ইতিহাস আর ঐতিহ্যের মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ঢোকার রাস্তা অগুনতি। তারই একটি রড লেভার এরিনা দিয়ে। ইয়ারা নদী লাগোয়া রড লেভার আবার বিখ্যাত টেনিসের জন্য। এখানেই বসে বছরের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম টেনিস টুর্নামেন্ট। বিখ্যাত টেনিস কোর্টের পাশ দিয়ে হাঁটতেই চোখে পড়ল বিরাট হোর্ডিংয়ে লেখা-'ফ্যান জোন'। সেখানে বড় একটি টিভি স্ক্রিন লাগানো। তার সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু আয়েশী চেয়ার! বসে আছেন বেশ কিছু বাঙালি। সবাই অপেক্ষায় খেলা দেখার জন্য। কিন্তু অবাক হতে হলো শামিয়ানা দিয়ে ঢাকা স্টেজ দেখে। স্টেজে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান গাইছেন পাঞ্জাবি ও শাড়ি পরিহিত ৫-৬ জন। তাদের কণ্ঠে 'পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে' কিংবা 'টাগডুম, টাগডুম, বাজাই বাংলাদেশের ঢোল...' গানগুলো শুধু মাতিয়েই রাখেনি, উদ্দীপ্ত করছে বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমীদের। পুলকিতও করছে অন্যদেরও!
দলকে উৎসাহিত করতে সকাল থেকেই এমসিজিতে হাজির হন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালিরা। ক্যানবেরার মানুকায় যে বাঙালি আবহ ছিল, লঙ্কান দর্শকদের আধিক্যে কাল তার দেখা মেলেনি। হয়তো তাই ৭-৮ হাজার বাঙালির উপস্থিতিও উজ্জীবিত করতে পারেনি মাশরাফি বাহিনীকে। উল্টো ঐতিহ্যবাহী মেলবোর্নে খেলতে নেমে যেন সুর-তাল-লয় হারিয়ে ফেলেন মাশরাফিরা। বিশাল মাঠের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ টাইগাররা একের পর এক মিস করেন ক্যাচ ও স্ট্যাম্পিং। হারিয়ে ফেলেন আত্মবিশ্বাস। মাশরাফিবাহিনীর এই আত্মবিশ্বাসহীনতাকে কাজে লাগিয়ে ১ উইকেটে ৩৩২ রানের পর্বত সমান স্কোর করে 'দ্বীপরাষ্ট্র' শ্রীলঙ্কা। সেঞ্চুরি করেন ওপেনার তিলকরত্নে দিলশান ও ৪০০ নম্বর ওয়ানডে খেলতে নামা সাঙ্গাকারা। ম্যাচে তালগোলহীন বাংলাদেশ ক্যাচ মিস করে তিনটি এবং একটি স্ট্যাম্পিং।
আফগানিস্তানকে হারিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন মাশরাফিরা। বৃষ্টি ভাগ্যে অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে এক পয়েন্ট পাওয়ার পর আরও ঊর্ধ্বমুখী হয় আত্মবিশ্বাসের পারদ। টগবগে আত্মবিশ্বাস নিয়ে আপসেটের টার্গেটে কাল মাশরাফিরা নামেন মেলবোর্ন স্টেডিয়ামে। দুদিন অনুশীলন করে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে টাইগাররা। কিন্তু কাল মাঠে নামার পর বড্ড অসহায় মনে হয়েছে ক্রিকেটারদের। টস হেরে ফিল্ডিংয়ে নেমে শরীর গরম করার আগেই মাশরাফির বলে লাহিরু থিরিমানের ব্যাট ছুঁয়ে আসা বলটি কয়েকবারের চেষ্টায় তালুবন্দী করতে পারেননি এনামুল। সেই যে ব্যর্থতা শুরু, সেটা টিকে থাকল শেষ পর্যন্ত। এনামুল ভাগ্যে জীবন পাওয়া থিরিমানে থামেন ব্যক্তিগত ৫২ রানে। অবশ্য আরও একবার জীবন পান মুশফিকের জন্য। ২২ নম্বর ওভারে সাব্বিরের চতুর্থ বলে সহজ স্ট্যাম্পিং মিস করেন মুশফিক। দুবার জীবন পেয়েও সেঞ্চুরি করতে পারেননি থিরিমানে।
থিরিমানে না পারলেও সেঞ্চুরি করেন ৪০০ নম্বর ওয়ানডে খেলতে নামা কুমার সাঙ্গাকারা ও তিলকরত্নে দিলশান। ওয়ানডে ইতিহাসে প্রথম ওয়ানডে ক্রিকেটার হিসেবে ৪০০ ম্যাচ খেললেন সাঙ্গাকারা। ব্যক্তিগত ২৩ রানে তাসকিনের বদান্যতায় জীবন পেয়ে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন ১০৫ রানে। ৩৩ ওভারের শেষ বলে ফিরতি ক্যাচ নিতে ব্যর্থ হন তাসকিন। ৪১.১ ওভারে পয়েন্টে আবারও সহজ ক্যাচ ফেলেন মুমিনুল। এবারও ভাগ্যবান সাঙ্গাকারা। সাঙ্গাকারা দুবার জীবন পেলেও দিলশান খেলেছেন সলিড ইনিংস। বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচে রান না পাওয়া দিলশানের শুরু ছিল নড়বড়ে। কিন্তু অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থকেন ১৬১ রানে। যা তার ৩১০ ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ। আগের সর্বোচ্চ ১৬০, ভারতের বিপক্ষে। ইনিংসটি ক্যারিয়ারের ২১ নম্বর এবং বাংলাদেশের বিপক্ষে চতুর্থ। দুই অভিজ্ঞ দিলশান ও সাঙ্গাকারা ২৫.৩ ওভারে যোগ করেন ২১০ রান এবং ১১৫ রান শেষ ১০ ওভারে। দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের সাবলীল বাটিংয়ে দিনের প্রথম সেসনেই ম্যাচ থেকে ছিটকে পরে টাইগাররা। ক্রিকেটের স্বর্গ মেলবোর্নে প্রথমবারের মতো খেলতে নামাটাকে স্মরণীয় করে রাখার অনেক উপলক্ষ ছিল মাশরাফিবাহিনীর। কিন্তু বিশাল মাঠ এবং গ্যালারির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে কাচভঙ্গুর মনোবল নিয়ে শেষ পর্যন্ত আর লড়াই করতে পারেননি মাশরাফিরা।