সোমবার, ১ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর পুলিশের নিষ্ঠুরতা

তানভীর আহমেদ

যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর পুলিশের নিষ্ঠুরতা

কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর পুলিশের নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা চলছেই আমেরিকায়। যুক্তরাষ্ট্রে বছর বছর সামান্য অপরাধ, অজুহাতে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর চড়াও হচ্ছে পুলিশ। চালাচ্ছে গুলি, মারাত্মক জখম অথবা গলা চেপে হত্যা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মৃতদের বেশিরভাগই ছিল নিরস্ত্র। বড় ধরনের অপরাধ বা অপরাধীর তালিকাতেও ছিল না তারা। কালো মানুষদের ওপর বর্ণবাদী আচরণ করছে অভিযুক্ত পুলিশ। ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স নামে একটি বেসরকারি সংস্থার চালানো জরিপে দাবি করা হয়েছে, আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তিনগুণ বেশি মারা যান কৃষ্ণাঙ্গরা। পুলিশের গুলিতে ২০১৯ সালে মারা গেছেন এক হাজারের বেশি। ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রের সংগৃহীত তথ্য এবং বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। সম্প্রতি হাঁটু দিয়ে গলা চেপে, নিরস্ত্র জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার ভিডিও বিক্ষুব্ধ করেছে সবাইকে। মৃত্যুর আগে একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার আকুতিতেও মন গলেনি পুলিশের। দেশটিতে এমন পুলিশি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে এখন গোটা আমেরিকায় চলছে বিক্ষোভ।

 

 

হাঁটু দিয়ে গলা চেপে ধরে ফ্লয়েডকে হত্যা করে পুলিশ

২৫ মে, যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়েপোলিস শহর। রাস্তায় ফিরছিলেন জর্জ ফ্লয়েড। ৪৬ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েড কাজ করতেন একটি রেস্তোরাঁর নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে। তাকে রাস্তায় আটকায় পুলিশ। অভিযোগ, তার কাছে জাল টাকা রয়েছে। পুলিশের ভাষ্য ছিল, ফ্লয়েডের গাড়িতে জাল নোট থাকার খবর পেয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তারা ফ্লয়েডকে গাড়ি থেকে নেমে সরে যেতে বললে তিনি কর্মকর্তাদের বাধা দেন এবং গ্রেফতার এড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সত্য ঘটনা লুকানো আর হলো না। একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, একজন পুলিশ অফিসার কীভাবে তার হাঁটু দিয়ে জর্জ ফ্লয়েডের গলা চেপে ধরেছেন। মিনিয়েপোলিসের শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার শেভিন জর্জ ফ্লয়েডের মাথায় হাঁটু ধরে তাকে মেরে ফেলেন। শেভিনের বিরুদ্ধে আনা চার্জে লেখা, ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড ওভাবে ফ্লয়েডের মাথায় হাঁটু চেপে রেখেছিলেন শেভিন, এর মধ্যে ২ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড ছিল ফ্লয়েড নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার পর। ফ্লয়েডের হাতে তখনো হ্যান্ডকাফ পরা ছিল। পুলিশের নির্দেশনা মেনে মাথা মাটির দিকে রেখে মাটিতে শুয়েই ছিলেন তিনি। তবু শেভিনের ওভাবে হাঁটু দিয়ে মাথা চেপে ধরা। পুলিশ কর্মকর্তা ফ্লয়েডের ঘাড়ের ওপর হাঁটু দিয়ে তাকে মাটিতে চেপে ধরে রাখার সময় একটু নিঃশ^াস নিতে হাসফাঁস করছিলেন। ফ্লয়েড বলতে থাকেন, ‘প্লিজ, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, আমাকে মারবেন না।’

এক পথচারী সে সময় ফ্লয়েডকে ছেড়ে দিতে পুলিশকে অনুরোধ করেন। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে ফ্লয়েডকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আমেরিকায় নিরস্ত্র একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার পর একজন পুলিশ অফিসার হাঁটু দিয়ে তার গলা চেপে ধরার পর ওই ব্যক্তির মৃত্যু দেশটিতে সংখ্যালঘু বর্ণ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পুলিশের নৃশংসতাকে আবার সামনে এনেছে। এ হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা রাজ্যের মিনিয়াপোলিস। বিক্ষোভ, সংঘর্ষ এবং অগ্নিসংযোগে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে কয়েকটি অঙ্গরাজ্য। আমেরিকার বিভিন্ন শহরে চলছে বিক্ষোভ। কোথাও কোথাও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচিও অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও তুমুল ধ্বংসযজ্ঞে রূপ নিয়েছে। বিক্ষোভে পুলিশ বাধা দিলে বিক্ষোভকারীরা একটি থানায় ও দুটি ভবনে অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মিনিয়েপোলিস ও পার্শ্ববর্তী সেইন্ট পল শহরে ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডের সদস্য মোতায়েন করা হয়। গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসের বাইরে যখন বিক্ষোভ চলছিল তখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ম্যানসনেই অবস্থান করছিলেন। এ সময় বিক্ষোভকারীদের সামনে বাধা সৃষ্টি করে নিরাপত্তাকর্মীরা। বিক্ষোভকারীদের ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’, ‘আমাদের হত্যা বন্ধ করুন’ স্লোগান ধরতে শোনা যায়। হোয়াইট হাউসের বাইরে ওয়াশিংটন ডিসিতে রাস্তাগুলোতে চলা বিক্ষোভ ব্যাপক সহিংসতায় রূপ নেয়। কারফিউ ভঙ্গ করে বিক্ষোভকারী রাত পর্যন্ত রাস্তায় অবস্থান করে। মিনেসোটা ছাড়াও নিউইয়র্ক, হিউস্টন, আটলান্টা, ডেট্রোয়েট, লাসভেগাস, সানজোসে ও মেম্পিসেও বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে।  বিক্ষোভকারীদের সামলাতে গিয়ে পুলিশ সংবাদকর্মীদের ওপরও চড়াও হয়। বিক্ষোভের ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করার সময় সংবাদমাধ্যম সিএনএনের লাইভ টিমের কয়েকজনকে আটক করে দেশটির পুলিশ। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে মিনিয়োপোলিসে বিক্ষোভের লাইভ প্রচার চলাকালে সিএনএন রিপোর্টার ওমর জিমনেজকে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় একজন প্রযোজক এবং ক্যামেরা অপারেটরকে হাতকড়াও লাগানো হয়েছিল। এ সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিলেও পুলিশ তাদের হাতে হ্যান্ডকাফ পরায় এবং ক্যামেরাও কেড়ে নেয়। মার্কিন টিভি নেটওয়ার্কে প্রচারিত ফুটেজে দেখা গেছে, সরাসরি সম্প্রচারের সময় পুলিশ কর্মকর্তা একজন প্রতিবেদক এবং তার ক্যামেরাম্যানকে ‘টার্গেট’ করছে। 

প্রতিবেদক এবং ক্যামেরাম্যানকে বারবার রাবার বুলেটের দ্বারা আঘাত করা হয়েছিল। একজন অফিসার নিজের অস্ত্রটি সরাসরি ক্যামেরার সামনে প্রদর্শন করেন। সব মিলিয়ে উত্তাল হয়ে পড়ে গোটা যুক্তরাষ্ট্র। ফ্লয়েডকে হাঁটুচাপা দিয়ে যে পুলিশ অফিসার হত্যা করেছে সেই  শেভিন জর্জের বিরুদ্ধে গুরুতর হত্যা ‘থার্ড-ডিগ্রি মার্ডার’ অভিযোগে মামলা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। এ ঘটনার তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন এফবিআই।

 

এরিক গার্নারকেও গলা চেপে খুন করে পুলিশ

যুক্তরাষ্ট্রে প্রশাসনিক এলাকা স্ট্যাটেন আইল্যান্ড। স্টাটেন আইল্যান্ডের একটি বিপণিকেন্দ্রের সামনে ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই নিহত হন গার্নার (৪৩)। সেখানে নিষিদ্ধ সিগারেট বিক্রির অভিযোগে কয়েক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে। কিন্তু অভিযোগ অস্বীকার করে গ্রেফতারের চেষ্টায় বাধা দেন গার্নার। তখন পুলিশ তাকে মাটিতে ফেলে হাতকড়া পরানোর চেষ্টা করে। ওই সময় শ্বাসরোধে হয়ে মৃত্যু হয় গার্নারের। তবে পুলিশ বলছে তার হাঁপানি ও হৃদরোগ ছিল। কিন্তু পরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা জানান, গার্নারকে হত্যা করা হয়েছে। গার্নারের মৃত্যুতে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ শুরু হয়। গার্নারের মৃত্যুর সময়কার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ তাকে হত্যা করেছে। ওই ঘটনার ফুটেজে দেখা যায় গার্নার বারবার কান্নাজড়ানো গলায় মিনতি করছেন, ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’ আর একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ, ড্যানিয়েল পান্টালিওকে দেখা যায় তার হাত দিয়ে গার্নারের গলা টিপে ধরে আছেন এমনভাবে যাতে তিনি দম নিতে না পারেন। দুজনেই মাটিতে ধস্তাধস্তি করছেন। ভিডিওটি প্রকাশ পেলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, যেখানে গার্নারের মৃত্যু হয়েছিল, ঠিক সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে মিছিলটি। এ সময় গার্নারের হত্যার বিচার চেয়ে স্লোগান দেয় বিক্ষোভকারীরা। ওই রাজ্যের গ্র্যান্ড জুরি রায় দেয় পুলিশ অফিসার পান্টালিওর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা আনা হবে না। এ ঘটনার পর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়।

 

পুলিশের সঙ্গে তর্ক তাতেই বুকে গুলি

২০১৪ সালের ঘটনা। মিসৌরির ফার্গুসনে শ্বেতাঙ্গ এক পুলিশের গুলিতে নিহত হন কলেজছাত্র ব্রাউন। বয়স মাত্র ১৮। শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ড্যারেন উইলসনের সঙ্গে সে এক বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে। এটুকুই ছিল তার অপরাধ। ওই পুলিশ অফিসার সরাসরি গুলি করে খুন করে ব্রাউনকে। এ ঘটনার পর ‘কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও মূল্যবান’ আন্দোলন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও জোরালো হয়ে ওঠে। এ ঘটনার পরই জাতিগত বৈষম্যের অভিযোগ তুলে সেখানকার হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নামেন। মিসৌরির ফার্গুসন এলাকার সহিংস বিক্ষোভ হয়। যে বিক্ষোভে মারা যান এক ব্যক্তি, আহত হন অনেক এবং কয়েকশ লোককে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। ওই বছরই নভেম্বর মাসে জুরি পুলিশ অফিসার ড্যারেন উইলসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সিদ্ধান্ত নাকচ করে দেওয়ার পর আবার প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলে এবং উইলসন পুলিশ বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।

 

ট্রেইভনকে গুলি করে হত্যা করেও  পার পেয়ে যায় পুলিশ

ট্রেইভন মার্টিন ছিল ১৭ বছর বয়সী একজন কৃষ্ণাঙ্গ স্কুলছাত্র। ফ্লোরিডার স্যানফোর্ডে জর্জ জিমারম্যান নামে একজনের গুলিতে সে প্রাণ হারায়। ঘের দেওয়া একটি এলাকায় ঢুকে পড়ে সে। মার্টিন তার আত্মীয়দের সঙ্গে যখন দেখা করতে ঢোকে, তখন ওই এলাকার একজন স্বেচ্ছাসেবক চৌকিদার হিসপ্যানিক জর্জ জিমারম্যান তাকে বাধা দেয়। আদালতে জুরি ২০১৩ সালে জিমারম্যানকে নির্দোষ বলে রায় দেয়। আমেরিকান আইনে জিমারম্যান বলতে পেরেছিল যে আত্মরক্ষার স্বার্থে সে গুলি চালিয়েছিল এবং সেটাই এ মামলায় তার পক্ষে যায়। কিন্তু তরুণ ট্রেইভনের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবরা সবসময় বলে এসেছে জিমারম্যান তাকে খুন করেছে। এ হত্যার ঘটনা থেকেই জন্ম নেয় ‘কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও মূল্যবান’ নামের সামাজিক আন্দোলন।

