যে কোনো খেলায় জয়ের পূর্বশর্ত হচ্ছে আত্মবিশ্বাস! সামর্থ্যে কিছুটা ঘাটতি থাকলেও তা পুষিয়ে দেয় ‘দৃঢ় মনোবল’। ক্রিকেটে বাংলাদেশ কিছুদিন আগেও বড় দলের বিরুদ্ধে মাঠে নামার আগেই হেরে বসে থাকত! কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ক্রিকেটারদের মানসিকতায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এখন আর প্রতিপক্ষের শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা করে না টাইগাররা। প্রতিটি ম্যাচের তারা খেলতে নামেন জয়ের লক্ষ্যকে সামনে রেখে।
বাংলাদেশ দলে এই পরিবর্তনটা দেখা যাচ্ছিল বেশ কয়েক বছর থেকেই। তবে মাশরাফিদের দৃঢ়চেতা মনোভাবটা ক্রিকেটবিশ্বের কাছে প্রকাশ পায় গত বিশ্বকাপে। সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে গিয়ে তরুণ এক দল নিয়ে কীভাবে সফল হওয়া যায়- তার বড় উদাহরণ এখন ‘টিম টাইগার্স’। বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনাল, তারপর পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ, সবশেষে ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ জয়- তিনটি ঘটনাই দেশের ক্রিকেটে ঐতিহাসিক এক দলিল! তিনটি প্রতিযোগিতাতেই বাংলাদেশের সফলতার নেপথ্য কারণ হচ্ছে ‘আত্মবিশ্বাস’।
পারফরম্যান্স ও আত্মবিশ্বাস একে অপরের পরিপূরক। একটি ছাড়া আরেকটি অচল! আত্মবিশ্বাস ও পারফরম্যান্সের সমন্বয় ঘটেছে বলেই বাংলাদেশ দল এখন সাফল্য অর্জন করছে একের পর এক। কোনো ক্রিকেট পরাশক্তি-ই এখন আর টাইগারদের কাছে দুর্বোধ্য নয়। বিশ্বকাপে সফলতার পর এশিয়ার দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে নাস্তানাবুদ করে টাইগাররা এখন আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী।
মাশরাফি-মুশফিকদের টার্গেট এখন দক্ষিণ আফ্রিকা। টাইগারদের বিরুদ্ধে তিনটি ওয়ানডে এবং দুটি করে টি-২০ ও টেস্ট খেলতে ৩০ জুন ৩৫ দিনের সফরে বাংলাদেশে আসছে প্রোটিয়ারা।
ক্রিকেটপ্রেমীদের দৃষ্টি জুড়ে থাকবে ওয়ানডে সিরিজ। নিয়মিত টেস্ট ও টি-২০ না খেলার কারণে এই দুই ফরম্যাটে বাংলাদেশ এখনো নিজেদের আগ্রাসী হিসেবে মেলে ধরতে পারেনি। তাছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নিয়ে দোলাচলের কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজটি বেশি গুরুত্ব পাবে।
ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ের পরই বাংলাদেশ র্যাঙ্কিংয়ে সাতে ওঠে। সেই সঙ্গে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা। কিন্তু গুঞ্জন উঠেছে আগস্টে ত্রি-দেশীয় সিরিজ করতে যাচ্ছে জিম্বাবুয়ে। সেখানে স্বাগতিকদের সঙ্গে থাকবে পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আইসিসির এফটিপির বাইরে যদি সত্যি সত্যি এই টুর্নামেন্টে অনুষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রে র্যাঙ্কিংয়ে পরিবর্তন হতে পারে। তাই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার শর্ত অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশকে র্যাঙ্কিংয়ের আটের মধ্যে জায়গা নিশ্চিত করতে হলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ন্যূনতম একটি জয় দরকার।
প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তান-ভারতের মতো দলকে উড়িয়ে দেওয়ার পর বাংলাদেশ কি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলতে নামবে মাত্র এক জয়ের জন্য! মোটেও না। অবশ্যই লক্ষ্য থাকবে সিরিজ জয়। কিন্তু প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে কাজটা যে সহজ হবে না! কেননা পাকিস্তান-ভারতের বোলিং লাইন আর দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং লাইন এক নয়। প্রোটিয়াদের বেশির ভাগ জয় এসেছে তাদের পেসারদের হাত ধরেই। তাছাড়া এবিডি ভিলিয়ার্স, ফাপ ডু প্লেসিসের মতো আগ্রাসী ব্যাটসম্যানও দলে রয়েছে।
বাংলাদেশ-ই বা কম কিসে? মাশরাফি-তাসকিন-রুবেলদের বল তো বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানকে নাকানি চোবানি খাইয়ে দিয়েছিল বিশ্বকাপে। এবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বামহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। -কী দুর্দান্ত কাটার! তরুণ এই পেসারের কাটারেই তো কাটা পড়েছে ভারত। অভিষেক সিরিজেই তিন তিনটি বিশ্ব রেকর্ড গড়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন মুস্তাফিজ। তিন ম্যাচে নিয়ে ১৩ উইকেট। প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে আরও আগ্রাসী মুস্তাফিজকে দেখার অপেক্ষায় দেশবাসী।
বাংলাদেশ আগাগোড়ায় স্পিননির্ভর দল হলেও ভারত বধের মিশনে দলে ছিল চারজন পেসার। এটা অবশ্য কোচের পরিকল্পনা! কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধেও কি দলে চার পেসার খেলবে? ভারত যেমন স্পিনে শক্তিশালী, তেমনি দক্ষিণ আফ্রিকা পেস বোলিংয়ে দুর্ধর্ষ। তাই কোচকে হয়তো এবার কৌশল বদলাতেও হতে পারে। জোর দিতে হতে পারে স্পিনে।
দক্ষিণ আফ্রিকা ভয়ঙ্কর দল হলেও তাদের বিরুদ্ধে কন্ডিশনের সুবিধাটা আদায় করে নিতে পারে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে প্রতিপক্ষের কোথায়-কোথায় দুর্বলতা সেই জায়গাটাও খুঁজে বের করতে হবে। যদিও সবারই জানা, প্রোটিয়ারা চাপে পড়লে ভেঙে পড়ে আর স্পিনে তারা খুবই অসহায়। এই দুই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যাটসম্যানদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। ভারতের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচে পরিষ্কার দেখা গেছে, আত্মতুষ্টিতে ভোগার কারণে ব্যাটসম্যানরা উইকেটে সেট হওয়ার পরও দায়িত্বশীল ইনিংস খেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। আউট হয়েছেন বাজেভাবে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে মাঠে নামার আগে এই ছোট-খাটো ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরে নিতে হবে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং- তিন বিভাগেই আরও দায়িত্বশীল হতে হবে ক্রিকেটারদের। তবে একথা সত্য যে, যদি নিজের সামর্থ্যরে ওপর বিশ্বাস থাকে এবং কোচের পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটানো যায়, তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধেও সাফল্যের হাসি হাসবে বাংলাদেশ।