেকে নিজেকে বিয়োজিত করেননি কোনো ক্ষেত্রেই কোনো দিক থেকেই। ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজেই তিনি জানিয়েছেন- ‘...এক বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সাল নাগাদ এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয় সার্বক্ষণিক দলীয় রাজনীতি, না সাহিত্যকর্ম? আমি শেষোক্তটিই বেছে নিই, অনেক চিন্তা-ভাবনায় ব্যক্তিমানসের প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য বিচারে। দলীয় রাজনীতি থেকে সরে এলেও মার্কসবাদের মননশীল চর্চা ঠিকই ধরে রাখি, যে জন্য আমার সাহিত্যকর্মে রাজনীতির প্রাধান্য এখনো অব্যাহত ও অক্ষুণ্ন।’

‘ব্যক্তিমানসের প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য বিচারে’ তার পারঙ্গমতাও তিনি অর্জন করেছেন ‘মার্কসবাদের মননশীল চর্চা’ তথা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের ধারকরূপেই। ওই দর্শনই তাকে নিজেকে চিনতেও শিখিয়েছে। ‘আত্মানং বিদ্ধি’ বা নিজেকে জানো- এমন অনুজ্ঞা সুপ্রাচীনকাল থেকেই জারি থাকলেও নিজেকে জানতে গিয়ে মানুষ বারবারই নানা খানাখন্দে আটকে পড়েছে, নিজেকে জানার পথ হারিয়ে অপথে-কুপথে চলে গেছে। আর তেমনটি করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে সে সময়কার সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল শক্তি। সেই শক্তির হাতেই তৈরি হয়েছে নানা ধরনের অপদর্শন। সেই সব অপদর্শনই অধিকাংশ মানুষকে ঘুরিয়েছে ‘চোখ বাঁধা বলদের মতো’। কিন্তু যারা সঠিক দর্শনের বাতিটি হাতে পেয়ে গেছেন, এবং তার আলোকে আত্ম-অবলোকন করতে পেরেছেন, কোনো অপশক্তিই তাদের অপথে-কুপথে নিয়ে যেতে পারেনি। পারেনি আহমদ রফিককেও।

তবে এ প্রসঙ্গে না বলে পারছি না যে, মার্কসবাদী নামে-পরিচিত অনেক মানুষ মুখে ডায়ালেকটিকস বা দ্বান্দ্বিকতার কথা বললেও চিন্তার পদ্ধতিতে তারা দ্বান্দ্বিকতার বদলে যান্ত্রিকতারই অনুশীলন করে চলেন, এবং কেউ কেউ অর্থনীতিকেই সর্বসাধ্যসার বলে ধরে নেন, মার্কসবাদকে ‘অর্থনৈতিক নির্দেশ্যবাদে’ (ইকোনমিক ডিটারমিনিজম) পরিণত করে ফেলেন। ভুলে যান যে : ‘অর্থনীতিই সমাজের নিয়ামক শক্তি’- মার্কস, এঙ্গেলস বা লেনিন কেউই এমন কথা বলেননি। তবু আত্মসমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ফ্রেডারিক এঙ্গেলস লিখেছিলেন- ‘তরুণরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিকটির প্রতি যে প্রয়োজনাতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করেছে তার জন্য আংশিকভাবে মার্কস ও আমিই দায়ী।’ আত্মসমালোচনাকে আরও প্রসারিত করে কিছু কথা বলে এঙ্গেলস জানিয়েছিলেন- ‘অর্থনৈতিক অবস্থাটা নিশ্চয়ই ভিত্তি; কিন্তু উপরিতলার বিভিন্ন বিষয় যেমন শ্রেণিসংগ্রামের রাজনৈতিক রূপ, তার ফল, সকল যুদ্ধের পর জয়ী শ্রেণি যে সংবিধান প্রস্তুত করে সেই সংবিধান ইত্যাদি; আইনের নানা রূপ এবং এমনকি যোদ্ধাদের মস্তিষ্কে সংগ্রামের নানা রিফ্লেকস; রাজনৈতিক, আইনগত, দার্শনিক নানা তত্ত্ব, ধর্মীয় ধ্যানধারণা, কুসংস্কার-এ সবই বহু ক্ষেত্রেই ইতিহাসের সংগ্রামের ধারার ওপর প্রভাব ফেলে এবং তাদের আকার ও গতি নির্ধারণ করে।’

