শনিবার, ৩ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

একটি ঘড়ির কাহিনি

ড. মেহযেব রহমান চৌধুরী

একটি ঘড়ির কাহিনি

১৮৭৪ সালে উইলিয়াম কার্টার নামের এক ব্যক্তি তাঁর ওয়ার্কশপে বসে একটা পকেটঘড়ি বানাচ্ছেন। ঘড়িটি স্টার্লিং সিলভার (রুপা) দিয়ে তৈরি। তখনো কোয়ার্টজ বা ব্যাটারিচালিত ঘড়ি আবিষ্কার হয়নি। ভিতরে মেকানিক্যাল মুভমেন্ট। গিয়ার, স্প্রিং ও রোটার-এর সমন্বয়ে যান্ত্রিক মেশিন। চাবি দিয়ে চলে। সেই চাবিরও আবার আরেক ইতিহাস। এইচ স্যামুয়েল নামের এক অলংকার বিক্রেতার কাছ থেকে বানানো। চাবি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘড়িটি চলতে থাকে নিজের গতিতে। এটা ১৪৯ বছর আগের কথা। ঐতিহাসিক এই দৌলতটি আমার হাতে আসে প্রায় দেড় যুগ আগে। তখন আমি ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করি। ইতিহাস সম্পর্কে বরাবরই আগ্রহ ছিল, এখনো আছে। অনলাইনে একটি লিস্টিং দেখেই বাংলাদেশি ৯০০ টাকায় কিনেছিলাম ভাইটাল ফুটবল ম্যাগাজিনে কলাম লেখার পারিশ্রমিকের এক অংশ দিয়ে। তারপর দেশে ফেরার সময় কোথায় যেন হারিয়ে ফেললাম। যুগ কেটে গেল। আরও অনেক ঘড়ি সংগ্রহ করলাম। ঘড়ির জগৎকে ভালোবাসলাম, কিন্তু সেই পকেট ওয়াচটি ইতিহাসে হারিয়ে গেল। কিন্তু সব বদলে গেল ২০২৩ সালের মে মাসে। পুরনো কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে একটি মখমলের থলিতে ফিরে পেলাম দুর্লভ সম্পদ। চাবি দিলাম। ১৪৯ বছর পরও ঠিকই চলছে। তখনো কে বানিয়েছেন, কোথায় বা কোন বছর, কিছুই জানতাম না। শুরু হলো গবেষণা।

ঘড়ির গায়ে কোনো কিছু লেখা নেই। এখন দোকানে গেলে শুধু দেখবেন ব্র্যান্ডিং। সামনে, পেছনে, এমনকি পুশার বা চাবি/ক্রাউনে। পেছনটা খুললাম। অদ্ভুত তিনটি প্রতীক। এর মধ্যে মা এসে বসলেন আমার পাশে। দুজন মিলে ইন্টারনেট ঘাঁটতে শুরু করলাম। প্রতীকগুলোকে ঘড়ি বিশেষজ্ঞরা বলেন হলমার্ক। এই হলমার্কেরও ডাটাবেজ আছে। সবই অবশ্য পে ওয়াল-এর পেছনে। ৯০০ টাকার ঘড়ির পেছনে ৫০০০ টাকা খরচ করতে অনিচ্ছুক হয়ে পিছপা হলাম। পরের দিন মা এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী বাবা, তোমার গবেষণা কত দূর?’ আমি মনমরা হয়ে বললাম, না মা। মনে হয় এই রহস্য আর উদঘাটন হবে না। মা পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘চেষ্টা কর’। আবারও বসলাম কম্পিউটারের সামনে।

হলমার্কগুলো ছবি তুলে কম্পিউটারে আপলোড করলাম। জুম করে বুঝতে পারলাম প্রথমটি একটি সিংহ, পরেরটি চিতাবাঘ, তার পরেরটি চিহ্ন, আর তার নিচে ডব্লিউসি (W.C.) লেখা। ক্রমশ আবিষ্কার করলাম প্রতিটির অর্থ। হলমার্কিংয়ের উদ্দেশ ছিল মূল্যবান ধাতব আইটেমের ক্রেতাদের জালিয়াতি থেকে রক্ষা করা। ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর ঘড়ির ক্ষেত্রে একটি বৈধ ব্রিটিশ হলমার্কের চারটি চিহ্ন থাকত। স্পন্সরের চিহ্ন, শহরের চিহ্ন, স্ট্যান্ডার্ড মার্ক এবং তারিখ চিহ্ন। চিতাবাঘের মাথা ছিল গোল্ডস্মিথ হলের লন্ডন অ্যাসে অফিসের চিহ্ন, যার অর্থ ঘড়িটি লন্ডনে তৈরি করা হয়েছিল। ডেট লেটার এর টি (ঃ) চিহ্ন, চার্ট দেখে বুঝতে পারলাম ১৮৭৪ সালের। স্পন্সর চিহ্নটি একটি ঢালের মধ্যে নিবন্ধিত ব্যক্তির আদ্যাক্ষর। এই ঘড়ির ক্ষেত্রে, অক্ষরগুলো ছিল W.C. যা ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করে জানা যায় উইলিয়াম কার্টার।

অনেক সাধনার পর সফল হলাম। যাঁরা ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী বা ঐতিহ্য ধরে রাখতে চান, তাঁরাই হয়তো পুরোপুরি বুঝতে পারবেন এই সন্তুষ্টি। এইচ স্যামুয়েল এখনো যুক্তরাজ্যে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছেই আরও জানতে পারলাম চাবিটার ব্যাপারে। ম্যানচেস্টারে তৈরি করা ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৮-এর মধ্যেই। তাঁরা ধারণা করলেন, অরিজিনাল চাবিটি হারিয়ে যাওয়ার ফলে মালিক হয়তো একটি রিপ্লেসমেন্ট তৈরি করিয়েছিলেন। এর চেয়ে বেশি তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হলো না। তবুও শান্তি। আগামী বছর ঘড়িটির বয়স হবে ১৫০। আল্লাহ যদি তৌফিক দান করেন, তাহলে আগামী প্রজন্মকে দিয়ে যাব এই উইলিয়াম কার্টারটি। হয়তো আরও ১৫০ বছর পর আমার মতো কারও কাছে পৌঁছবে এই প্রতীকী। সময়ের সাক্ষী হয়ে থাকবে। সময় জানাতে থাকবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর