শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভালোবাসার প্রথম নিদর্শন হুমায়ুন সমাধি

যার অনুকরণে তৈরি হয় তাজমহল

মুহাম্মদ সেলিম, দিল্লি থেকে ফিরে

ভালোবাসার প্রথম নিদর্শন হুমায়ুন সমাধি

মুঘল সম্রাট শাহজাহান স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম প্রকাশ মুমতাজ মহলের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে ‘তাজমহল’ তৈরি করেন এ কথা আমাদের সবারই জানা। তাজমহলকে সবাই ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে জানলেও এর অর্ধশত বছর আগে ভালোবাসার আরেক নিদর্শন তৈরি করে গিয়েছিলেন সম্রাট হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদা বানু বেগম। যিনি বেগা বেগম নামেই সবার কাছে পরিচিত। স্বামী হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে তৈরি করা হয় হুমায়ুনের সমাধি। যা ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে ভারত বর্ষের তৈরি করা প্রথম স্থাপনা। এ সমাধি ‘হুমায়ুন’স টম্ব’ বা হুমায়ুনের সমাধি নামে গোটা উপমহাদেশে অধিক পরিচিত। ভারতে উদ্যান সমৃদ্ধ প্রথম কোনো সমাধিও এটি। ইতিহাসবিদগণের দাবি-  হুমায়ুনের সমাধির অনুকরণ করে পরবর্তীতে তৈরি করা হয় ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে পরিচিত পাওয়া সম্রাট শাহজাহানের ‘তাজমহল’।

 

অসাধারণ এই নিদর্শন ‘হুমায়ুন’স টম্ব’ বা হুমায়ুনের সমাধি বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অবহেলায় পড়ে ছিল। তখন সমাধিটির কিছু কিছু স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছিল। খসে পড়েছিল স্থাপনার গাঁথুনি। নষ্ট হয়ে যায় সমাধির অসাধারণ বাগানটিও। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো হুমায়ুনের সমাধিটি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এরপর ১৯৯৭ সালে আগা খান ট্রাস্ট ভারতীয় এই ঐতিহ্যটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। ২০০৪ সালে সংস্কার কাজ শেষ হয়। পুরো সমাধিটি দেখতে ভালোই লাগছিল। বাংলাদেশ থেকে হুমায়ুন সমাধিতে বেড়াতে আসা এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কথা প্রসঙ্গে সেই ব্যবসায়ী বলেই বসেন, ভাই সম্ভবত ইতিহাসে এর আগে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসার এমন নিদর্শন আর দেখা যায়নি।’ আগেই জেনেছি হুমায়ুনের সমাধি অনুসরণ করে তাজমহল তৈরি করা হয়েছে। অসাধারণ এ নিদর্শন দেখতেই দিল্লিতে ছুটে এসেছি। বিশ্ব এ ঐতিহ্য সশরীরে এসে না দেখলে  বোঝাই যাবে না এর শিল্প নিদর্শন।’ 

 

মুঘল সম্রাট হুমায়ুন ১৫৫৬ সালের ২০ জানুয়ারি মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুর পর দিল্লি রাজপ্রাসাদেই তাকে সমাহিত করা হয়। কিন্তু হিমু নামে একজন শাসক দিল্লি দখল করলে তার সমাধি পাঞ্জাবের সিরহিন্দে স্থানান্তর করেছিলেন। মুঘলরা ফের দিল্লি দখল করলে ১৫৬৫ সালে হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদা বানু বেগম সমাধি নির্ধারণের কাজ শুরু করেন। এ সমাধির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৫৭২ সালে। এর নির্মাণ ব্যয় হয় তৎকালীন সময়ের প্রায় ১৫ লাখ টাকা। এ সমাধির নকশা প্রস্তুত করেন পারসিক স্থপতি মিরাক মির্জা গিয়াস। এ সমাধি নকশা করার আগে নকশাকার মির্জা গিয়াসকে উত্তর-পশ্চিম আফগানিস্তান থেকে নিয়ে আসা হয়। হুমায়ুন’স টম্বের আগে তিনি ভারত, উজবেকিস্তান এবং আফগানিস্তানের অনেক স্থাপনা নির্মাণ করেন। হুমায়ুন’স টম্ব নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই মির্জা গিয়াসের মৃত্যু হয়। পরে তার পুত্র সৈয়দ মুহাম্মদ ইবনে মিরাক গিয়াসুুদ্দিন পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন। বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্যের রয়েছে আভিজাত্যের শিল্প ছোঁয়া। সদর দরজা থেকে সমাধি পর্যন্ত রয়েছে অনেক ছোট ছোট স্মারক। রয়েছে সুরি শাসক শের শাহের রাজসভার আফগান অভিজাত পুরুষ ঈসা খান নিয়াজির সমাধি। রয়েছে হুমায়ুনের স্ত্রী ও হুমায়ুনের সমাধির প্রতিষ্ঠাতা হামিদা বেগমের সমাধিও। এ ছাড়া সম্রাট শাহজাহানপুত্র দারাশিকো, জাহান্দর শাহ, ফারুকশিয়ার, রফি উদ দৌলত ও দ্বিতীয় আলমগীরের সমাধিও। হুমায়ুনের সমাধি পরিদর্শন না করলে বোঝা যাবে না এর স্থাপত্য শৈল্পিকতার কথা। এ ঐতিহ্যের নানান স্থাপনাই বলে দেয় কতটুকু পরিশ্রম করা হয়েছে এর নকশা এবং নির্মাণে। প্রতি বছর লাখো দর্শনার্থী এখানে আসেন শুধুমাত্র ভালোবাসার এই নিদর্শন দেখতে। ভারত ভ্রমণে আসা অধিকাংশ পর্যটকের পরিদর্শনের শর্ট লিস্টে থাকে প্রেমের অন্যতম এ নিদর্শন। হুমায়ুনের সমাধির মনমুগ্ধকর শৈল্পিক নিদর্শন শুধু উপমহাদেশেই নয়, বিশ্ববাসীর কাছেই এক অপার বিস্ময়।

 

কীভাবে যাবেন

বাংলাদেশ থেকে কলকাতা হয়ে সোজা দিল্লি। কলকাতা থেকে বিমান এবং ট্রেন; দুই পথেই যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া দার্জিলিং ও শিলিগুড়ি এবং মালদাহ থেকেও দিল্লিতে সরাসরি ট্রেন সার্ভিস রয়েছে। কলকাতা থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল ট্রেন সার্ভিস রয়েছে। হাওড়া স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া রাজধানী এক্সপ্রেস দিল্লিতে যেতে সময় লাগে প্রায় ১৮ ঘণ্টা। দ্রুতগতির এ ট্রেনের টিকিট পেতে কিছুটা কষ্ট হলেও ট্রেনের সরবরাহ করা নানা খাবার ও ট্রেন কর্মকর্তাদের আচরণ  ভ্রমণের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে।

 

কোথায় থাকবেন

প্রতি বছর দিল্লি বেড়াতে আসেন অসংখ্য পর্যটক। তাই দিল্লিতে গড়ে উঠেছে প্রচুর হোটেল। সাধারণ মান থেকে শুরু করে বিলাস বহুল তারকা হোটেল সবই রয়েছে দিল্লিতে। ভারতের রাজধানী দিল্লির যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত। দিল্লির যে কোনো স্থান থেকে অটো বা ট্যাক্সি করে হুমায়ুনের সমাধিতে যেতে পারবেন। চাইলে পাবলিক পরিবহনে চড়েও যেতে পারবেন।

 

জেনে রাখুন

ভারতের নাগরিকদের জন্য স্বল্প মূল্যে টিকিট হলেও ভিনদেশি পর্যটকদের জন্য টিকিট ভারতীয় মুদ্রায় ৬০০ রুপি। টিকিট সংগ্রহ করার সময় অবশ্যই পাসপোর্ট সঙ্গে রাখতে হবে।

সর্বশেষ খবর