এঙ্গেলস কথিত ‘উপরিতলার বিভিন্ন বিষয়’-এর প্রতি সাধারণ মার্কসবাদীরা খুব একটা নজর দেন না, এবং এ কারণেই প্রায়শ তারা যান্ত্রিকতার ফাঁদে আটকা পড়ে থাকেন, সার্বক্ষণিক দলীয় রাজনীতির বাইরে অন্য কোনো ক্ষেত্রে বিচরণের চিন্তা তাদের মাথায় আসে না। এখানেই তাদের সঙ্গে আহমদ রফিকের স্পষ্ট পার্থক্য চিহ্নিত হয়ে আছে। সেই পার্থক্যের দরুনই তিনি যথাযথ আত্মসমালোচনায় প্রবৃত্ত হয়ে নিজের পথটি চিনে নিতে পারেন, এবং পারেন ‘দলীয় রাজনীতি থেকে সরে’ এসেও ‘মার্কসবাদের মননশীল চর্চা’ অব্যাহত রাখতে। সেই চর্চার সূত্রেই, জীবনের ফেলে-আসা দিনগুলোতে যেসব কর্মকান্ডের সঙ্গে নিজেকে সক্রিয়তার সঙ্গে যুক্ত রেখেছিলেন সেসবের বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহ বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হন। বিশেষ করে ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সংযুক্তির কথা তো সর্বজনবিদিত। সেই সংযুক্তিজনিত অভিজ্ঞতাকে তিনি যেভাবে সবার সামনে তুলে ধরেছেন তাতে তার বস্তুনিষ্ঠার পরিচয় যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনই বিধৃত হয়েছে ঘটমান বাস্তবের ভেতরকার নানামুখী দ্বন্দ্ব এবং সেসবের ফলে উপজাত শক্তিমত্তা ও দুর্বলতার নানা বিষয়ও। এ বিষয়ে আরও বলতে পারি : ঘটনাকে তিনি রটনা থেকে উদ্ধার করে এনেছেন। তত্ত্বের সত্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে তথ্যনিষ্ঠ না হলে চলে না, তথ্যকে ভ্রান্তিবিলাসের কবলমুক্ত করার জন্য সদাসতর্ক থাকতে হয়-তত্ত্ববিদ আহমদ রফিক মুহূর্তের জন্যও এ সত্য বিস্মৃত হন না। সে কারণেই তিনি ইতিহাস-পঠন ও ইতিহাস-লিখন- উভয় ক্ষেত্রেই সশ্রদ্ধ ভাবালুতা ও সংকীর্ণ একদেশদর্শিতা থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছেন।

ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে নিজের সংযুক্তির ইতিহাস নিজেই তিনি লিখেছেন, অন্যদের লেখা ইতিহাসও গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে পাঠ করেছেন। এমনটি করতে গিয়ে সামান্যতম মানস প্রতিবন্ধেও তিনি আক্রান্ত হননি। মতামত প্রকাশে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্বকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। তবে বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রতি পক্ষপাতিত্ব কোনো অবস্থাতেই ত্যাগ করেননি, সেই পক্ষপাতিত্বকে ধরে রাখতে ‘নিঃসঙ্গ’ হয়ে যেতেও দ্বিধা করেননি। সাময়িকপত্রে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে (‘কালের খেয়া’ ১৪ জুলাই, ২০১৭) তিনি তো স্পষ্টভাষাতেই বলে ফেলেন- ‘নিঃসঙ্গতা আমার প্রিয়’। আরও বলেন- ‘শৈশব-কৈশোরে আমার বন্ধু কম ছিল’ এবং ‘আমার প্রকৃত বন্ধু নেই বললেই চলে। তবে কিছু ঘনিষ্ঠ মুখ আছে।’ তার এই বক্তব্য থেকে যদি আমরা ধরে নিই যে, তিনি একান্তভাবেই ‘আত্মকেন্দ্রিক’, তা হলে কিন্তু খুবই ভুল করা হবে। বুদ্ধিকে সদাজাগ্রত রেখে যারা মৌলিক চিন্তার অধিকারী হন, তেমন মনীষীদের অনেকেই অনেক সময় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও নিঃসঙ্গতাবোধে আবিষ্ট হয়ে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে জানিয়েছিলেন, ‘নিজেকে বড় একলা বোধ হয়।’ তবু বলাই বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ নিঃসঙ্গতার বৃত্তাবদ্ধ হয়ে থাকেননি, ‘আপন হতে বাহির হয়ে’ বাইরে দাঁড়িয়েই তিনি ‘আপন মাঝে বিশ্বলোকের সাড়া’ পেয়েছেন, ‘জীবনে জীবন যোগ’ করেছেন, বিশ্ব মানুষের কবি হয়েছেন।

বিশেষ কারণে বিশেষ পরিস্থিতিতে নিঃসঙ্গতা হয়তো আহমদ রফিকেরও ‘প্রিয়’ হয়েছে। কিন্তু সেই নিঃসঙ্গতা যদি তিনি পরিহার না করতেন, তবে আমরা কেউই তার সঙ্গ পেয়ে ধন্য হতে পারতাম না। মানুষকে যে তিনি কেবল তার লেখার মাধ্যমেই আত্মিক সঙ্গ দেন, তা নয়। ব্যক্তি আহমদ রফিকের সঙ্গ পেয়েও কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারে না। তবু এতসব কিছুর পরও বহুজন-প্রিয় হয়েও এবং বহুজনের সান্নিধ্যে থেকেও আহমদ রফিক অন্তরের গভীরে একেবারেই নিঃসঙ্গ এবং নিঃসঙ্গতা তার প্রিয়। কী করে এমনটি হয়?

উত্তরে বলতেই হবে : এমনটি হয় তার কঠিন কঠোর সত্যনিষ্ঠার জন্য। সর্বক্ষণ সর্বজনের প্রিয় হয়ে থাকতে গেলে সত্যের প্রতি নিষ্ঠাকে পুরোপুরি ধরে রাখা যায় না, সত্যকে কোনো না কোনোভাবে খর্ব করেই প্রিয় হয়ে থাকার পথে চলতে হয়। সে পথে চলতে রাজি না হয়েই সত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার চিঠিতে লিখেছিলেনÑ‘আমার পৃথিবীর মেয়াদ সংকীর্ণ হয়ে এসেছে; অতএব আমাকে সত্য হবার চেষ্টা করতে হবে, প্রিয় হবার নয়।’ পরম রবীন্দ্রানুরাগী আহমদ রফিকও সত্যের ঘনিষ্ঠ সাধকরূপেই অনেকের কাছে ‘অপ্রিয়’ হওয়ার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে লিখিত বইগুলোতে তার সত্যনিষ্ঠার প্রোজ্জ্বল পরিচয়ের পাশাপাশি ‘প্রিয়’ না থাকার নানাবিধ উপাদানও ছড়িয়ে রেখেছেন।

