শনিবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

টিফিনের টাকায় জামালের লাইব্রেরি

লালমনিরহাট প্রতিনিধি

টিফিনের টাকায় জামালের লাইব্রেরি

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের টিপার বাজার এলাকার কৃষক আবদুল ছাত্তারের ছেলে শিক্ষার্থী জামাল হোসেন। ছোটবেলা থেকে তার বই পড়ার অভ্যাস, ভাবতেন সমাজের জন্য কিছু করার। সে চিন্তা থেকে ছাত্র অবস্থায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি স্কুল টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে বই কিনে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে এলাকায় সাড়া ফেলে দেয়। জামাল হোসেন এখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

বইপ্রেমী জামাল হোসেন ২০১১ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাধ্যমে তারায় তারায় দীপ শিখা নামে একটি আবৃত্তি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জেলা-বিভাগের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠানে ঢাকায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু কবিতা আবৃত্তি করার সময় ভুল উচ্চারণ ও আঞ্চলিকতা আসায় তিনি জয়ী হতে পারেননি। এসময় অনুষ্ঠানের এক বিচারক জামালকে একটি কবিতার বইয়ের কথা বলেন। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজির পরও বইটি তিনি পাননি। সেসময় ওই এলাকায় কোনো পাবলিক লাইব্রেরি ছিল না। তখন থেকেই লাইব্রেরি করার স্বপ্ন দেখেন জামাল। সেই চিন্তা থেকে স্কুলে যাওয়ার সময় বাবা মায়ের দেওয়া টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে মাটির ব্যাংকে জমা করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে ২০১৪ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাটির ব্যাংক ভেঙে ৭৫০ টাকা দিয়ে ১০টি বই কিনে নিজ বাড়িতে তৈরি করেন পাঠাগার। নাম দেন সারপুকুর যুব ফোরাম পাঠাগার। স্কুলের বন্ধুসহ এলাকার সমবয়সীদের ওই পাঠাগারের সদস্য করেন। এক সময় অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি পাঠাগারের সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। পরে বাড়ি থেকে একটু দূরে একটি ঘরে পাঠাগার স্থানান্তর করা হয়। বন্ধুদের সহযোগিতায় বিভিন্ন লেখকের লেখা বই সংগ্রহ করেন। ছুটে চলেন লালমনিরহাটসহ পার্শ¦বর্তী জেলার বিভিন্ন লেখকের দ্বারে দ্বারে। অন্যান্য বই সংগ্রহের পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরাতন বই সংগ্রহ করেন তারা। ধীরে ধীরে বইয়ে পূর্ণ হয়ে যায় পাঠাগার। একপর্যায়ে পাঠাগারে ৭ হাজার বই সংগ্রহ করা হয়। এখন সেখানে বিভিন্ন বয়সী প্রচুর পাঠক বই পড়তে আসেন। পাঠাগারে রয়েছে বিভিন্ন লেখকের বই এবং বিভিন্ন মনীষীর জীবন নিয়ে লেখা দুর্লভ কিছু বই। ইন্টারনেট ও স্মার্ট মোবাইল ফোনের এ যুগেও তার প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। অনেক সময় পাঠাগারের ভিতরে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাইরে গাছের নিচে বসেও বই পড়েন অনেকে। ছুটি শেষে বই পড়তে আসে বিভিন্ন স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা। ছোট গল্প, ছড়া ও কবিতার বই পড়তে আসে শিশু শিক্ষার্থীরাও। আর বিভিন্ন লেখকের উপন্যাস, কবিতার বই ও পেপার পড়তে আসেন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমাজের পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে সহায়তা ও গরিব মানুষকে সাহায্য করে থাকে বইপ্রেমী জামালের যুব ফোরাম পাঠাগার কমিটি। নিজ উদ্যোগে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৩০টিরও বেশি পাঠাগার স্থাপন করে জামাল। বর্তমানে সারা দেশে পাঠাগারগুলোর প্রায় ৫০ হাজার পাঠক সদস্য সৃষ্টি হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশের ৩০ জেলায় প্রতিষ্ঠা করেছে ১২৩৪টি সেলুন লাইব্রেরি। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্ল্যাহ বলেন, জামালের অনন্য এই উদ্যোগ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পাঠাগার কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠায় পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে। ডিজিটাল যুগে যখন সবাই ভার্চুয়ালি বিভিন্ন বিষয়ে ডুবে থাকে সে সময় জামালের বইপ্রীতি আলোড়ন তৈরি করেছে জেলাজুড়ে।

 

সর্বশেষ খবর