 

মাদকের খোঁজে গিয়ে টেলরকে আট গুলি পুলিশের

এ বছরের ১৩ মার্চের ঘটনা। ব্রেওনা টেলরকে আটটি গুলি করে হত্যা করে কেন্টাকির পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য, তারা অবৈধ মাদকের খোঁজে গিয়েছিল এক ফ্লাটে। পুলিশের সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী ব্রেওনা ছিলেন আসলে একজন প্রকৌশলী। কৃষ্ণাঙ্গ বলে তার কথায় কান দেয়নি পুলিশ। লুইভিলের কেন্টাকিতে ব্রেওনার ফ্ল্যাটে ঢুকে পুলিশ অফিসাররা তাকে আটবার গুলি করে। ওই বাসায় অবৈধ মাদক আছে- এমন খবরের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালাতে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু অনুসন্ধানে ব্রেওনার ফ্ল্যাটে কোনো মাদক পাওয়া যায়নি। এ ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ মানুষের বুঝতে বাকি থাকে না কৃষ্ণাঙ্গ বলেই পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে বেগ পেতে হয়নি। ব্রেওনা টেলরের পরিবারের ধারণা, পুলিশ আসলে ব্রেওনাকে খুঁজছিল না। কিন্তু তারা খুঁজছিল এমন এক সন্দেহভাজনকে যার সঙ্গে ব্রেওনার কোনোই সম্পর্ক ছিল না এবং সেই সন্দেহভাজন তখন পুলিশি হেফাজতেই ছিল। সেই ব্যক্তি কখনই ওই ফ্ল্যাটবাড়িতেই থাকত না।

 

পিটিয়ে হত্যার পরেও নির্দোষ রায় পুলিশকে

কৃষ্ণাঙ্গ ওয়াল্টার স্কটকে পিঠে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তখন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। পুলিশের শাস্তির দাবিতে সবাই যখন সোচ্চার তখন ফ্রেডি গ্রে নামের আরেক কৃষ্ণাঙ্গকে নির্মমভাবে পিটিয়ে জখম করে পুলিশ। এবারের ঘটনা ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল। মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোরে পুলিশ ২৫ বছর বয়সী যুবক ফ্রেড গ্রেকে আটকায়। তাকে সার্চ করে পাওয়া যায় ছুরি। পকেটে অস্ত্র বহন করার দায়ে পুলিশ তার ওপর চড়াও হয়। মারধর শুরুর পর আর থামেনি পুলিশ। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর তোলা ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ ভ্যানে তোলার সময় ফ্রেড গ্রে বাঁচার জন্য মিনতি করছিল। তার আর্তচিৎকারে পুলিশের কানের মাছিও নড়েনি। তাকে মেরে মেরুদন্ডে মারাত্মক জখম করে পুলিশ। হাসপাতালে ভর্তির পরই মারা যায় ওই যুবক। পকেটে ছুরি পাওয়ায় তাকে যেভাবে নির্যাতন করা হয় সে দৃশ্য সবাইকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ফ্রেড গ্রে মারা যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সহিংস প্রতিবাদ হয়। এ বিক্ষোভে পুলিশকে টার্গেট করে শুরু হয় মারামারি। এতে অন্তত ২০ জন পুলিশ অফিসার আহত হন। ফ্রেড গ্রেকে গ্রেফতার করে, পিটিয়ে হত্যায় ছয় পুলিশকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে তিনজনই আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হন আর বাকি তিনজনকে কখনো অভিযুক্তই করা হয়নি।

 

দৌড় দিতেই পিঠে তিনবার গুলি চালায় পুলিশ

ওয়াল্টার স্কট। আরেক কৃষ্ণাঙ্গকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে ২০১৫ সালে। সে বছর ৪ এপ্রিলের ঘটনা। ৫০ বছর বয়স্ক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি ওয়াল্টার স্কট সেই দুর্ভাগা। ঘটনাটি ঘটে দক্ষিণ ক্যারোলাইনার নর্থ চালর্সটনে। পুলিশ অফিসার মাইকেল স্ল্যাগারের কাছ থেকে নাকি ছুটে পালাচ্ছিলেন তিনি। পুলিশ একটুও দেরি না করে তার পিঠে তিনবার গুলি করে। গুলিতেই মারা যান স্কট। কী এমন হয়েছিল যে পুলিশ তিনটি গুলি ছুড়ে হত্যা করে তাকে? স্কট তার সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য অর্থ দিতে দেরি করেছিলেন। এ কারণে তার ওপর ছিল গ্রেফতারি পরোয়ানা। পুলিশ সেটা জানতে পারে এক গাড়ি দুর্ঘটনার পর। স্কটের গাড়ির ব্রেকের একটা আলো ভেঙে গিয়েছিল। পুলিশ তাকে তাড়া করে থামায়। পুলিশের ভাষ্য মতে,  গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়টি পুলিশ জেনে যাবে এই ভয়ে স্কট দৌড় দিয়েছিল। আর তাতেই তিন গুলি তার পিঠে! সিরিয়াল কিলারদের ধরতেও পুলিশের এমন গুলি করে হত্যার উদাহরণ সহজে পাওয়া যায় না। তাও পিঠে গুলি করে হত্যা, যখন স্কট ছিল নিরস্ত্র। এ ঘটনার পর কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যায় পুলিশের উৎসাহ আবারও সমালোচিত হয়। পুলিশ অফিসার স্ল্যাগারের ২০ বছরের কারাদন্ড হয় ২০১৭ সালে। নর্থ চালর্সটন কর্তৃপক্ষ ওয়াল্টার স্কটের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৬৫ লাখ ডলার দিয়েছিল। বিচার ও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার এমন নজির কমই আছে।

 

কারাগারের ডাক্তার জানায়, এটি আত্মহত্যা

২০১৫ সালের ১০ জুলাই ট্রাফিক আইন ভঙ্গের অভিযোগে টেক্সাসের শেরিফ ২৮ বছর বয়সী আফ্রিকান-আমেরিকান স্যান্ড্রা ব্ল্যান্ডকে গাড়ি থামাতে বলে। পুলিশ যখন তার দিকে আসছিল সান্ড্রা তখন একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। সান্ড্রা সিগারেট নিভিয়ে ফেলতে অস্বীকার করলে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে পুলিশ অফিসারের ওপর হামলার অভিযোগও আনা হয়। তিন দিন পর তাকে জেলের এক কক্ষে অসার অবস্থায় পাওয়া যায়। তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর বিক্ষোভ শুরু হয়। সে সময়ের এক ভিডিওতে দেখা যায়, সান্ড্রার মাথায় থাপ্পড় দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দেয় পুলিশ। পুলিশ স্যান্ড্রার ওপর নির্যাতন করেছে তা স্পষ্ট। ছোট একটা বিষয়ের জন্য তাকে গাড়ি থেকে বের হতে বলা এবং তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলা প্রমাণ করে পুলিশ তার ওপর চড়াও হয়েছিল। ভিডিওটিতে এও দেখা যায়, পুলিশ স্যান্ড্রাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। সান্ড্রাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেন পুলিশ ব্রায়ান। আর তিন দিন পর স্যান্ড্রার ফাঁসিতে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ব্ল্যান্ডের মৃত্যু নিয়ে নানা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় তিনি আত্মহত্যা করেছেন। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে স্যান্ড্রা আগে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানায় পুলিশ। তবে স্যান্ড্রা ব্ল্যান্ডের পরিবার পুলিশের এ দাবি অস্বীকার করে, পাল্টা পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনে। সান্ড্রাকে গ্রেফতার করা পুলিশ কর্মকর্তা ব্রায়ান ইনসিনিয়াকে আদালতে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু সান্ড্রাকে হত্যার জন্য কোনো অভিযোগ গ্রহণ করেননি আদালত। কারাগারের ডাক্তার এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে সাক্ষ্য দিলে মামলার সমাপ্তি টানা হয়।

সর্বশেষ খবর