আমি এখানে আবদুল মতিনের (যিনি ‘ভাষা-মতিন’ নামে খ্যাত) সহযোগিতায় লিখিত তাঁর ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য বইটির প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এই বইয়ের পঞ্চম মুদ্রণ হয়েছে ২০১৭-এর ফেব্রুয়ারি। এতেই বোঝা যায় যে, বইটি বিপুলভাবে পাঠকনন্দিত। বইটির তৃতীয় সংস্করণের (ফেব্রুয়ারি ২০০৫) ভূমিকায় লেখা হয়েছে-  ‘...বইটার এপাশ-ওপাশ উল্টাতে গিয়ে আবারও দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে আমাদের জাতীয় জীবনের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভাষাবিষয়ক গণআন্দোলনের ইতিহাস এখনো নতুনদের লেখায় এবং পুরনোদের স্মৃতিচারণে যথেচ্ছ ভুলভ্রান্তির সম্মুখীন, এমনকি ২০০৪ সালে পৌঁছেও। কোথাও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, কোথাও স্মৃতিবিভ্রম এর কারণ। বিগত সালের ফেব্রুয়ারিতেও ‘প্রথম আলো’ বা ‘জনকণ্ঠে’র মতো পাঠকপ্রিয় একাধিক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধে বা প্রতিবেদনে যথেষ্ট তথ্যবিকৃতি চোখে পড়েছে। স্বভাবতই বর্তমান সংস্করণে স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে ওসব ঐতিহাসিক বিভ্রান্তি সংশোধনের অপ্রিয় উদ্যোগ নিতে হয়েছে। তথ্যশুদ্ধির জের হিসেবে কারো কারো চোখে অপ্রিয় হওয়ার আশঙ্কা মনে রেখেই ওই কাজে হাত দেওয়া।

এক্ষেত্রে আমরা নিরুপায়, এজন্য যে ভুল তথ্যসংবলিত বই সংখ্যায় বেশি না হলেও সেগুলো পাঠকের সামনে একুশের ভুল ইতিহাসই তুলে ধরবে যা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। তাই সাধ্যমতো ইতিহাসের জঞ্জাল সাফ করার অপ্রিয় দায় এড়িয়ে চলা সম্ভব হয়নি। আশা ছিল পাঁচ দশক পরে একুশের ইতিহাস নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে না, কিন্তু বৃথা সে প্রত্যাশা।

ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য বইটির নামকরণেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আহমদ রফিক শুধু প্রকৃত সত্য উদ্ধারের জন্য ‘ইতিহাসের জঞ্জাল সাফ করার অপ্রিয় দায় এড়িয়ে’ না যাওয়ার কাজেই নিজেকে ব্যাপৃত করেননি, ইতিহাসের প্রকৃত তাৎপর্য উদঘাটনেও ব্রতী হয়েছেন। ডায়ালেকটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গির দরুনই সব কিছুর ইতি-নেতি তার নজরে পড়ে। তাই তিনি লিখেছেন-

‘প্রতিটি আন্দোলনেরই কমবেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল থাকে, যেখানে সাফল্য ও ব্যর্থতার কিছু না কিছু পরিচয় ধরা পড়ে। আটচল্লিশি আন্দোলনের ব্যর্থতার পাশাপাশি কিছু ইতিবাচক ফলাফলও তাই লক্ষ্য করা যায়। জিন্নাহর সফর শেষে অনুষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ আইনসভার বাজেট অধিবেশনে কয়েকজন মন্ত্রী (হাবীবুল্লাহ বাহার, মোহাম্মদ আফজল, হাসান আলী) বাংলায় বক্তৃতা করেন।

শুধু তা-ই নয়, ৬ এপ্রিলের (১৯৪৮) অধিবেশনে পূর্ববঙ্গে ‘যথাশীঘ্র সম্ভব’ ইংরেজির স্থলে বাংলাকে সরকারি ভাষা এবং শিক্ষার বাহনরূপে ‘যথাসম্ভব’ বাংলাকে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখানে ‘যথাশীঘ্র সম্ভব’ কথাগুলোর তাৎপর্য লক্ষ্য করার মতো। কিন্তু যাই হোক, আন্দোলনের মূল দাবি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে একটি শব্দও উচ্চারিত হয় না। এমনকি এ বিষয়ে কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনীত বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব লীগ সদস্যদের একাট্টা বিরোধিতায় বাতিল হয়ে যায়। তথাকথিত বাংলা-অনুরাগী হাবীবুল্লাহ বাহার এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মন্ত্রী ও সদস্যগণও এই সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। মনে হয়, অবাঙালি শাসকদের ভয় এদের এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, সত্য ভাষণের সৎসাহসও এদের অবিশষ্ট ছিল না।...’

