আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলছে না। বাজারের সঙ্গে কুলানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। নিত্যদিনের প্রয়োজন পূরণে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। বাড়ছে হতাশা, অবসাদ, বিষন্নতা। সামান্য কারণেই মেজাজ হারাচ্ছে মানুষ। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস।
মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে করোনা মহামারীর পর থেকেই। দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিক্ষার্থীরা। এই সংকটে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। দেশে বর্তমানে মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন মাত্র ৩৫০ জন এবং কাউন্সেলিংয়ের জন্য সাইকোলজিস্ট রয়েছেন ৫শ’ জন।
গত বছরের ৮ এপ্রিল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্র সোহাগ খন্দকার। তিনি লিখেন, ‘জীবনের কাছে হার মেনে গেলাম। আমি আর পারলাম না’। ১০ মে ‘চোরাবালির মতো ডিপ্রেশন, মুক্তির পথ নেই, গ্রাস করে নিচ্ছে জীবন, মেনে নিতে পারছি না’—এমন সুইসাইড নোট লিখে ময়মনসিংহের নিজ বাড়িতে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া তাবাসসুম। দেশে মানসিক রোগের চিকিৎসা সেবা অপ্রতুল। প্রতি এক লাখ মানসিক রোগীর জন্য শয্যা সংখ্যা শূন্য দশমিক ৪টি। রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে আউটডোর ও ইনডোর সেবা দেওয়া হয়। এছাড়া মানসিক হাসপাতাল রয়েছে পাবনায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও কয়েকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসা হয়। পাবনা মানসিক হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আহসানুল হাবিব বলেন, দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য সাইক্রাটিস্ট ৩৫০ জন ও সাইকোথেরাপিস্ট ১শ’ জনেরও কম। এই চিকিৎসকেরা বিভাগীয় শহরে থাকেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা একেবারে অপ্রতুল।
গত ৯ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৩৬১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৩০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। এর মধ্যে স্কুল শিক্ষার্থী ১৬৯ জন। অভিমান, প্রেমঘটিত, পারিবারিক বিবাদ, যৌন হয়রানি এবং পড়াশোনার চাপ ও ব্যর্থতায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কিশোর-তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বিশ্বজুড়েই বেড়েছে। তরুণদের মধ্যে হতাশা, অবসাদ থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার প্রবণতাও উর্দ্ধমুখী। দ্রুত নগরায়নের ফলে তরুণরা নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে খুব বেশি সচেতন। অনেকেই কাঙ্খিত অবস্থানে যেতে না পেরে দ্রুতই হতাশ হয়ে পড়ছে। ভালো মানুষ হওয়ার চেয়ে তাদের মধ্যে গাড়ি, বাড়ির স্বপ্ন বড় হচ্ছে। এসব চাহিদা তাদের হতাশ করে তুলছে। বয়ষ্কদের মধ্যে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক, সামাজিক বৈষম্য ও বৈকল্যে হতাশা বাড়ছে। মনোবিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যক্তিজীবনে হতাশা, অবসাদ, একাকীত্ব থেকে মুক্তির জন্য নিজের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ ঘটাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ধ্যান ও আত্মনিমগ্নতা। বর্তমানে নানারকম সংকটে মানসিক অবসন্নতায় গ্রাস করছে জনজীবন। মনের চাপ বেড়ে গেছে, কমেছে মানসিক প্রশান্তি। এমন অবসন্ন পরিস্থিতিতে মেডিটেশন হতে পারে পরম বন্ধু, যা ক্লান্তি, অবসাদ দূর করে মনকে করবে চিন্তামুক্ত, প্রসন্ন, ফুরফুরে।
মানুষের সুস্থ্য জীবন যাপনে বর্তমানে ধ্যানচর্চা একটা বড় জায়গা নিয়ে আছে। আধুনিক জীবনে কাজের অতিরিক্ত চাপ, অবসাদ দূর করে বিভিন্ন শারীরিক-মানসিক প্রশান্তিতে ধ্যান বা মেডিটেশনের ভূমিকা অতুলনীয়। এছাড়াও মেডিটেশন স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের নিঃসরণ কমিয়ে দেয় বলে অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে এর জুড়ি নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন চর্চার মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ সম্মিলিত ধ্যানচর্চায় জড়িত রয়েছেন।
প্রতি শুক্রবার সকালে দেশের তিন শতাধিক স্থানে আত্মনিমগ্ন হন ধ্যানীরা। এর আগে তাদের চারদিনের মেডিটেশন কোর্সে অংশ নিতে হয়। এমন ৫০০তম কোর্সের মাইলফলক অতিক্রম করতে যাচ্ছে সংস্থাটি, যা ধ্যানচর্চার এক অনন্য রেকর্ড। আগামী শুক্রবার ৪৯৯তম কোর্স শুরু হচ্ছে ঢাকায়। নগরে নানারকম সংকটে থাকা মানুষ, অনলাইনে আসক্ত সন্তান, হতাশা, বিষন্নতায় বিপন্ন যে কোনো বয়সী মানুষ ধ্যান শিখে শারীরিক মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারেন।