শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিশ্ববাজারে রংপুরের শতরঞ্জি

রেজাউল করিম মানিক, রংপুর

বিশ্ববাজারে রংপুরের শতরঞ্জি

রংপুরের গন্ডি পেরিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর অর্ধশত দেশে আলো ছড়াচ্ছে হস্তশিল্প শতরঞ্জি। আর এ শিল্পে কাজ করে রংপুরের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে অভাবের সংসারে ফুটিয়েছেন হাসির ঝিলিক। এক সময় রংপুর নগরীর আশপাশের হতদরিদ্ররা কাজের সন্ধানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় গেলেও এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। হতদরিদ্র, স্বামী পরিত্যক্তারা এ হস্তশিল্পে কাজ করে শুধু নিজের ভাগ্যেরই পরিবর্তন করেননি। সুনাম কুড়িয়েছেন বিশ্বব্যাপী। তাদের নিপুণ হাতে গড়া এ হস্তশিল্প শতরঞ্জি পৃথিবীর প্রায় ৪০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এটি জেলার ঐতিহ্যবাহী বুননশিল্প। একসময় রাজা-বাদশাহদের কাছেও এর কদর ছিল। এ কথা অনেকেই জানেন, মোগল সম্রাট আকবরের দরবারে শতরঞ্জি ব্যবহার করা হতো। জমিদারদের ভোজনের আসনেও ছিল এর ব্যবহার। এ শতরঞ্জি নদীপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত।

সময় বয়ে গেছে। একসময় রংপুর থেকে এ বুননশিল্প প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। এখন আবার জেগে উঠছে এ শিল্প। রংপুরের শতরঞ্জি রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। শতরঞ্জি হলো একধরনের কারপেট। শব্দটি ফারসি শতরঞ্জ থেকে এসেছে। শতরঞ্জ হলো দাবা খেলার ছক। দাবা খেলার ছকের সঙ্গে শতরঞ্জির নকশার মিল আছে। সেখান থেকেই নামটি এসেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রংপুরের নিসবেতগঞ্জ এলাকায় (আদি নাম পীরপুর) এ শতরঞ্জি বুননের কাজ শুরু হয়। বর্তমান বিশ্বে শতরঞ্জি প্রাচীনতম বুননশিল্পের একটি। হস্তজাত এ পণ্য তৈরিতে কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। বাঁশ ও রশি দিয়ে টানা দেওয়া হয়। পাটের তৈরি সুতো দিয়ে সম্পূর্ণ হাতে নকশাখচিত শতরঞ্জি তৈরি করা হয়। কোনো রকম জোড়া ছাড়া যে কোনো মাপের শতরঞ্জি তৈরি করা যায়। নতুন করে এ হস্তশিল্পের প্রতি আগ্রহ বাড়ার পেছনে আছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন। ১৯৭৬ সালে সরকারিভাবে শতরঞ্জি তৈরির একটি প্রকল্প গ্রহণ করে এ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সে উদ্যোগ খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এরপরও আশা মরে যায়নি। সেই উদ্যোগই কোনো কোনো মানুষকে এ শিল্পে যুক্ত করে। ফলে ১৯৯১ সালে ব্যক্তি উদ্যোগে শতরঞ্জির উৎপাদন শুরু হয়।

 

এই শতরঞ্জি এখন শুধু নিসবেতগঞ্জের গ্রামে সীমাবদ্ধ নেই। রংপুরজুড়ে এখন শতরঞ্জি উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে রংপুরের শতরঞ্জি পৃথিবীর প্রায় ৪০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশেও এর চাহিদা ব্যাপক। ‘কারুপণ্য’ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে শতরঞ্জি তৈরির পাঁচটি কারখানা। আরও রয়েছে ‘নীড় শতরঞ্জি’, ‘শতরঞ্জি পল্লী’, ‘চারুশী’ শতরঞ্জি কারখানা। কারখানা ছাড়াও নিসবেতগঞ্জ এলাকায় বাড়ির আঙিনা কিংবা উঠানে, বাড়ির ছাউনির নিচে নিপুণ হাতে চলছে শতরঞ্জি বুননের কাজ।

 

এসব কারখানায় প্রায় নয় হাজার নারী-পুরুষ কাজ করছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে রপ্তানি বাণিজ্যে হস্তশিল্পের ৬০ শতাংশই রংপুরের শতরঞ্জি। শতরঞ্জি তৈরির প্রধান উপকরণ পাটের সুতলি। ওয়ালম্যাট, জায়নামাজ, মেঝেতে বিছানোর জন্য কারপেট হিসেবে এই শতরঞ্জি ব্যবহৃত হয়। শতরঞ্জির নকশা হিসেবে এসেছে নারীর মুখ, পশুপাখি, রাখালবালক, কলসি নিয়ে রমণী, নৌকাসহ প্রাকৃতিক দৃশ্যসহ আরও অনেক কিছু। কখনো কখনো ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী নকশা করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব নকশায়ও শতরঞ্জি তৈরি হয়। যে কোনো আকারের হতে পারে শতরঞ্জি। বুধবার সকালে কথা হয় রংপুর শতরঞ্জি পল্লীর সেলস ম্যান রোজিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এ হস্তশিল্প শুধু রংপুরের হতদরিদ্র মানুষের মুখেই হাসি ফোটায়নি, দেশের অন্তত ১০ হাজার মানুষ এ শিল্পে কাজ করে আজ নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলেছে।

 

কারখানার মাস্টার মোশারফ জানালেন ভিন্ন কথা ,তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বললেন, সরকার শ্রমিক পর্যায়ের মানুষদের কথা ভাবে না কিন্তু রংপুরের শিল্পপতি যারা রয়েছেন তাদের হাতে গড়ে তোলা হস্তশিল্প আজ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি আরও জানান, রংপুরের হস্তশিল্পে প্রায় ১০-১২ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। যাদের অধিকাংশ এক সময় ঢাকা কিংবা অন্যত্র কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তারা আজ অনেক সুখি।

 

রংপুর শতরঞ্জি পল্লীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তার এ বুননশিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি নিজে যেমন স্বাবলম্বী। ঠিক তেমনিভাবে হাজারো শ্রমিকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে এ শিল্প। প্রতি মাসে প্রায় ১৩-১৪ লাখ টাকা তার এ শোরুম থেকেই বিক্রি হয় বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে সারা দেশেই এই বুননশিল্প ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু অদৃশ্য কারণে মিলছে না কোনো সরকারি সাহায্য অভিযোগ মনিরার।

সর্বশেষ খবর