লক্ষ্মীপুরের মেয়ে নাজমুন নাহার। বিশ্বে প্রথম পতাকাবাহী বাংলাদেশি নারী। ভ্রমণকন্যা হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। লাল-সবুজের পতাকা হাতে চষে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি বিশ্বের ১৫০ দেশ ভ্রমণ করে সাড়া ফেলেছেন। একুশ বছরের কঠোর সাধনায় আজ তার এই প্রাপ্তি আনন্দের। সম্প্রতি ১৫০তম দেশ সাওতমে অ্যান্ড প্রিন্সিপ ভ্রমণের মাধ্যমে এ ঐতিহাসিক মাইলফলক ছুঁয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও বিশ্বের প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে ১৫০ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করলেন বিশ্বশান্তির বার্তা নিয়ে। নাজমুন বিশ্ব দরবারে দেশের সুনাম অক্ষুণœ রেখে এভাবেই গৌরবের সঙ্গে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন বিশ্ববাসীর কাছে।
১৫০ দেশ ভ্রমণের অনুভূতি ব্যক্ত করে নাজমুন নাহার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে ১৭ কোটি মানুষের পতাকাকে আমি বিশ্বের মাঝে গত ২১ বছরে ১৫০ দেশে পৌঁছাতে পেরেছি, বাংলাদেশের মানচিত্রকে আমি পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মানচিত্রের মাঝে বহন করতে পেরেছি- এতে আমি খুব আনন্দিত, আমার চোখে পানি, অনেক কষ্টের পর এই অর্জন। এটা শুধু আমার নয়, এই অর্জন সব বাংলাদেশি মানুষের। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে, যারা আমাদের একটি বাংলাদেশ এনে দিয়েছেন।’
বাংলাদেশের পতাকা হাতে তিনি বিশ্বশান্তির এক অনন্য দূত হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছেন সারা বিশ্বে। এ পর্যন্ত সারা বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশে প্রায় লক্ষাধিক বাচ্চার সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে পরিচয় করিয়ে দেন! এ ছাড়াও পথে পথে তিনি স্কুল, কলেজ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে বিশ্বশান্তির বার্তা পৌঁছান। পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করেন তার বিশ্ব ভ্রমণের মাধ্যমে, এ ছাড়া বাল্যবিয়ে বন্ধের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেন। শিশু ও তরুণদের উৎসাহিত করেন তার বিশ্ব ভ্রমণে অভিযাত্রার মাধ্যমে।
নাজমুন নাহারের জন্ম লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার গঙ্গাপুরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার বাবা মোহাম্মদ আমিন ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। বাবার মুখে দাদার ভ্রমণজীবনের গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। বাবা সব সময় তাকে উৎসাহ দিতেন।
বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে বহন করার জন্য দেশে-বিদেশে বহু সম্মাননা ও বহু গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন নাজমুন নাহার। তিনি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে ফোবানা থেকে ‘পিস রানার’ সম্মাননা অর্জন করেন এবং দেশে ফিরেই পেয়েছেন নজরুল একাডেমি বিদ্রোহী সম্মাননা। বিশ্ব ভ্রমণের শান্তির বার্তা বহনের বিরল কাজের জন্য তিনি পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননা ‘পিস টর্চ বিয়ারার অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন মিস আর্থ কুইন অ্যাওয়ার্ড, অনন্যা শীর্ষ দশ সম্মাননা, গেম চেঞ্জার অব বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড, মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল উইমেন অব বাংলাদেশ, গ্লোব অ্যাওয়ার্ড, অতীশ দীপঙ্কর গোল্ড মেডেল সম্মাননা, জনটা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, তিন বাংলা সম্মাননা ও রেড ক্রিসেন্ট মোটিভেশনাল অ্যাওয়ার্ড। জাম্বিয়া সরকারের গভর্নর হ্যারিয়েট কায়োনার কাছ থেকে ‘ফ্ল্যাগ গার্ল’ উপাধি, সফল নারী সম্মাননাসহ দেশে-বিদেশে মোট ৫০টির মতো সম্মাননা পেয়েছেন।
তিনি সুইডেনে পড়াশোনা করতে যান ২০০৬ সালে। পড়াশোনার পাশাপাশি খন্ডকালীন কাজ করতেন। সামারে তিনি ১৭-১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে পয়সা জমাতেন শুধু ভ্রমণ করার জন্য। কম খরচে থাকতেন পৃথিবীর বিভিন্ন ট্রাভেলার্স হোস্টেলে। কখনো তাঁবু করে, কখনো কোচ সার্ফিংয়ের মাধ্যমে। স্বল্প খরচে পৃথিবী দেখার জন্য সড়কপথে ভ্রমণ করতেন নাজমুন, পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে জোন ভাগ করে করে একটানা ভ্রমণ করতেন। কোনো দেশে ভ্রমণের আগে তিনি সেই মহাদেশের ম্যাপ ও সেখানকার দর্শনীয় জায়গাগুলোর ওপর গবেষণা করে নিতেন। সেখানকার পার্শ্ববর্তী রুটগুলো দেখে নিতেন কীভাবে কম খরচে সেখানে পৌঁছানো যায়।
তিনি বলেন, এই সফরে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জায়গা নামিবিয়ার আদিম মরুভূমি, সোয়াকপমুনডে দেখা সমুদ্র ও মরুভূমি যেখানে মিলেছে, স্যান্ডউইচ হারবার, ওয়ালভিস বে। বুরুন্ডির বুজুম্বুরা, কঙ্গোর উভিরা লেক, দক্ষিণ সুদানের নীল নদ, অ্যাঙ্গোলার মুসোলো দ্বীপ। তার জীবনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা বাবা, দাদা, বই ও বিশ্ব ম্যাপ। এরই মধ্যে পরবর্তী ভ্রমণের ম্যাপ করেছেন নাজমুন। সিল্ক রুটের দেশ উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান হয়ে ইরান ও সিরিয়া পর্যন্ত ভ্রমণ করবেন। তারপর আফ্রিকা মহাদেশের দ্বীপদেশ মাদাগাস্কার, সিসিলি, মরিশাস, কমোরোস ও কেপভার্দে অভিযাত্রা করবেন। উজবেকিস্তান হয়ে এ মাসেই শুরু হবে তার আগামী অভিযাত্রা। ২০০০ সালে ভারতের ভূপালের পাঁচমারিতে ‘ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে তার প্রথম বিশ্ব ভ্রমণের সূচনা হয়। নাজমুন নাহার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ পৃথিবীকে দেখার জন্য আমার স্বপ্নই ছিল একমাত্র সম্বল। তারপর ধীরে ধীরে আমি স্বপ্ন আর ভাবনার শক্তিকে নিয়ে বাধার দেয়ালগুলোকে ভেঙেছি। বড় করে ভাবতে শিখিয়েছি নিজের স্বপ্নকে। আমি নিজেকে এখন পৃথিবীর মতো করে ভাবতে পারি। এই ভাবনাগুলো আমাকে শ্রেষ্ঠ সুখ দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে আমরা সবাই একই পৃথিবীর মানুষ, একই আকাশের নিচে বসবাস করছি। পৃথিবী আমাদের সবার ঘর।