শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নজরুল-সত্তার রূপান্তর

রশিদুন নবী

নজরুল-সত্তার রূপান্তর

এক.

যাদের বৈপ্লবিক অবদানে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের ভুবন ঋদ্ধ হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তাদের মধ্যে অন্যতম। অবিভক্ত ভারতবর্ষের সব জাতিসত্তার ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে কেবল লেখনী নয়, সমগ্র জীবনকেই উৎসর্গ করেন তিনি। ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য’ নিয়ে আবির্ভূত নজরুলের জীবৎকাল ৭৭ বছর - ১৮৯৯ থেকে ১৯৭৬। ১৯৪২ সালে বাকশূন্য হয়ে যান কবি। মূলত তার সৃষ্টিকর্মের কাল ছিল ১৯১৯ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে। তবে ১৯১৯ সালের আগেও তার অবশ্য একটি প্রস্তুতিপর্ব গেছে - যখন তিনি লেটোগানের দলে ছিলেন। ওই সম্প্রকাশিত ২৪ বছরে নজরুল কি-না করেছেন, যেন এক অগ্নিপ্রবাহ বয়ে গেছে তার জীবনে ও সৃজনকর্মে : কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, সাংবাদিকতা, সম্পাদনা, পার্টিসংগঠন : কত কিছুর সঙ্গেই-না জড়িয়েছেন নিজেকে। সাহিত্য ও সংগীতের প্রায় সর্বাঞ্চলে তার দৃপ্ত পদচারণা। তার বহুমাত্রিক প্রতিভার স্পর্শে বাংলা সাহিত্য-সংগীতে যুক্ত করেছেন আপন মাত্রা।

কাজী নজরুল ইসলাম মানব মনে সুন্দরের বোধন ঘটাতে চেয়েছিলেন। সুন্দরের সাধনা নজরুলকে তাড়িত করেছে সব সময়। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত মানবসমাজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলবে মানবিক রাষ্ট্র-এটাই ছিল তার সৃষ্টির ব্রত। জীবনের প্রথমভাগে সৈনিক নজরুল অন্ধকারে পড়ে থাকা জাতিকে আলোয় দ্বীপ্তিময় করে তুলতে রাজ করে বেড়িয়েছেন সাহিত্য এবং রাজনীতির মাঠে। মন-প্রাণ উজাড় করে তিনি গেয়েছেন তরুণের জয়গান। শত বাধাকে অতিক্রম করার সাহস ও সামর্থ্য তিনি দেখিয়েছেন তার কর্মের মাধ্যমে। তার প্রতিবাদী চেতনা তাকে শত্রুরূপে দাঁড় করিয়েছিল শোষক ব্রিটিশ সরকারের কাছে। যে অগ্নিবীণার মশাল কাব্যে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল সারা বাংলায়, সে মশালে আলোকিত হলো ভিন্ন পথ। নজরুল বাঙালিকে সংগীতের উন্মাদনায় মত্ত করে তুললেন তার বহুমুখী সংগীত প্রতিভা দিয়ে। সেই সঙ্গে নিজেও হয়ে উঠলেন সংগীতে বিভোর সুরের পাখি। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির প্রধানতম ধারা হলো কবিতা। এই কাব্যের নজরুল রূপান্তরিত হলেন সংগীতের নজরুলে। কাব্যের নজরুল এবং সংগীতের নজরুল কর্মপরিসর, পরিবেশ, চেতনা-সব কিছুতেই ভিন্ন ভিন্ন সত্তায় প্রতিষ্ঠিত হন। তার কর্মজীবনকে দুভাগে ভাগ করলে দেখা যায়, এক ভাগের নজরুল অন্য ভাগের নজরুল থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। কাব্যের নজরুল ছিলেন মানবতাবাদী নজরুল, বিদ্রোহী নজরুল, সমাজ সংস্কারক নজরুল, রাজনীতিক নজরুল, ব্রিটিশবিরোধী নজরুল, সাহিত্য আড্ডার চঞ্চল নজরুল, প্রেমিক নজরুল-সেই নজরুলকেই আমরা জানি। ‘নজরুল’ নাম উচ্চারিত হলে আমাদের চিন্তায় এই নজরুলই ভেসে আসে। এই প্রবন্ধে নজরুলের এমন এক নতুন রূপ উন্মোচিত হবে, যে রূপ প্রথম জীবনের কাব্যের নজরুল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক নজরুল অর্থাৎ আমাদের চিরচেনা নজরুলের বাইরে থাকা নতুন এক নজরুল।

দুই.

