বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

আফগানিস্তানে ধ্বংসের ইতিহাস

আবদুল কাদের

আফগানিস্তানে ধ্বংসের ইতিহাস

বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে আফগানদের যুদ্ধের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের। আফগানিস্তানের প্রাগৈতিহাসিক ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস জানান দেয় দেশটির রোমাঞ্চকর ও সাহসিকতার কথা। প্রথমে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শক্তি, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির সঙ্গে বরাবরই লড়াই করে গেছে আফগানরা। বিশ্বের সব পরাশক্তির সঙ্গে তালেবান গোষ্ঠীর লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি ধ্বংসপ্রায়। পাঠকের জন্য রইল আফগানিস্তানে ধ্বংসের ইতিহাস।

 

হাজার বছরের সংকটে আফগান

আফগানিস্তানের ইতিহাস-ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নতাত্তি¡ক স্থান খনন করে দেখা গেছে, দেশটির উত্তর অংশ অর্থাৎ আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে মনুষ্য বসতি ছিল। ধারণা করা হয়, আফগানিস্তানের কৃষি খামার বিশ্বের প্রাচীন খামারগুলোর একটি। আফগানিস্তানের ইতিহাসে বহু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- গ্রেকো-বারট্রিয়ান, কুশান, হেফথালিটিস, কাবুল শাহী, সাফারি, সামানি, গজনবী, ঘুরি, খিলজি, কারতি, মুঘল ও সবশেষে হুতাক ও দুররানি সাম্রাজ্য। দেশটির ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রাক ইসলামী শাসনামলের পূর্বে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের পর মধ্য এশিয়া থেকে এখানে লোক আসতে শুরু করে। যারা অধিকাংশ ছিল আর্য, যারা ইরান ও ভারতেও বসতি স্থাপন করেছিল। তখন এলাকাটির নাম ছিল আরিয়ানা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পারস্য সাম্রাজ্য প্রাচীন আরিয়ানা দখল করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে মহামতি আলেকজান্ডার পারস্যের সম্রাটকে পরাজিত করে অঞ্চলটির পূর্ব সীমান্ত দখল করে নিতে সক্ষম হন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালের পর অর্থাৎ আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর অনেক রাজ্য তার এশীয় সাম্রাজ্যের দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। এদের মধ্যে সেলুজিত সাম্রাজ্য, বাকত্রিয়া সাম্রাজ্য ও ভারতীয় মৌর্য সাম্রাজ্য উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে মধ্য এশীয় কুশান জাতি আরিয়ানা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় থেকে অষ্টম শতাব্দী বৌদ্ধ ছিল এখানকার প্রধান ধর্ম। এরপর হুন নামের মধ্য এশীয় এক তুর্কি জাতি চতুর্থ শতাব্দীতে এসে কুশানদের পতন ঘটায়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে আরব সৈন্যরা আফগানিস্তানে নতুন ধর্ম ইসলাম নিয়ে আসে। পশ্চিমের হেরাত ও সিস্তান প্রদেশ আরবদের নিয়ন্ত্রণে আসে কিন্তু আরব সৈন্য চলে যাওয়া মাত্রই সেখানকার জনগণ তাদের পুরনো ধর্মে ফেরত যায়। দশম শতাব্দীতে বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারা থেকে সামানিদ নামের মুসলিম শাসক বংশ আফগান এলাকায় প্রভাব বিস্তার শুরু করে। তখন থেকে গজনীতে গজনবী রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯৯৮ থেকে ১০৩০ সাল পর্যন্দ গজনীর রাজা মাহমুদ গজনবী আফগান শাসন করেন। রাজা মাহমুদ গজনবীর মৃত্যুর পর গজনীর প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। ১২শ শতাব্দীতে পশ্চিম-মধ্য আফগানিস্তানের ঘুর শহরে ঘুরি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা আবার ১২১৫ সালে মধ্য এশিয়ার খোয়ারিজমি শাহদের কাছে পরাজিত হন। ১২১৯ সালে চেঙ্গিস খান খোয়ারিজমি শহর হেতাত ও বালখ এবং বামিয়ানে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন। ১৪শ শতাব্দীর শেষে মধ্য এশীয় সেনাপতি তৈমুর লং আফগানিস্তান জয় করেন ও ভারতে অগ্রসর হন। যদিও তৈমুরের সন্তান ও পৌত্রেরা তার সাম্রাজ্যর পুরোটা ধরে রাখতে পারেনি। ১৬শ শতাব্দীর শুরুতে ১৫০৪ সালে তৈমুর লং-এর বংশধর জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবর আরঘুন রাজবংশের নিকট থেকে কাবুল দখল করেন। তারপর ১৫২৬ সালে তিনি ভারতে গিয়ে দিল্লি সালতানাতে আক্রমণ চালিয়ে লোদি রাজবংশকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। ১৬শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর পুরোটাজুড়ে ভারতে অবস্থিত মুঘল সাম্রাজ্য, উজবেক বুখারা খানাত এবং পারস্যের সাফাভি রাজবংশের রাজারা আফগানিস্তানের দখল নিয়ে যুদ্ধ করেন। ১৭০৯ সালে স্থানীয় ঝিলজাই গোত্রের নেতা মিরওয়াইস হুতাক সাফাভিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং গুরগিন খানকে পরাজিত করে স্বাধীন আফগানিস্তান স্থাপন করেন। মিরওয়াইস ১৭১৫ সালে মারা যান এবং তার স্থলে তার ভাই আবদুল আজিজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। মিরওয়াইসের পুত্র মাহমুদ হুতাক তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য হত্যা করে। মাহমুদ ১৭২২ সালে পারস্যের রাজধানী ইস্পাহানে আক্রমণ চালান এবং গুলনাবাদের যুদ্ধের পর নগরীটি দখল করে নিজেকে পারস্যের রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন। ১৭৪৭ সালে আহমদ শাহ দুররানি কান্দাহার শহরকে রাজধানী করে এখানে দুররানি সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। ১৭৭২ সালে দুররানির মৃত্যু হয়। তার পুত্র তৈমুর শাহ দুররানি তার স্থলাভিষিক্ত হন। এই সময় থেকে আফগানিস্তান প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে অনেক অঞ্চল হারাতে শুরু করে। ১৭৯৩ সালে তৈমুরের মৃত্যুর পর তার পুত্র জামান শাহ দুররানি ক্ষমতায় আসেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে মাহমুদ শাহ দুররানি, সুজা শাহ ও অন্যরা সিংহাসনে আরোহণ করেন।

 

রাশিয়া ও আফগানিস্তানের দীর্ঘ যুদ্ধ

১৯৭৮ সালের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ খানের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন বামপন্থি সামরিক কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ তারাকির বাহিনী। এরপর ক্ষমতা ভাগাভাগি হয় মার্ক্স ও লেনিনপন্থি দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে। পিপলস পার্টি ও ব্যানার পার্টি একসঙ্গে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে আবিভর্‚ত হয়। ওই সরকারের জনপ্রিয়তা না থাকলেও মাথার ওপর ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আশীর্বাদ। বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতি ও শহুরে গোষ্ঠীগুলো নতুন সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে, যাদের বলা হয় মুজাহিদিন। তখন সরকারের মধ্যকার পিপলস ও ব্যানারের দুটি অংশের দ্ব›েদ্বর মধ্যে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে ৩০ হাজার সেনা নিয়ে প্রবেশ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। অল্প সময়ে ক্ষমতাচ্যুত হন পিপলস নেতা হাফিজুল্লাহ আমিন। ক্ষমতায় বসেন ব্যানার নেতা বাবরাক কারমাল। কিন্তু তিনিও জনপ্রিয় হতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মুজাহিদিনরা। ওই সময় মুজাহিদিনদের প্রতি পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও মুসলিম দেশগুলো সহানুভূতিশীল ছিল। ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে এবং সে দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হয়। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

 

তালেবানের উত্থান, চালায় ধ্বংসযজ্ঞ

১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিক। আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারকে রক্ষা করতে সে দেশে ঢুকে পড়ল সোভিয়েত সেনাবাহিনী। মস্কো তখন বলেছিল, সোভিয়েত সৈন্যরা ছয় মাস থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে দেশে সোভিয়েত সৈন্যরা ছিল দীর্ঘ ১০ বছর এবং আফগানিস্তান পরিণত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনামে। সে যুদ্ধের মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল তার বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠল আফগানিস্তান। আফগানিস্তানের সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভিতর দিয়েই জন্ম হয়েছিল তালেবান এবং আল-কায়েদার মতো জিহাদি বাহিনীগুলোর। তখন থেকে আফগানিস্তানে সশস্ত্র সংগঠনগুলো ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমে উঠেপড়ে লাগে। সে সময় তারা নৃশংস ধর্মান্ধতা চাপিয়ে আফগানিস্তানকে পেছনের যুগে ঠেলে দেয়। তখন ওই মুজাহিদিন তথা তালেবান যোদ্ধারা ইসলামী শাসনের নামে মহিলাদের বাড়িতে আটকে রাখে, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। আপদমস্তক বোরকা পরতে বাধ্য করে এমনকি বিনোদনমূলক কর্মকান্ডও বন্ধ করে দেয়। কেউ এসব কাজে জড়ালে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। তখন তারা আফগানিস্তানজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। ধ্বংসযজ্ঞ চালায় দেশটির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। ধুলিসাৎ হয় মানবতা।

 

আফগানিস্তানে বারবার দখলদারদের পতন

আফগানিস্তানের ইতিহাস থেকে জানা যায় দেশটির ইতিহাস, সাধারণ মানুষ আর ঐতিহ্যের কথা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিকে বারবারই হতে হয়েছে বিদেশি পরাশক্তিগুলোর হামলার শিকার। খ্রিস্টপূর্ব থেকে আজকের আফগানিস্তান, কালে কালে অন্য দেশের সম্রাট ও রাজাদের আক্রমণে জর্জরিত। বহু সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন দেখেছে আফগান। প্রাচীনকাল থেকে এসব হামলার বর্ণনা পাওয়া যায় ইতিহাসবিদদের লেখনী এবং প্রত্নতত্ত¡বিদদের নানা পরীক্ষায়। প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধকে (১৮৩৮-১৮৪২) আফগানিস্তানের দীর্ঘ ইতিহাসের একটি অশ্রুসিক্ত অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৩৮ সালে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল জর্জ ইডেন (লর্ড অকল্যান্ড) সিমলা মেনিফেস্টো ঘোষণার মাধ্যমে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আক্রমণের কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল ভারতীয় ভূখন্ডকে আফগানিস্তান ও তার মিত্রদের থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু ব্রিটিশরা কাবুলের শাসক দোস্ত মোহাম্মদ খান ও তার সহযোগীদের সরাতে চেয়েছিল। আরও পরিষ্কার করে বললে প্রাক্তন আফগান বাদশাহ শাহ শুজা দুররানি এবং দেশটির প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শাহ দুররানির নাতিকে কাবুলের শাসনভার দিতে চেয়েছিল ব্রিটিশরা। তবে পরবর্তীকালে সার্বভৌমত্ব রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে আফগানরা ব্রিটিশ ও রাশিয়ানদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। এরপর ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। বলা হয়, আফগানিস্তানের সেই যুদ্ধই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার জন্য অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবান সরকারকে দায়ীদের তাদের হাতে তুলে দিতে বলেছিল। কিন্তু সেবারও তালেবান ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। এর উপযুক্ত জবাব দিতে আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। পরের কয়েক মাসে আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী বাহিনী ‘দ্য নর্দান অ্যালায়েন্স’ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাহিনীর সহায়তায় কাবুলে হামলা চালিয়ে তালেবান সরকারকে উৎখাত করে। যদিও সে যুদ্ধ থেমে থাকেনি, চলেছে দীর্ঘ ২০ বছর। যুদ্ধে মূল টার্গেট তালেবান এবং আলকায়েদা হলেও দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে প্রাণ হারায় লাখ লাখ সাধারণ আফগান নাগরিক। ব্রিটিশদের পুতুল সরকার প্রধান ‘শাহ শুজা’ পরবর্তী সব বিদেশি সরকারের মনোনীত শাসকের পরিচয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯৮০ দশকে সোভিয়েত মনোনীত বাবরাক কারমাল আফগানদের কাছে ‘শাহ শুজা দ্য সেকেন্ড’ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তী সময় শতাব্দীর শুরু অর্থাৎ ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে তাদের মনোনীত হামিদ কারজাইকে ক্ষমতা প্রদান করে। হামিদ কারজাই পরিচিত ছিল ‘শাহ শুজা দ্য থার্ড’ নামে।

 

আফগানিস্তানের মাটিতে মার্কিন সেনাদের দুই দশক

টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জেরে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী আফগানিস্তানে হামলা চালায়। প্রথমে তালেবানরা মার্কিন সৈন্যদের দ্বারা নিশ্চিহ্ন হতে চললেও ২০০৪/৫ সাল থেকেই তালেবান নামক সংগঠনটি পুনরায় সংগঠিত হয়। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি মার্কিন সেনা ও আফগান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে। এই যুদ্ধের বলি হতে হয়েছে অগণিত সাধারণ মানুষকে। দুই দশক ধরে চলা দীর্ঘ যুদ্ধের পুরোটা সময় মার্কিন সৈন্যদের তালেবান ও আলকায়েদাকে মোকাবিলা করেই থাকতে হয়েছে। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন ৩১ আগস্টের মধ্যে তথা নাইন-ইলেভেন দিবসের আগেই সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন। ঘোষণা অনুযায়ী, ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধে ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে। আফগান যুদ্ধে দেশটি তাদের হাজার হাজার সৈন্য হারিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটি আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আলকায়েদা এবং ওসামা বিন লাদেন যদি মার্কিনিদের উদ্দেশ্য হয়, তবে দুটো লক্ষ্য ১০ বছর আগে অর্জিত হয়েছে। তাহলে এতদিন পর কেন সেনা প্রত্যাহার করল? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থেই আফগানিস্তানে পশ্চিমা পরাশক্তি ঘেঁষা একটি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। যা অনেকটা ঔপনিবেসিক আমলের মতো। কিন্তু সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় এবং আপাতত সে লক্ষ্য পূরণের ন্যূনতম সম্ভাবনা না থাকায় এক রকম হতাশা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

 

তালেবান কারা?

১৯৮৯ সাল, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) সৈন্য প্রত্যাহারের পর যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, সেই যুদ্ধেই তালেবান গোষ্ঠীর উত্থান। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় ছিল তাদের দাপট। সংগঠনটি (তালেবান) আফগানিস্তানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে সংগঠনটি একই সঙ্গে আফগানিস্তানে ইসলামী অনুশাসনও চালু করে। ১৯৯৮ সাল নাগাদ তারা আফগানিস্তানের প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারা ইসলামী শরিয়া শাসনের পাশাপাশি চালু করে নিষ্ঠুর শাস্তির প্রচলন। পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং মেয়েদের বোরকা পরতে বাধ্য করা হয়। সে সময় থেকে নিষিদ্ধ করা হয় টিভি, সংগীত এবং সিনেমা। আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর তারা পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় নতুন করে সংগঠিত হয়। তাদের প্রায় ৮৫ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা আছে বলে মনে করা হয়।  ২০০১ সালের পর তারা এখন সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় আছে।

 

ইসলামী রাষ্ট্রের নামে ধ্বংসযজ্ঞ

যুক্তরাষ্ট্র তাদের দীর্ঘতম যুদ্ধের সমাপ্তি টেনে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিয়েছে। দেশটি তাদের হাজার হাজার সেনা হারিয়েছে। এ ছাড়াও লাখ লাখ আফগান সেনা এবং বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু পর্যবেক্ষণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধে ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে। তবে এতে আফগানিস্তানের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেনি। বরং পরিস্থিতি ক্রমেই আরও খারাপ হতে চলেছে। দেশটিতে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছে তালেবান সশস্ত্র গোষ্ঠী। ধর্মের নামে তারা প্রাচীন স্থাপনা ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারী এবং তাদের উপাসনালয় ধ্বংস করে চলেছে। আজকের সাধারণ আফগানদের জীবন ২০০১ সালের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপত্তাহীন। ২০০১ সালে যখন দেশটিতে মার্কিন সেনা মোতায়েন শুরু হয়, তখনকার তুলনায় গত বছর নাগরিক হতাহত প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি দেখা গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতা অনেক বেড়েছে। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিতে সামরিক হামলা নিয়ে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে তালেবান। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও আফগান কর্মকর্তাদের মতে, তালেবানের ইতিহাসে শুধুই বর্বরতা। ইসলামী শাসন কায়েমের নামে মানুষ হত্যা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা, প্রাচীন স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়াসহ নানা অপরাধমূলক কাজ করে চলেছে দেশটির সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী। আফগানিস্তানের কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোকে জানিয়েছে, তালেবানরা ক্ষমতায় এলে তাদের পূর্ববর্তী শাসনামলের মতোই তারা নৃশংস ধর্মান্ধতা চাপিয়ে আফগানিস্তানকে আবার কয়েক যুগ পেছনে ঠেলে দেবে। তালেবানরা ইসলামী শাসনের নামে মহিলাদের বাড়িতে আটকে রাখবে, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেবে এবং ভুল পোশাক পরিধান বা ভুল সংগীত শোনার মতো পাপের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করবে। মানবতা হারাবে প্রাচীনতম দেশটি।

 

তালেবান এখনো কীভাবে শক্তিশালী?

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও আফগানিস্তানের কর্মকর্তাদের মতে, তালেবান যেভাবে আফগান শহর দখল করছে, তাতে ভবিষ্যৎ বিশ্ব বেশ হুমকির মুখে রয়েছে। আর তালেবান গোষ্ঠীর শক্তির উৎস সম্পর্কে গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে অজানা। জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের ধারণা, তালেবানের অর্থের উৎস অস্পষ্ট। জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের ধারণা, তালেবানের বার্ষিক আয় ৩০ কোটি থেকে ১৫০ কোটি ডলার হতে পারে। তাদের আয়ের বড় অংশ আসে মাদক ব্যবসা থেকে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এবং দখল করা এলাকা থেকে কর আদায়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তারা। আবার তালেবানের শক্তিমত্তা সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। তবে গত বছর জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের পর্যবেক্ষকরা বলেন, সশস্ত্র সংগঠনটির ৫৫ থেকে ৮৫ হাজার যোদ্ধা রয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের পর্যবেক্ষকদের মতে, এখন পর্যন্ত যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তাতে স্পষ্ট যে, জনবল, অর্থ, অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য তালেবানকে বেগ পেতে হয় না। অভিযোগ রয়েছে, পাকিস্তান, ইরান ও রাশিয়া তালেবানকে রসদ ও পরামর্শ দিচ্ছে। তবে দেশ তিনটি এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

 

যুদ্ধে ধ্বংস ঐতিহাসিক স্থাপনা

মাত্র কয়েক দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে নিজের ও ন্যাটো বাহিনী সরিয়ে নিয়েছে। এরই মধ্যে আফগানিস্তানের ২৯টি প্রদেশের ১১৬টি জেলা নিজেদের দখলে নিয়েছে তালেবান। দেশটির এক সরকারি কর্মকর্তা দাবি করেছে, ১১৬টি জেলা দখল করার সময় তালেবান ধ্বংস করেছে নানা সরকারি স্থাপনা। বাজার মূল্য হিসেবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার। তালেবানের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর ২৬০টি সরকারি ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। ২০০১ সালে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আক্রমণের পরও বেপেরোয়া হয়ে উঠেছিল তালেবান বাহিনী। সে সময়ও তারা একের পর এক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল দেশটির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে। আফগানিস্তানের গৌরবোজ্জ্বল অতীত এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নীরব সাক্ষী যেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বুদ্ধের মূর্তি দুটি। ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধদের অন্যতম কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় এই বামিয়ান। কয়েক হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুর বসবাস ছিল তখন এই উপত্যকায়। আফগানিস্তানের এই বৌদ্ধ মন্দিরটিকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্তি¡ক নিদর্শনের স্বীকৃতি দিয়েছিল ইউনেস্কো। ২০০১ সালে হামলা চালিয়ে এটি প্রায় ধ্বংস করে দেয় তালেবান বাহিনী। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের ইসলামিক এবং প্রাক-ইসলামিক বহু স্থাপনা ধ্বংসের খেলায় মেতেছে তালেবান বাহিনী। প্রথম অ্যাংলো-আফগান, দ্বিতীয় সোভিয়েত-আফগান এবং তৃতীয় যুক্তরাষ্ট্র-আফগান যুদ্ধে দেশটির বহু প্রাচীন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে। তালেবানদের দাবি, তারা ইতিমধ্যে আফগানিস্তানের ৮৫ ভাগের বেশি এলাকা দখল করেছে। যদিও এটা নিয়ে ব্যাপক বিতর্কও আছে। তবে এটা ষ্পষ্ট যে, আফগান সেনারা দেশটিতে তালেবান বাহিনীর অগ্রগতি থামাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে। এমতাবস্থায় দেশটির প্রত্নতাত্তি¡ক বিশেষজ্ঞরা বলছে, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আফগানিস্তানের প্রাচীন ঐহিত্য। তালেবান পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে এ দেশটির সব প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করে দেবে তালেবান। হারিয়ে যাবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে।

 

বিশ্বজুড়ে আফগান শরণার্থীদের ঢল

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালে বিশ্বে গড়ে প্রতিদিন ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এতে প্রতি দুই সেকেন্ডে বাস্তুচ্যুত হয়েছে একজন। সব মিলিয়ে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ১০ লাখ, যা এ যাবৎকালের রেকর্ড। জাতিসংঘ বলছে, এসব শরণার্থীদের মধ্যে আফগান নাগরিকই বেশি। ১৯৭৯ সালের সোভিয়েত ও আফগান বড় ধরনের সেই লড়াইয়ে ২৮ লাখ আফগান পাকিস্তানে এবং ১৫ লাখ আফগান ইরানে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। ১০ বছর ধরে চলা সেই যুদ্ধ শেষে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বিদায় নেয়। এরপর কেটে যায় আরও ১০ বছর। টুইন টাওয়ারে হামলার জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের উৎখাতের পর ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ দেশে ফিরে গেছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, এখনো প্রায় ২০ লাখের বেশি আফগান নাগরিক পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের শরণার্থী শিবিরে জীবনযাপন করছে। বর্তমান সহিংসতার কারণে যাদের অনেকেই দেশে ফেরার ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহী নয়।

সর্বশেষ খবর