অস্ট্রেলিয়ার যেখানেই পা রাখবেন, থমকে দাঁড়াবেন। ওহে পথিক একটু দাঁড়াও- ভাবনায় আপনিও থেমেও পড়বেন অলস সৌন্দর্য দেখতে। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রতিটি শহরের সৌন্দর্য আলাদা। একটির সঙ্গে মিল নেই অন্যটির। তেমনি এক শহর অ্যাডিলেড। রিভার টোরেঞ্জ শহরের মধ্যদিয়ে বয়ে গেছে কুলকুল করে। সেই নদীর পাড়ে অ্যাডিলেড স্টেডিয়াম। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যানের নাম। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান অ্যাডিলেডে শুয়ে আছেন চির শান্তিতে। ব্রাডম্যানের শহর এখন মাহামুদুল্লাহ রিয়াদেরও শহর। এখানেই মাহামুদুল্লাহ নিজেকে মেলে ধরেছেন অন্যভাবে। চাপের মুখে যে ইনিংসটি খেলেন কাল, তার তুলনায় শুধু নিজেই। অ্যাডিলেডের 'ড্রপ ইন' উইকেটকে নিজের করে খেলেছেন অসাধারণ এক সেঞ্চুরি। যা বিশ্বকাপ ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি।
পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রিভার টোরেঞ্জের স্রোতধারা দেখে মুগ্ধতা ছড়ানো স্বাভাবিক। অ্যাডিলেডবাসীর প্রাণে উদ্যম এনে দেয় নিস্তরঙ্গ জলরাশি। কাল ৮ রানে দুই ওপেনারকে হারানোর পর টাইগাররা যখন পুরোপুরি কোণঠাসা, তখনই হাল ধরেন মাহামুদুল্লাহ। তরুণ সৌম্য সরকারকে নিয়ে তৃতীয় উইকেট জুটিতে ৮৬ রান যোগ করেন ১৮.১ ওভারে। এই জুটিই শক্ত ভিত দেয় দলকে। জর্ডানের বাউন্সারে সৌম্য সাজঘরে ফিরলেও উইকেটের একপ্রান্ত আগলে রাখেন মাহামুদুল্লাহ। সৌম্যের বিদায়ের পর দলের সেরা ক্রিকেটার সাকিব ক্রিজে আসলেও মঈন আলির টার্নে বোকা বনে স্লিপে আউট হন। ৯৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় দলের, তখনই 'ভায়রা' মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে নৌকার হাল ধরেন। দুজনে ইংলিশ বোলারদের সাধারণ মানে নামিয়ে যোগ করেন ১৪১ রান। যা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের যে কোনো উইকেটে সর্বোচ্চ। আগের ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩৯ রানের জুটির সাক্ষীও ছিলেন এই দুজন।
মুশফিক আগের ম্যাচগুলোর ধারাবাহিকতা ধরে রেখে কাল খেলেন ৮৯ রানের দৃষ্টিকাড়া এক ইনিংস। ৭৭ বলে ৮ চার ও ১ ছক্কায় সাজানো ইনিংসটিই বাংলাদেশের স্কোর নিয়ে যায় ২৭৫'এ। আগের তিন ম্যাচে দুটিতে হাফসেঞ্চুরি করেন মুশফিক। আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলেছিলেন ৭১ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস। পরের ম্যাচে মেলবোর্নে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩৬ করলেও স্কটিশদের বিপক্ষে খেলেন ৬০ রানের ইনিংস। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটসম্যানের বিদায়ের আগেই অবশ্য সাজঘরে ফিরেন মাহামুদুল্লাহ। রান আউটের শিকার হওয়ার আগে নামের পাশে লিখে নেন ১০৩ রান। যা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ। নেলসনে অবশ্য সেঞ্চুরির সুযোগ তৈরি করেছিলেন তামিম ইকবাল। খেলেছিলেন ৯৫ রানের ইনিংস। সেঞ্চুরি করতে না পারায় আক্ষেপ ঝড়েছিল তামিমের কণ্ঠে, 'বিশ্বকাপ খেলতে আসার সময় একটি টার্গেট করে এসেছিলাম আমি। বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করতে। করতে না পারায় কিছুটা খারাপ লাগছে।' ওই ম্যাচে সেঞ্চুরির সুযোগ ছিল মাহামুদুল্লাহরও। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বোল্ড না হলেও হয়তো সেঞ্চুরি করেই ফেলতেন। নেলসনে না পারলেও সেই হতাশা দূর করেন অ্যাডিলেডে। উইকেটের চারিদিকে স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছুটিয়ে ১১৪ ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরির স্বাদ নেন। তাও আবার বিশ্বকাপের মহামঞ্চে।
গত বছর ভালো সময় কাটেনি মাহামুদুল্লাহর। সমালোচনার তীর্যকবাণে জর্জরিত হয়েছিলেন। কিন্তু ভেঙে পড়েননি তাতে। বরং নিজেকে গুছিয়ে নেন। এরপর জিম্বাবুয়ে সিরিজ দিয়ে ফিরেন ফর্মে। ১ রান দিয়ে শুরু। পরের ম্যাচে করেন ১২। তখন অনেকেই সাজঘরে বসিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু অধিনায়ক মাশরাফি আস্থা রাখেন তার ওপর। মাহামুদুল্লাহও সেই আস্থার প্রতিদান দেন রানের পর রান করে। সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে ৩৩*, পরের ম্যাচে ৮২* এবং শেষ ম্যাচে খেলেন ফের ৫১ রানের অপরাজিত ইনিংস। জিম্বাবুয়ে সিরিজেই ইঙ্গিত দেন বিশ্বকাপে দলের অন্যতম আস্থার প্রতীক হবেন তিনি। ক্যানবেরার মানুকা ওভালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২৩ করার পরের ম্যাচে মেলবোর্নে খেলেন ২৮ রানের ইনিংস। নেলসনে অবিশ্বাস্য জয়ের অন্যতম কারিগর মাহামুদুল্লাহ খেলেন ৬২ রানের ইনিংস। গত মাচগুলোর আত্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে কাল খেলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সেরা এক ইনিংস।
সংখ্যার বিচারে ১০৩ রান গেইল-ভিলিয়ার্সদের বিশাল সব ইনিংসের তুলনায় হয়তো আহামরি কিছু নয়। কিন্তু সময়ের বিবেচনায় এবং দলের প্রয়োজনের ইনিংসটিই বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ইনিংস। সেই ইনিংসের কারিগর মাহামুদুল্লাহ রিয়াদ। যিনি ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় কাটিয়েছেন ছায়ায়। কাল সেঞ্চুরির পর দর্শক, সতীর্থদের ফ্লাইং কিস দিয়ে যেভাবে পালন করেন সেঞ্চুরি, তাতে বুঝা গেছে কত নির্ভার এখন তিনি। দুর্দান্ত এ সেঞ্চুরিটা নিজের সন্তান এবং স্ত্রীকে উপহার দিয়েছেন রিয়াদ।
উচ্ছ্বসিত মাহমুদুল্লাহ ম্যাচ শেষে বলেন, 'বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করা আমার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন এবার পূরণ হলো।'