নজরুলের সৃষ্টির পথচলা শুরু হয় ছোটগল্প রচনার মধ্য দিয়ে। সৈনিক নজরুল করাচি থেকে তার ছোটগল্প লিখে পাঠানো শুরু করেন কলকাতার কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায়। তার কাব্য রচনাও শুরু হয় সে সময় থেকেই। এ প্রসঙ্গে তিনি তার ‘আমার সুন্দর’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন : ‘আমার সুন্দর প্রথম এলেন ছোটগল্প হয়ে, তারপর এলেন কবিতা হয়ে। তারপর এলেন গান, সুর, ছন্দ ও ভাব হয়ে। উপন্যাস, নাটক, লেখা (গদ্য) হয়েও মাঝে মাঝে এসেছিলেন।’

যে সুন্দরের সাধনা নজরুল করেছেন তা বাঙালির জীবনে ঘটিয়েছে নবজাগরণ। বাংলা কাব্যের ইতিহাসে নজরুল দান করলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এই কবিতা হয়ে উঠল নজরুলের কাব্যসত্তার পরিচায়ক। রচনার শুরু থেকেই নজরুল-কাব্যের অন্যতম বিষয় ছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। তিনি তার সাহিত্য রচনায় যেমন ভারতের মুক্তি চেয়েছেন, তেমনি জীবনের কর্মধারাকেও সে পথে পরিচালিত করেছেন। ১৯২২ সালে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার অভিষেক থেকে তিনি সরাসরি ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়েছেন এ পত্রিকার মাধ্যমে। তার ক্ষুরধার লেখনীতে ব্রিটিশ সরকার বার বার আক্রান্ত হয়েছে বলেই একের পর এক গ্রন্থ ও পত্রিকা বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’, ‘নওরোজ’, ‘দৈনিক সেবক’ প্রভৃতি কোনো পত্রিকাতেই নজরুল নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেননি। পত্রিকাগুলোর সঙ্গে নজরুল নানাভাবে যুক্ত থাকায় তা প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষেত্র বিশেষে বাজেয়াপ্ত হয়েছে পত্রিকার সংখ্যা, অর্থ কিংবা নির্দিষ্ট কোনো লেখা। তিনি ১৯২০ সালে মাত্র ২১ বছর বয়স থেকেই সাংবাদিকতায় যুক্ত হন নবযুগ পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯২৭ সালে সওগাত পত্রিকায় যুক্ত হয়ে কিছুদিন কাজ করার পর তার সাংবাদিক জীবনের অবসান ঘটে। ধূমকেতু পত্রিকার দ্বাদশ সংখ্যায় প্রকাশিত আনন্দময়ীর আগমনে কবিতা রচনার জন্য তিনি রাজরোষে পড়েন। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় এবং ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর তিনি কুমিল্লায় গ্রেফতার হন। এক বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দ-িত হওয়ায় তাকে জেল খাটতে হয়। তিনি কবি জীবনে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতেও। ১৯২৫ সালে তিনি ‘শ্রমিক স্বরাজ পার্টি’তে যোগ দেন। রাজনৈতিক কাজে তিনি বাংলার নানা প্রান্তে গমন করেন। বক্তৃতা ও গান করেন বিভিন্ন সম্মেলনে। জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন বাংলার ঘুমন্ত মানুষকে। ১৯২৫ সালে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন নজরুল। ১৯২৬ সালে কেন্দ্রীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচনে স্বরাজ দলের হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং পরাজিত হন। নজরুল জীবনের বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, আন্দোলন-সংগ্রাম সমস্ত কিছুই ঘটে তার কাব্যসৃষ্টির জীবনে।

-উপর্যুক্ত আলোচনায় নজরুলের যে দিকটি তার পরিচয় হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে সে পরিচয়টি কমবেশি ১৯২৮ সালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিছু কিছু ঘটনা ১৯৩০ সাল পর্যন্ত গড়ালেও তার প্রেক্ষাপট ১৯২৮ সালের পূর্বেই সূচিত। ১৯২৮ সালের মধ্যে তিনি রচনা করেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি ছাড়াও শত শত কবিতা। এ সময়ে কবিতার পাশাপাশি তিনি স্বল্পসংখ্যক সংগীতও রচনা করেন। একের পর এক বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হতে থাকে এবং কিছু কিছু কাব্যগ্রন্থে স্বল্পসংখ্যক গানও সংকলিত হয়। ১৯২৮ সাল এবং তার পূর্ববর্তী সময়ে নজরুল-জীবন নানা ঘটনায় বর্ণাঢ্য হয়ে ওঠে আর বাংলার মানুষ চিনে নেয় বিদ্রোহী নজরুলকে। ১৯২৮ সালে নজরুলের প্রথম গানের সংকলন-গ্রন্থ বুলবুল প্রকাশিত হয়। একই বছর তিনি বেতার এবং গ্রামোফোন কোম্পানিতে যুক্ত হন। উল্লেখ্য, গানের জগতে নজরুল ১৯২৮ সাল থেকেই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হন। তাই ১৯২৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত নজরুল-জীবনের প্রথম ভাগ কিংবা প্রথম দিক কিংবা কাব্যের নজরুলকে আমরা আমাদের সামনে পাই। অপরদিকে ১৯২৮ সালের পরে আমরা দেখতে পাই সুরের নজরুল, গানের নজরুল বা সংগীতের নজরুলকে-যা নজরুল জীবনের দ্বিতীয় ভাগ অথবা দ্বিতীয় সত্তার নজরুল।

সংগীত জীবনের নজরুল সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে নির্বিঘ্নে রচনা করে গেছেন হাজার হাজার গান। নজরুল ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সর্বাধিক সংখ্যক নজরুল সংগীতের সংকলন নজরুল সংগীত সংগ্রহ শীর্ষক গ্রন্থে ৩,১৭৩টি গান সংকলিত হয়েছে-যা বাংলা সংগীতের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। কেননা এত অধিক সংখ্যক গান আর কোনো কবি রচনা করেননি। কেবল সংখ্যার বিচারে নয়, বিষয়-বৈচিত্র্য, নান্দনিকতা ও উৎকর্ষের ক্ষেত্রে নতুন স্বাদ, নতুন দ্যোতনা ও অশ্রুতপূর্ব মাত্রা তিনি যোগ করেছেন। এই জীবনে নজরুল কবিতার নন, বিদ্রোহের নন, রাজনীতির নন, জেলবন্দিও নন। এ জীবনে নজরুল একান্তই সুরের, সংগীতের, সংগীত সম্পৃক্ত নাটক-চলচ্চিত্র-গ্রামোফোন-বেতারের। সংগীতাঙ্গনে তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, সংগীত পরিচালক, সংগীত প্রশিক্ষক, স্বরলিপিকার, সংগীত গবেষক এবং রাগ ও তালের স্রষ্টা। তিনি নিজেই তার এ জীবনের কথা স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করেছেন। নিজের এই নতুন এবং ভিন্ন সত্তার পরিচয় তিনি দিয়ে গেছেন নানা অভিভাষণে এবং রচনায়। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৭ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীতে প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণে বলেন : ‘আমি বর্তমানে সাহিত্যের সেবা থেকে, দেশের সেবা থেকে, কওমের খিদমতগারি থেকে অবসর গ্রহণ করে সংগীতের প্রশান্ত সাগর-দ্বীপে স্বেচ্ছায় নির্বাসন-দ- গ্রহণ করেছি। সেই সাথিহীন নির্জন দ্বীপ ঘিরে দিবারাত্রি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটানা জলকল্লোল-সংগীত; আর সেই শব্দায়মান সুর-ঊর্মির মুখরতার মাঝে বসে আছি বন্ধুহীন-একা।’