ভাষা-আন্দোলন নিয়ে লেখা তার অন্য বইগুলোতেও (যেমনÑএকুশের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ও কিছু জিজ্ঞাসা, ভাষা আন্দোলন, ইতিহাস ও উত্তরপ্রভাব, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষার লড়াই) ‘জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী’ হতে পারার মতো ‘ভুল ইতিহাসের’ বিরোধিতা করে বহু নামজাদা মানুষেরই অপ্রিয় হতে হয়েছে তাকে। কম অপ্রিয় হননি দেশবিভাগ : ফিরে দেখা, বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধ কিংবা ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর মতো স্বাধীনতা সংগ্রামের বিবরণসংবলিত বইগুলো লিখেও। ভাষা-আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনাধারা একান্তই নিকট-অতীতের। নিকট-অতীতকে নিকটে থেকে অবলোকন করেও যদি ভ্রান্তির গহ্বরে পড়ে যেতে হয়, তবে দূর-অতীতের ইতিহাস তো সাগরময় ভ্রান্তিপূর্ণ হয়ে উঠবে। হয়তো এই আশঙ্কাটি বিবেচনায় নিয়েই নিকট-অতীতের ইতিহাসের ভ্রান্তিমোচনের কাজটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে হাতে নিয়েছেন আহমদ রফিক। সত্যনিষ্ঠা ও দায়িত্বচেতনা থেকেই রবীন্দ্রচর্চাতেও তাঁর মনোনিবেশ। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে প্রতিক্রিয়াশীলরা যে রবীন্দ্র-বিরোধিতা শুরু করেছিল তার বিরুদ্ধে আমরা অবশ্যই রুখে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সেটি রুখে দাঁড়ানোই মাত্র; রবীন্দ্রচর্চায় নিজেদের যেভাবে নিয়োজিত করা উচিত তা আমরা করিনি। যদি করতাম তা হলে আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন আরও জোরদার হতো, চিন্তা-চেতনাও অনেক সমৃদ্ধ হতো। আহমদ রফিক এই বিষয়টিকে সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছেন বলেই তিনি এখন পর্যন্ত যেভাবে রবীন্দ্রচর্চায় নিবিষ্ট আছেন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষকে রবীন্দ্রচর্চায় উদ্বুদ্ধ করছেন, তেমনটি এর আগে আমাদের দেশে কেউই করেননি। আমাদের এই দেশের প্রবন্ধ তথা মননশীল সাহিত্যে তার রবীন্দ্রসাহিত্য সম্পর্কিত গ্রন্থগুলো খুবই উচ্চমানসম্পন্ন।

রবীন্দ্রচর্চার পাশাপাশি নজরুল-জীবনানন্দ-বিষ্ণুদের মূল্যায়নেও তাঁর কৃতি খুবই উজ্জ্বল। তাঁর উজ্জ্বলতার ব্যাপ্তি বহু বহু দিকে প্রসারিত। কবিতা গল্প উপন্যাসের মতো ‘সৃজনশীল সাহিত্য’ও তাঁর হাতের ছোঁয়ায় প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে যদিও, তবু বলতেই হবে, মূলত তিনি প্রাবন্ধিক তথা ‘মননশীল সাহিত্যসাধক’। এ বছর ২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ছিল আহমদ রফিকের ৯১তম জন্মদিন। শততম জন্মদিন অতিক্রম করেও সৃজনশীলতা ও মননশীলতার আলোর প্রক্ষেপণ ঘটাতে থাকুন তিনি। সে আলোতে আমরা আলোকিত হতে থাকব প্রতিনিয়ত।

সর্বশেষ খবর