শুক্রবার, ৩ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

যেহেতু

ইকবাল খন্দকার

যেহেতু

এখনো কেউ গ্রেফতার হয়নি। অথচ হত্যাকান্ডের আজ সপ্তম দিন। এলাকাবাসীর ধারণা, পুলিশ টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। এরপর নবম দিনের মাথায় যখন একজন গ্রেফতার হয়, তখন অনেকেই প্রকাশ্যে বলতে থাকে-আসল খুনিকে আড়াল করার জন্য রইসুদ্দিন ডাক্তারের মতো নিরীহ একজন মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এটা অবশ্যই উপর মহলের চালবাজি। এই চালবাজি সফল হতে দেওয়া হবে না। অবশ্যই আসল খুনিকে গ্রেফতার করতে হবে।

ওসি সাহেব কারও কথা কানে তোলেন না। তিনি জোর গলায় বলতে থাকেন, রইসুদ্দিন ডাক্তারই খুন করিয়েছে ডাক্তার সাইফুল ইসলামকে। খুনের কারণ- পেশাগত দ্বন্দ্ব, হিংসা। ওসি সাহেবের কথা অনেকে অবিশ্বাস করলেও কেউ কেউ বিশ্বাস করে। কারণ, তারা রইসুদ্দিন ডাক্তারের হিংসার ব্যাপারে অবগত। ডাক্তার সাইফুল ইসলামকে তিনি সহ্যই করতে পারতেন না। গীবত তো করতেনই, গালিগালাজ পর্যন্ত করতেন।

টানা তিন দিন জিজ্ঞাসাবাদের পরও রইসুদ্দিনের মুখ থেকে কাক্সিক্ষত কোনো তথ্য বের করতে পারে না পুলিশ। তাই এলাকার বাইরে না যাওয়ার শর্তসহ বেশ কিছু শর্ত দিয়ে ছেড়ে দেয় তাকে। আর গ্রেফতার করে জহিরুলকে। কোনো ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ডাক্তার সাইফুলকে মারার সময় সঙ্গে কে কে ছিল। জহিরুল কিছু বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে পুলিশের দিকে। এতে তাদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। তাই শুরু করে জেরা।

জহিরুল ওষুধ সরবরাহকারী। পরিচিত একটা কোম্পানির ওষুধ নিয়ে এই এলাকায় আসত সে। কোনো কোনো সপ্তাহে একবার, কোনো কোনো সপ্তাহে দুবার। কিন্তু গত প্রায় এক মাস ধরে তার আসা বন্ধ ছিল। আর বন্ধ করেছিলেন ডাক্তার সাইফুল। তার অপরাধ-সে নকল ওষুধ সরবরাহ করেছে। জহিরুল অনেক অনুনয়-বিনয় করেছিল তাকে যেন ক্ষমা করে দেওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তার সাইফুল এসবে কান দেননি। এলাকায় তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করে তবেই ক্ষান্ত হয়েছিলেন।

শত চেষ্টায়ও পুলিশ কোনো কথা বের করতে পারে না জহিরুলের মুখ থেকে। এরপর গ্রেফতার করে মনিরকে। সে ডাক্তার সাইফুলের ফার্মেসির পুরনো কর্মচারী। শুরুর দিকে মনির বিশ্বস্তই ছিল। কিন্তু শেষদিকে লোভ পেয়ে বসেছিল। আর এই লোভের বশেই সে টাকা চুরি করেছিল সাইফুলের ড্রয়ার থেকে। ধরাও পড়েছিল। আর এর শাস্তিস্বরূপ সাইফুল কেড়ে নিয়েছিলেন তার চাকরিটা।

চাকরি হারিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করছিল মনির। মিশে গিয়েছিল বখাটেদের সঙ্গে। পুলিশ অনেকটাই নিশ্চিত, মনির খুনটা করেছে তাদের পাল্লায় পড়ে। পুলিশ তাই তার বন্ধুদেরও গ্রেফতার করে। পেটানোর হুমকি দেয়, জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু কোনো কথা বের করতে পারে না। পুলিশ এবার নজর দেয় ডাক্তার সাইফুলের পরিবারের দিকে। আলাদা করে কথা বলে তার মা এবং ভাইবোনদের সঙ্গে। কিন্তু সন্দেহ করার মতো কিছু পায় না।