এই উক্তির মাধ্যমেই নজরুল-জীবনের দ্বিতীয় সত্তা অর্থাৎ সংগীতের নজরুলকে আবিষ্কার করা যায়। যে নজরুল কবি জীবনের প্রথম ভাগে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নিজেকে বিদ্রোহী বলে ঘোষণা করেছেন, নিজের বিদ্রোহী পরিচয় আকাশ-পাতালময় ছড়িয়ে দিয়েছেন, সে নজরুল সংগীত জীবনে নিমজ্জিত হওয়ার প্রথম দিকে অর্থাৎ ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর সমগ্র বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে সংবর্ধনা গ্রহণকালে বলেন : ‘আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ।’

খোদার আসন-আরশ ছেদ করার কিংবা ভগবান বুকে পদচিহ্ন একে দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে যে নজরুল সাধারণ মানব থেকে উঠে এসেছিলেন অনন্য উচ্চতায় এবং ভিন্ন আসনে সে নজরুল সুরের টানে চলে গেলেন প্রিয়ার হৃদয়ে, প্রকৃতির কোলে কিংবা পরমেশ্বরের শক্তির ছায়াতলে। তিনি গেয়ে উঠলেন : ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মোর অপরাধ!’ কিংবা ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী’ কিংবা ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে’।

১৯২৮ সালে বুলবুল গীতিসংকলন প্রকাশের মাধ্যমে যে নতুন সত্তার নজরুল পথ চলা শুরু করেন সে নজরুলের লেখনীতে প্রকাশ পেতে থাকে একের পর এক গীতি-গ্রন্থ ও স্বরলিপি-গ্রন্থ। এ পর্বে প্রকাশিত হয় দশটি গীতি-গ্রন্থ এবং এসব গীতি-গ্রন্থে প্রকাশিত গানের সংখ্যা ৭৭৫৪।

এ-ছাড়া নজরুল-স্বরলিপি (১৯৩১), সুর-লিপি (১৯৩৪) ও সুর-মুকুর (১৯৩৪) - এই তিনটি স্বরলিপি-গ্রন্থে মোট ৯৪টি গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, নজরুল-স্বরলিপি গ্রন্থের স্বরলিপিকার নজরুল নিজেই। অবশিষ্ট দুটি স্বরলিপি-গ্রন্থের স্বরলিপিকার হলেন যথাক্রমে নজরলের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর জগৎ ঘটক ও নলিনীকান্ত সরকার। ১৯২৮ সাল থেকে কলকাতা বেতার ও এইচএমভিসহ ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হওয়া, ১৯২৯ সালে মঞ্চনাটকের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, ১৯৩১ সালে ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেড-এর ‘সুরভা ারি’ হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি সমস্ত কার্যক্রম নজরুলের সংগীত জীবনকে কেন্দ্র করেই প্রবাহিত হয়। উল্লেখ্য যে, হিন্দুস্থান, মেগাফোন, সেনোলা, কলম্বিয়া, পাইওনিয়ার, রিগ্যাল, ভিয়েলোফান, ফোন ও ফোন ইত্যাদি গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নানা দায়িত্বও পালন করেন তিনি। এই সময়ে তার প্রায় ১৭০০ গান বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে গীত হয়ে উক্ত গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো থেকে প্রকাশিত হয় এবং এর শীর্ষ ভাগ গানের সুরস্রষ্টা ছিলেন তিনি নিজেই। ১৯৩৩ সালে পাওনিয়ার কোম্পানির ‘ফিল্ম ডিরেক্টর’ হিসেবে যুক্ত হয়ে তিনি একাধারে চিত্র পরিচালক, সংগীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা সব ক্ষেত্রেই ঈর্ষণীয় অবদান রাখতে সমর্থ হন। তিনি এ জীবনে ভারতীয় প্রথম সবাক চিত্র ‘জলসা’ (১৯৩১), ‘ধ্রুব’ (১৯৩৪), ‘পাতালপুরী’ (১৯৩৫), ‘গ্রহের ফের’ (১৯৩৭), ‘বিদ্যাপতি’ (১৯৩৮), ‘বিদ্যাপতি’- হিন্দি (১৯৩৮), ‘গোরা’ (১৯৩৮), ‘সাপুড়ে’ (১৯৩৯), ‘সাপেড়া’- হিন্দি (১৯৩৯), ‘নন্দিনী’ (১৯৪১), ‘চৌরঙ্গী’- হিন্দি (১৯৪২), ‘চৌরঙ্গী’ (১৯৪২) প্রভৃতি চলচ্চিত্রে গান রচনা ছাড়াও বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।

নিজের রচিত নাটক ‘আলেয়া’, ‘মধুমালা’ ও শান্তি সেনাদলের জন্য নজরুল মোট ৬৬টি গান রচনা করেন। অন্যদিকে তিনি ১২ জন নাট্যকারের ২২টি মঞ্চনাটকের জন্য ১২৭টি গান রচনার পাশাপাশি অপরের রচিত ২২টি গানেও সুরারোপ করেন। সংগীত জগতের নজরুল কলকাতায় ‘কলগীতি’ নামে গ্রামোফোন যন্ত্র এবং গ্রামোফোন রেকর্ডের দোকান স্থাপন করেন ১৯৩৪ সালে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা টেকেনি। সংগীতে নিমগ্ন নজরুল ১৯৩৮ সালে সরাসরি নিযুক্ত হন কলকাতা বেতারে। মগ্ন হন সংগীত বিষয়ক গবেষণায়। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে তিনি হারিয়ে যাওয়া ত্রিশের অধিক রাগ পুনরুদ্ধার করে ‘হারামণি’ অনুষ্ঠান, ১৭/১৮টি নতুন রাগ সৃষ্টি করে ‘নবরাগমালিকা’ অনুষ্ঠান, নিজে ছন্দ ও তাল সৃষ্টি করে এবং সংস্কৃত ছন্দের সহায়তায় ছন্দ বিষয়ক অনুষ্ঠান, গীতি-আলেখ্য ইত্যাদিসহ নানা বিষয়-ভিত্তিক গানের অনুষ্ঠান নির্মাণ করে তা বেতারে প্রচারের ব্যবস্থা করেন। বাংলার স্বনামধন্য শিল্পী, সংগীতকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার এবং এসব কাজে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করেন এই দ্বিতীয় সত্তার নজরুল। তার ১৯২৮ পূর্ববর্তী জীবন যাদের সঙ্গে অতিবাহিত হয় তাদের সঙ্গে ১৯২৮ পরবর্তী সময়ে খুব কমই দেখা যায় নজরুলকে। তিনি এ বিষয়ে ১৯৪১ সালের ১৬ মার্চ বনগাঁ সাহিত্যসভায় চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে বলেন, ‘সাহিত্যের কোনো কুঞ্জে আজ আর আমার কোনো গতিবিধি নেই।’

কবিতার নজরুল সংগীতশিল্পী হিসেবে কলকাতা আগমনের পর সুনাম অর্জন করলেও ১৯২৮ সালের আগে তার সংগীত রচনা সীমিত পর্যায়ে ছিল। আবার ১৯২৮ সাল থেকে হাজার হাজার সংগীত রচনা করলেও সংগীতের নজরুল সাহিত্য ও কাব্য রচনায় উদাসীন ছিলেন। ১৯২০ থেকে ১৯২৮ সালের মধ্যে নজরুল রচিত ও প্রকাশিত গানের সংখ্যা এবং ১৯২৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে রচিত ও প্রকাশিত কবিতার সংখ্যার সাল-ভিত্তিক দুটি সারণি উপস্থাপন করা হলে বিষয়টি আমাদের অনুধাবন করা সহজ হবে। সে বিবেচনায় বাংলা একাডেমি প্রকাশিত রফিকুল ইসলামের নজরুল নির্দেশিকা (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ, মে ২০১৩) এবং মাহবুবুল হক-এর নজরুল তারিখ অভিধান (জুন ২০১০) হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কবিজীবনে রচিত ও প্রকাশিত গান হলো ১৯২০ সালে ৬টি, ১৯২১-এ ৯টি, ১৯২২-এ ৩টি, ১৯২৩ ও ১৯২৪-এ ২টি করে, ১৯২৫-এ ৪টি, ১৯২৬-এ ১০টি, ১৯২৭-এ ২৭টি ও ১৯২৮-এ ২৪টি। অপরদিকে নজরুলের সংগীত জীবনে রচিত ও প্রকাশিত কবিতা হলো ১৯২৮ সালে ২৭টি, ১৯২৯-এ ১৩টি, ১৯৩০-এ ৯টি, ১৯৩১-এ ১১টি, ১৯৩২-এ ৩টি, ১৯৩৩-এ ৬টি, ১৯৩৪-এ ৮টি, ১৯৩৫-এ ৫টি, ১৯৩৬-এ শূন্য, ১৯৩৭-এ ৩টি, ১৯৩৮-এ ৪টি, ১৯৩৯-এ ১টি ও ১৯৪০-এ ৫টি।

উপর্যুক্ত তথ্যে গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত কবিতা ও গানের হিসাব যুক্ত করা হয়নি। তবে গ্রন্থভুক্ত যেসব গান বা কবিতা সাময়িকপত্র, গ্রামোফোন রেকর্ড কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে তা এ তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। গান ও কবিতাভিত্তিক তথ্যাদি দেখলে সহজেই বোঝা যায় যে, ভিন্ন দুই সত্তার নজরুল এক সত্তা থেকে অন্য সত্তায় কতটুকু প্রভাবমুক্ত ছিলেন। প্রথম জীবনে যে নজরুল শত শত কবিতা রচনা করেছেন তিনি কীভাবে দ্বিতীয় ভাগে এসে নিশ্চিন্তে সংগীত-সমুদ্রে অবগাহন করলেন! ১৯২৮ সালকে আমরা রূপান্তরের কেন্দ্র-সাল হিসেবে বিবেচনা করলে দেখতে পাই যে, নজরুলের কবি জীবন-বহুমুখী এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মযজ্ঞে ভরপুর। সে জীবনে সংগীত কেবল উঁকি দিয়ে গেছে। অপরদিকে সংগীতে নিমগ্ন নজরুল সাহিত্য ও কাব্যের পথ থেকে সরে গিয়ে সর্বতোভাবে সংগীতে বুঁদ হয়েছিলেন।

তিন.

সংগীত সমুদ্রে অবগাহনের প্রথমদিকে ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে নজরুল সভাপতির অভিভাষণে বলেছিলেন : ‘সুর আমার সুন্দরের জন্য’।  আর এই সুন্দরের সাধনাই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা। ‘নজরুল’ নামটি দ্রোহের যে রূপ নিয়ে আমাদের সামনে প্রতিভাত হয় সে রূপটি মূলত নজরুল-জীবনের প্রধান অধ্যায় অর্থাৎ সংগীত জীবনে অনুপস্থিত। সাহিত্যের অঙ্গন ছেড়ে তিনি সংগীতের প্রশান্ত সাগর-দ্বীপে স্বেচ্ছা নির্বাসন গ্রহণ করেন বলেই গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আপন সৃষ্টি-সম্ভার পরিমাপ করতে পেরেছিলেন। নিজের অবদানের স্বীকৃতি তিনি জ্ঞাতসারেই দিয়েছিলেন। বাংলা গানের সর্বকালীন মান ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা করতে সক্ষম ছিলেন বলেই ১৯৩৮ সালে ‘কৃষক’ পত্রিকার অফিসে জন-সাহিত্য সংসদের উদ্বোধনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন : ‘কাব্যে ও সাহিত্যে আমি কি দিয়েছি, জানি না। আমার আবেগে যা এসেছিল, তাই আমি সহজভাবে বলেছি, আমি যা অনুভব করেছি, তাই আমি বলেছি। ওতে আমার কৃত্রিমতা ছিল না। কিন্তু সংগীতে যা দিয়েছি, সে সম্বন্ধে আজ কোনো আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে, ইতিহাস লেখা হবে, তখন আমার কথা সবাই স্মরণ করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই। তবে এইটুকু মনে আছে সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি।’

উপর্যুক্ত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এ-কথা বলা যায় যে, নজরুল তার সংগীত জীবনকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে কবিতার নজরুলও সংগীতের নজরুলের চেয়ে কম মহিমান্বিত নন। প্রকৃতপক্ষে নজরুল জীবনের এই দুই সত্তার সম্মিলনে আমরা পাই আমাদের কাক্সিক্ষত সমগ্র নজরুলকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর