লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে দর্শকদের সঙ্গে উৎসব করল আর্জেন্টিনা। তারপর ড্রেসিংরুমে লিওনেল মেসিকে কেন্দ্র করে চলল উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব। সেই উৎসবে ছড়িয়ে পড়ল বন্যতা। ডাইনিং টেবিলের ওপর ট্রফি হাতে উঠে পড়লেন ফুটবলাররা। ড্রেসিং রুমের উৎসবটা শেষ হতেই তারা ধরা দিলেন দর্শকদের চোখে। লুসাইল স্টেডিয়াম থেকে ছাদ খোলা বাসে চেপে ট্রফি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন মেসিরা। হাজার হাজার সমর্থক দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে রইলেন মেসিদের দেখতে। ট্রফি হাতে ফুটবল কিংবদন্তিকে দেখে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল মুগ্ধতা। মেসিদের চলার পথে বিশেষ আয়োজন রাখল তারা। মেসিরা যে পথ দিয়ে যাচ্ছেন তার পেছনেই শুরু হলো আতশবাজির প্রদর্শনী। এভাবেই লুসাইল থেকে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান মেসিরা। সেখানে কাটে নির্ঘুম রাত। চলে বুয়েন্স আয়ার্সে ফেরার প্রস্তুতি। ভোর হতেই মেসিরা চলে যান এয়ারপোর্টে। তারপর আকাশে উড়াল দেন সকালেই। রোম হয়ে বুয়েন্স আয়ার্সে যাচ্ছেন মেসিরা। আজ সকালে আর্জেন্টিনায় পৌঁছার কথা।
আর্জেন্টিনায় মানুষের চোখে ঘুম নেই। ফুটবল সম্রাট বিশ্ব জয় করে সোনা রঙা ট্রফি নিয়ে দেশে আসছেন, তাদের চোখে ঘুম আসে কী করে! তারা জেগে রইলেন। রাতভর উৎসব করলেন। বুয়েন্স আয়ার্সে, ম্যারাডোনার বাড়ির সামনে, রোসারিওতে, কেবলই উৎসব। তারা উৎসব করলেন আর প্রস্তুতি নিলেন, বিশ্বজয়ী লিওনেল মেসিকে স্বাগত জানাতে। গতকাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার উৎসবের প্রস্তুতি নিয়ে তেমন কিছু জানা যায়নি। আর্জেন্টাইন সাংবাদিকদের বেশিরভাগই দেশের পথে উড়াল দিয়েছেন। যে কজন আছেন, তারাও নির্দিষ্ট কোনো অনুষ্ঠানের কথা বলতে পারলেন না। মেসিদের জন্য আর্জেন্টাইনরা ঘরের বাইরে অবস্থান নিয়েছে। পার্কে, রাস্তায়, পাবে, সবখানে। ট্রফি হাতে আর্জেন্টিনা দলকে না দেখে তারা ঘরমুখি হবে না!
দেশটি থেকে আসা সমর্থকরাও ছুটছেন আটলান্টিকের ওপাড়ে। উৎসবে শামিল হতে হবে না! ফাইনালের পর পরই এক সাংবাদিক রাস্তায় প্রচ জ্যাম দেখে লাগেজ নিয়ে হাঁটা শুরু করেন। অনেকটা পথ হেঁটে তিনি গাড়ি ভাড়া করে এয়ারপোর্টে পৌঁছেন। মেসিদের আগেই আর্জেন্টিনায় পৌঁছতে চাইছিলেন তিনি। এমনই অনেক আর্জেন্টাইন সমর্থক মেসিদের আগে আর্জেন্টিনায় পৌঁছে বিশ্বজয়ীদের অভ্যর্থনা জানানোর প্রস্তুতি শুরু করেছেন। গত রাতেই মেসিদের আর্জেন্টিনায় পৌঁছার কথা ছিল। তবে ফ্লাইট ডিলে হওয়ায় আজ সকালে পৌঁছবেন মেসিরা।
আর্জেন্টিনার উৎসবের কেন্দ্র লিওনেল মেসি। তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে দলটা। বিশ্বকাপের আগে থেকেই যেমনটা বলছিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবলাররা। লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপের ট্রফি দেখতে চান তারা। তার জন্য, আর্জেন্টিনার জন্য, দিয়েগো ম্যারাডোনার জন্য জয় করতে চান বিশ্বকাপ। লিওনেল মেসি নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন সব চাপ। আগলে রেখেছিলেন সতীর্থদের। সব চাপ সামলে তাদেরকে খেলতে দিয়েছেন। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। গোল করেছেন। গোল করিয়েছেন। আর্জেন্টিনার লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। লিওনেল মেসির হাতে উঠেছে বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি। তারা উৎসব করছে। বুনো উল্লাসে ফেটে পড়ছে পুরো দেশ। আর উৎসবের কেন্দ্রে লিওনেল মেসি।
এক সময় দিয়েগো ম্যারাডোনা ছিলেন আর্জেন্টিনার মানুষের হৃদয়ের বাদশা। সেখানে আর কারও স্থান ছিল না। ১৯৮৬ সালে প্রায় একক নৈপুণ্যে বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছিলেন দিয়েগো ম্যারাডোনা। এরপর থেকেই ম্যারাডোনাকে নিয়ে সুর করে গান গায় আর্জেন্টাইনরা। গত বছর কোপা আমেরিকা জয় করেই ম্যারাডোনার নামের পাশে স্থান করে নিয়েছেন মেসি। সেই থেকেই আর্জেন্টাইনদের কোরাসে ম্যারাডোনার সঙ্গে স্থান হয়েছে মেসিরও। আর এখন? আর্জেন্টাইনরা আগে লিওনেল মেসির নাম নেয়, তারপর ম্যারাডোনা। দুই কিংবদন্তির মধ্যে কে বেশি প্রিয় আর্জেন্টাইনদের কাছে? এই প্রশ্নের উত্তর নেই তাদের কাছে। দুজনেই। এতদিন তাদের হৃদয়ের রাজ্যে একক শাসন ছিল ম্যারাডোনার। এখন সেখানে স্থায়ী আসন গেড়েছেন লিওনেল মেসি।
দিয়েগো ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনাকে দুটো বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে গেছেন। মেসিও দুটো বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে গেছেন আর্জেন্টিনাকে। ম্যারাডোনা একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। মেসিও একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তবে ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনাকে কখনো কোপা আমেরিকা উপহার দিতে পারেননি। মেসি পেরেছেন। এই দিক দিয়ে ম্যারাডোনারও উপরে চলে গেছেন মেসি। তাই, আর্জেন্টাইনদের উৎসব এখন মেসিকে কেন্দ্র করেই। এই উৎসব চলবে। চলতেই থাকবে। রাত-দিন, সকাল-সন্ধ্যায়।
কত টাকা পেল আর্জেন্টিনা
৩৬ বছর পর অপেক্ষার অবসান ঘটল আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার পর মেসির হাতে উঠল স্বপ্নের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নের ট্রফি। রবিবার লুসাইল স্টেডিয়ামে শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে তৃতীয়বার ফুটবলে বিশ্বসেরা ট্রফি জিতল। শুধু ট্রফি নয়, চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আর্জেন্টিনা পেল ৪২ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৩৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা)। রানার্স-আপ ফ্রান্সের পকেটে উঠেছে ৩০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩০০ কোটি টাকা)। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বিশ্বকাপের চেয়ে ৬০ লাখ ডলার বাড়ানো হয়েছে।