হঠাৎ ডাক্তার সাইফুলের কিশোর ভাগ্নের মাধ্যমে পুলিশ জানতে পারে জটিল এক দ্বন্দ্বের কথা। জমিজমা সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব। যে দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল ডাক্তার সাইফুল ও তার ছোটভাই কামরুলের মধ্যে। পুলিশ থানায় নিয়ে আসে কামরুলকে। জানতে চায় কেন ভাইকে খুন করেছে। কামরুলও জানতে চায় কেন সে খুন করবে। ওসি সাহেব বলেন, আপনার ভাই যে জমিটা বিক্রি করে গরিব রোগীদের জন্য ফান্ড বানাতে চেয়েছিলেন, আপনি সেটা বিক্রি করে বিদেশ যাওয়ার তালে ছিলেন। এদিকে আপনার মাও কথা বলতেন ডাক্তার সাহেবের পক্ষ নিয়ে। ফলে আপনি দেখলেন আপনার পরাজয় হচ্ছে। তখন ঘটনা ঘটিয়ে দিলেন।

কামরুল দাবি করে, তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। তারপর কথায় কথায় প্রকাশ করে বিশেষ একজনের নাম। পুলিশ মাঠে নামে। চব্বিশ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই গ্রেফতার করে ফেলে আসাদ নামের এই সন্দেহভাজনকে। সে সাইফুলের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের বন্ধুত্ব ভাঙার কারণ-নারী। যে নারীর নাম ফারহানা। যে নারী বর্তমানে সাইফুলের সহধর্মিণী।

ফারহানাকে পছন্দ করত আসাদ। ভাসা ভাসা না, বেশ জোরালো পছন্দ। ফারহানাও পছন্দ করত বলেই ধরে নিত আসাদ। আর ভাবতো, শিগগিরই ‘ভালোবাসি’ শুনতে পাবে। অথচ শুনতে পেয়েছিল অন্যকিছু। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে তার বিয়ের হৃদয়বিদারক খবর। ওই দিনই সাইফুলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছিল আসাদ। তবে তাকে বিস্তারিত কিছু বলেনি। শুধু তার চোখে আগুনচোখ রেখে উচ্চারণ করেছিল- ‘বেইমান’। তখন পাশেই ছিল কামরুল। আসাদের চোখের আগুন দেখে সে বুঝে গিয়েছিল, তার ভাই-ভাবি শান্তিতে সংসার করতে পারবে না।

আসাদকে চড়-থাপড় দেয় পুলিশ। কিন্তু কোনো কথা বের করতে পারে না। ডেকে আনা হয় ফারহানাকে। জিজ্ঞেস করা হয় ডাক্তার সাইফুলের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন ছিল। ফারহানা পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, সম্পর্ক একদমই ভালো ছিল না। যে হাজব্যান্ডের কাছে নিজের ওয়াইফের চেয়ে, নিজের ফ্যামিলির চেয়ে গরিব-কাঙাল পেশেন্টরা বেশি ইম্পোর্টেন্স পায়, তার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকার কোনো কারণ নেই।

কথা শেষ হতে না হতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে ফারহানা। তারপর দ্রুত বেরিয়ে যায় রুম থেকে। রাত ৮টার দিকে ওসি সাহেব যখন থানা থেকে বের হন, তখন তার মোবাইল বেজে ওঠে। তিনি রিসিভ করতেই এসআই ওসমান বলতে থাকেন-স্যার, ডাক্তারের লাশটা যেখানে পড়ে ছিল, মানে চেম্বারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় আমরা একটা তাবিজ পেয়েছি। সুতাসহ তাবিজ। আমরা শিওর, খুনের সময় যে ধস্তাধস্তিটা হয়েছে, এই ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সুতাটা ছিঁড়েছে। ওসি সাহেব ধমক দেন। জানতে চান এতদিন পরে এই আলামত পাওয়া গেল কেন। কেন প্রথম দিনই পাওয়া যায়নি। এসআই বলেন, আমাদের কোনো গাফিলতি ছিল না স্যার। আসলে স্যার তাবিজটা ফ্লোরের ফাটলের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল। এই ফাটলের ওপর ছিল আবার টেবিলের পায়া। যে কারণে চোখে পড়েনি স্যার। এখন কথা হচ্ছে স্যার, আমরা মোটামুটি কনফার্ম হয়ে গেছি তাবিজটার মালিক কে। আর এই ব্যাপারে সোর্সরা সাংঘাতিক হেল্প করছে।

তাবিজের মালিককে খুঁজে পাওয়া যায়। তার নাম ইব্রাহিম। তাকে নিয়ে আসা হয় থানায়। জিজ্ঞেস করা হয় খুনটা কেন করেছে। মধ্যবয়সী ইব্রাহিম হাসতে হাসতে বলে- স্যার, কেন বুঝতেছেন না, ডাক্তার সাবের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়া একদিন তাবিজটা ফালায়া আসছিলাম। সুতা নরম হয়ে গেছিল তো! পট কইরা ছিঁড়া পইড়া গেছিল। টের পাই নাই। আর আপনেরা ধইরা নিছেন আমি বুঝি খুনের সাথে...

ইব্রাহিমকে কথা শেষ করার সুযোগ দেন না ওসি সাহেব। শুরু করেন পিটুনি। ইব্রাহিম ‘মাগো’ ‘বাবাগো’ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। ওসি সাহেবের পা ধরতে চায়। লাঠি তবু থামে না। একই ছন্দ এবং গতিতে ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইব্রাহিম স্বীকার করে সে খুনের সঙ্গে জড়িত।

ওসি সাহেব এবার নিজের চেয়ারে বসেন। একটু সময় নেন ক্লান্তি দূর করার জন্য। বোতল খুলে তিন ঢোক পানিও খান। তারপর ইব্রাহিমকে নির্দেশ দেন খুনটা কেন করেছে, কীভাবে করেছে, ঝটপট বলে ফেলার জন্য। না বললে আবার লাঠি চালানোর হুমকিও দেন। ইব্রাহিম তবু বলতে চায় না। ওসি সাহেব লাঠিটা হাতে নেন। তারপর যেই চালাতে যাবেন, অমনি ইব্রাহিম বলতে থাকে-স্যার আমি একলাই মারছি। পয়লা গলায় গামছা প্যাঁচাইছি। তারপরে চারবার ছুরি মারছি।

ওসি সাহেব চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে থাকেন ইব্রাহিমের দিকে। তার চোখে জ¦লজ¦ল করতে থাকে একশটা প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের আবেদন বুঝতে পেরে ইব্রাহিম বলে- স্যার, খুনটা করছি ইজ্জত বাঁচানির লাইগা। ইজ্জত ছাড়া গরিবের আর আছে কী? এই ইজ্জত যদি যাই যাই করে, তাইলে খুন একটা ক্যান, দশটাও কইরা ফেলা যায়। তবে ডাক্তারের কোনো দোষ ছিল না স্যার। তার কপাল খারাপ, এই জন্য মারা পড়ছে।

: আমি জানতে চাচ্ছি তাকে কেন মারা হয়েছে।

: কইলাম তো স্যার, ইজ্জত বাঁচানির লাইগা। আপনে তো মনে হয় শুনছেন স্যার, আমার একটা বাচ্চা আছে। আমরা আরেকটা বাচ্চা নেওয়ার লাইগা চেষ্টা করতেছিলাম অনেক দিন ধইরাই। কিন্তু হইতেছিল না। গেলাম শহরে। ডাক্তারে কইলো আমারও টেস্ট লাগবো, বউয়েরও টেস্ট লাগবো। করাইলাম টেস্ট। তারপরে রিপোর্ট আনতে গিয়া জানতে পারলাম ডাক্তার নাকি জরুরি কাজে ঢাকার বাইরে গেছে। তিন দিনের আগে ফিরবো না। কিচ্ছা-কাহিনি বাদ দিয়ে সাইফুলকে কথা সংক্ষিপ্ত করার নির্দেশ দেন ওসি সাহেব। সে বলে, কইতাছি তো স্যার। একটু ধৈর্য ধইরা শোনেন। তো যখন জানতে পারলাম ডাক্তার তিন দিনের আগে ফিরব না, তখন মনে হইলো, তার লাইগা অপেক্ষা করার কী দরকার? আমাদের এলাকায়ই তো বড় ডাক্তার আছে। আমরা গ্রামে চইলা আসলাম। আর রিপোর্ট নিয়া সাইফুল ডাক্তারের কাছে গেলাম। সবগুলা রিপোর্ট দেইখা সে কী কইলো জানেন?

: বলে ফেল।

: কইলো আমার বাবা হওয়ার ক্ষমতা নাই। আমি কইলাম, আমার তো একটা বাচ্চা আছে। সে কইলো, আপনের কোনো দিনই বাবা হওয়ার ক্ষমতা ছিল না।

ইব্রাহিম চুলে আঙুল চালায়। পেছন দিকে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে কপালে পড়ে থাকা ঘামে ভেজা কাঁচা-পাকা চুলগুলো। আর সাবলীল ভঙ্গিতে বলে- আমার তখন মনে হইলো, ডাক্তার যদি মুখ খোলে, যদি এলাকার দুই-চাইরজনের কাছে বিষয়টা বইলা দেয়, তাইলে আমার ইজ্জতও থাকবো না, বউয়ের ইজ্জতও থাকবো না। এ জন্য আমি তার মুখ চিরতরে বন্ধ কইরা দিছি স্যার।

বলেই ওসি সাহেবের দিকে তাকায় ইব্রাহিম। আর ওসি সাহেব জানালা দিয়ে তাকান বাইরে। দেখার মতো কিছু নেই, তবু তাকিয়ে থাকেন নিষ্পলক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর