এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী টমটমের নগরী এখন অটোর দখলে। নগরীতে এখন হাজার হাজার অটোরিকশা। রাজশাহীর শহর-গ্রাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অটো। সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে রাজশাহীতে অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়। নগরীতে এখন প্রায় ২০ হাজারের বেশি অটো চলছে। নগরীতে অটোই এখন চলাচলের বাহনে পরিণত হয়েছে। এখন নিত্য-নতুন প্রশস্ত সড়ক হচ্ছে। এরপরও অটোরিকশা ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় লাল-সবুজে ভাগ হয়ে নগরীতে চলছে দুই বেলায় দুই রঙের অটোরিকশা।
সমাজ বিশ্লেষক আনোয়ার হোসেন আনা বলেন, স্বাধীনতা উত্তরকালে এ অঞ্চলের প্রধান বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি (টমটম)। ইতিহাসের সেই পথ ধরেই ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী শহরে ঘোড়ায় টানা গাড়ি টমটমের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। টমটম হলো এক ঘোড়ায় টানা দুই চাকার গাড়ি বিশেষ। বৃদ্ধ টমটমচালক আবদুল খালেক। বাড়ি নগরীর কাঁঠালবাড়িয়া। তিনি বলেন, আমি প্রায় ৬০ বছর থেকে এই টমটম চালাই। এমন এক সময় ছিল যখন রাজশাহীর প্রধান বাহন ছিল টমটম। নগরীর তেঁতুল তলা (রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের পাশে), সোনাদীঘি মোড়ে, সাহেববাজার (বড় মসজিদ) জিরো পয়েন্টে, রেলগেটে, হড়গ্রাম বাজার ঢালুর মোড়ে ছিল টমটম স্ট্যান্ড (ঘোড়ার আড্ডা)।
তিনি বলেন, সে সময় শহরের পথঘাট এতটা উন্নত ছিল না। গ্রাম্য পথগুলোর কথা তো ভাবাই যায় না। বর্ষার সময় পথিককে জুতা-স্যান্ডেল হাতে নিয়ে মালকোঁচা মারতে হতো। তেমনি গরমের সময় রাস্তাগুলো থাকত ধুলায় ভরা। তাই তখন টমটম যাত্রাতে ছিল সুবিধা। এখন টমটমের চাহিদা নেই বললেই চলে। ভাড়াই পাওয়া যায় না। শখ করে কেউ কেউ টমটমে চড়েন। আরেক টমটম চালক নাজিম সাত্তার বলেন, এখন কোনো আচার অনুষ্ঠান ছাড়া কেউই আর ঘোড়ার গাড়ি বা টমটম ভাড়া নেন না। বর্তমান যান্ত্রিক যুগে রাজশাহীর সেই ঐতিহ্যবাহী যান প্রায় বিলুপ্তির পথে। টমটম মিস্ত্রি খোকন বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই রাজশাহী শহরের অবস্থা বদলাতে থাকে। আশির দশকে প্রথম ভাগে মহকুমাগুলো জেলা ও থানাগুলো উপজেলায় উন্নীত হওয়ায় রাজশাহী শহরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রসার ঘটতে শুরু করে। পাকা রাস্তার সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেইসঙ্গে বাড়ে যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা। পৌরসভা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার ফলে নব্বই দশকের শুরু থেকেই রাজশাহী মহানগরীতে লাগে পরিবর্তনের হাওয়া। রাস্তা-ঘাটের প্রসারসহ শুরু হয় বিটুমিন-ইট-পাথরের শক্ত ঢালাই। পাশাপাশি গ্রামের পথগুলোতে ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ ও পাকাকরণের কাজ বেড়ে যায়। পথে পথে টমটমের কাঠের চাকার বদলে নামে রাবারের চাকার ঢল।
খোকনের মতে, বাস, মিনিবাস, ট্রাক, টেম্পো, মোটরসাইকেল, রিকশা ক্রমশ রোধ করতে থাকে ঐতিহ্যবাহী টমটমের গতি। তিনি বলেন, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বর্তমানে গুটি কয়েক টমটম রাজশাহীর প্রাচীন ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছে। নগরীর অধিকাংশ স্ট্যান্ড উঠে গেলেও পিএন গার্লস স্কুলের পাশে, কোর্ট ঢালুর মোড় ও কাটাখালীতে পাকা রাস্তার কাছে বসেন কয়েকজন কোচোয়ান। তারা টমটমের ঘোড়ার লাগাম ধরে বসে ভাড়ার আশায় প্রহর গুনে। তাদের বর্তমান হাল মর্মস্পর্শীও। প্রতিদিনের গড় আয় প্রায় ১২৫ টাকা যা দিয়ে তাদের অবলা ঘোড়ার খোরাক জোগাড় করাই মুশকিল হয়ে ওঠে। নিজেদের সংসারও ঠিকমতো চলে না।