বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

দুনিয়া কাঁপানো যত ভূমিকম্প

আবদুল কাদের

দুনিয়া কাঁপানো যত ভূমিকম্প

ভূমিকম্পের পূর্বাভাস খুবই জটিল। তবে এর তীব্রতা বোঝার জন্য কম্পনের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সেক্ষেত্রে ব্যবহৃত যন্ত্রের নাম সিসমোগ্রাফ। মাটির নিচে কম্পন সৃষ্টি হলে এই সিসমোগ্রাফে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল, সময়কাল ও স্থায়িত্বকাল নির্ধারণ করা হয়। অন্যদিকে বিপর্যস্ত ঘটনাস্থলের অবস্থান এবং জনসংখ্যার ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে ক্ষয়ক্ষতির (মৃতের সংখ্যা) নির্ধারণ করা হয়। প্রযুক্তির কল্যাণে অতীতে অনেক ভূমিকম্পের ভয়াবহতা রেকর্ড করা হয়েছে। তবুও মানব সভ্যতা এমন কয়েকটি ভূমিকম্প দেখেছে, যেসব দুর্যোগে প্রায় ২৫ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়। তথ্য বলছে, মানব ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পের নয়টি সংঘটিত হয়েছিল এশিয়া মহাদেশেই। আর ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি দেখেছে এশিয়ার দেশ চীন

 

 

তুরস্ক-সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্প

ভূমিকম্প, প্রকৃতির অন্যতম শক্তিশালী দুর্যোগ, যা মানব ইতিহাসে ব্যাপকভাবে ধ্বংসযজ্ঞ এবং প্রাণহানির ক্ষমতা রাখে। ভূ-তাত্ত্বিকদের ভাষ্য, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা যদি ৭ কিংবা ৮ হয় তবে তা প্রাণঘাতী ভূমিকম্প হয়। এ মাত্রার ভূমিকম্পগুলো তীব্রভাবে আঘাত হানে এবং এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়। তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সোমবার স্থানীয় সময় অনুযায়ী ভোর ৪টায় কেঁপে ওঠে তুরস্ক এবং সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা। রিখটার স্কেলে সেই কম্পনের মাত্রা ছিল ৭.৮। কম্পনের উৎসস্থল ছিল দক্ষিণ তুরস্কে। গাজিয়ানতেপ প্রদেশের পূর্ব দিকে নুরদাগি শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার পুবে ভূগর্ভের প্রায় ১৮ কিলোমিটার গভীরে। প্রথম কম্পনের ১১ থেকে ১৫ মিনিটের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার কেঁপে ওঠে লেবানন, সিরিয়া এবং সাইপ্রাসের বিভিন্ন অংশ। দেড় মিনিট পর্যন্ত তার কম্পন অনুভূত হয়। কম্পনের জেরে ভেঙে পড়তে থাকে একের পর এক বহুতল এবং বাড়ি। সেই ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই আরও দুবার কেঁপে ওঠে সিরিয়া এবং তুরস্কের বিস্তীর্ণ এলাকা। ফলে বিপদ আরও বেড়ে যায়। বর্তমানে মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে।

 

ভূমিকম্প কেন এত ভয়াবহ

প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ভূমিকম্পে নিহত মানুষের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭.৮। ভূমিকম্পে তুরস্কের প্রায় ১০০ কিলোমিটার ফল্ট লাইন ভেঙে গেছে। এ কারণেই সৃষ্ট ভূমিকম্পটি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইনস্টিটিউট ফর রিস্ক অ্যান্ড ডিজাস্টার রিডাকশনের প্রধান অধ্যাপক জোয়ানা ফউর ওয়াকার বলেন, এ রকম প্রাণঘাতী ভূমিকম্প গত ১০ বছরে দুটি ও তার আগের ১০ বছরে চারটি হয়েছে। তবে শুধু কম্পনের কারণেই এই ক্ষয়ক্ষতি হয় না। দেশটিতে থাকা নাজুক ভবনগুলোও প্রভাব ফেলেছে। তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পটি আঘাত হেনেছে ভোরে, তখন প্রায় সব মানুষই ঘুমে ছিলেন। এ কারণে ভবন ধসে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। দক্ষিণ তুরস্ক এবং বিশেষ করে সিরিয়ায় অবকাঠামোগুলো বেশির ভাগই ধসে গেছে। এ কারণে আটকে পড়াদের জীবন বাঁচানো এখন নির্ভর করছে তাদের প্রতিক্রিয়া ও উদ্ধারকাজের ওপর। জীবিত ব্যক্তিদের উদ্ধারের জন্য পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ। ৪৮ ঘণ্টা পর বেঁচে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক কমে যায়।

 

ভূমিকম্পে ভাগ হয়ে গেল বিমানবন্দর

২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পর পর তিনবার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে তুরস্ক ও সিরিয়ায়। এর জেরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও হয়েছে অনেক। বাদ যায়নি বিমানবন্দরও। ইতোমধ্যে নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়েছে একটি ছবি। ভূমিকম্পের কবলে বিধ্বস্ত ওই বিমানবন্দরের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা হয়। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে ছবি ও ভিডিও। যা তুরস্কের হাতাই প্রদেশের বিমানবন্দরে বিপর্যয়ের ছবি। ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার জানিয়েছে, প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, ভূমিকম্পের চাপে আড়াআড়িভাবে ওই বিমানবন্দরের রানওয়েতে ফাটল ধরেছে। দুই পাশ থেকে উঁচু হয়ে ফাটল বরাবর উঠে এসেছে সেই রাস্তা। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওই বিমানবন্দরটি বর্তমানে ব্যবহারের অযোগ্য। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান জানিয়েছেন, বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সোমবারের ভূমিকম্পটি তুরস্কের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সংকট মোকাবিলায় বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বিপর্যয় মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ চিকিৎসক দল এবং ত্রাণ পাঠানো শুরু করেছে।

 

 

আশখাবাদ ভূমিকম্প [তুর্কমেনিস্তান]

মাত্রা রেকর্ড : ৭ দশমিক ৩

১৯৪৮ সালের ৬ অক্টোবর; সকাল গড়িয়ে দুুপুর তখন ০১:১২ মিনিট। হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক ভূমিকম্পের তীব্রতার সাক্ষী হয় তুর্কমেনিস্তান। উৎপত্তিস্থল রাজধানী শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট একটি গ্রাম। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, সে সময় ওই ভূমিকম্পের তীব্রতা ৭ দশমিক ৩ মাত্রা রেকর্ড করা হয়। তাতে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল দেশটির রাজধানী আশখাবাদ। এতে অঞ্চলটির বিভিন্ন গ্রাম মোটামুটি ধ্বংস হয়ে যায়। বিশেষ করে বেশিরভাগ ইট-পাথরের ভবন ধসে পড়ে। নিমিষে মাটিতে মিশে যায়। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হওয়ায় এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানির প্রকৃত সংখ্যাটা জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, আশখাবাদের ওই ভূমিকম্পে ১ লাখ ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।

 

গ্রেট কান্টো ভূমিকম্প [জাপান]

মাত্রা রেকর্ড : ৭ দশমিক ৯

আজ থেকে ১০০ বছর আগের ঘটনা। জাপান তাদের স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প দেখেছিল ১৯২৩ সালে। ওই বছরের পয়লা সেপ্টেম্বর সকাল ১১:৫৮ মিনিট; জাপানের রাজধানীসহ বেশ কয়েকটি শহরে ভূমিকম্পের প্রথম আঘাতটি আসে। উৎপত্তিস্থল ছিল রাজধানী টোকিও থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের সাগামি উপসাগর অঞ্চল। এর তীব্রতা ছিল ৭ দশমিক ৯ এবং স্থায়িত্বকাল ছিল চার থেকে দশ মিনিট। ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে, ফিলিপাইন সমুদ্রের প্লেট সাগামি ট্রাফের লাইন বরাবর ওখোৎস্ক প্লেটের ফেটে ফেটে এই বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। এই ভূমিকম্পের আঘাতে রাজধানী টোকিওসহ বেশ কয়েকটি শহর ব্যাপকভাবে কেঁপে উঠেছিল। ধ্বংস হয়েছিল অসংখ্য দালান। এরপরই সাগামি উপসাগরে ৪০ ফুট উঁচু সুনামি  উপকূলে আঘাত হানে। ভূ-কম্পনে সৃষ্ট অগ্নিকান্ড টোকিও শহরের কেন্দ্রস্থল রিকুগুন হোনজো হিফুকুশোকে গ্রাস করে ফেলে। সেখানে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার মানুষ অগ্নিকান্ডে প্রাণ হারান। গণমাধ্যমসূত্র বলছে, সে সময় সৃষ্ট সুনামির বাতাসে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভূমিকম্পের কারণে বিভিন্ন ভবনে অগ্নিকান্ডে অগ্নিদগ্ধ হয় ৩ লাখ ৮১ হাজার মানুষ। ৬ লাখ ৯৪ হাজার বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। আনুমানিক ১ লাখ ৪২ হাজার ৮০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।

 

আরদাবিল ভূমিকম্প [ইরান]

মাত্রা রেকর্ড : অজানা

৮৯৩ সালে ইরান ভয়াবহ এক ভূমিকম্পের শিকার হয়েছিল। যদিও ভূমিকম্পের কারণে সে সময় কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়নি। এমনকি এর তীব্রতা আজও অজানাই থেকে যায়। তবে কথিত আছে, আনুমানিক ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ ওই ভূমিকম্পে প্রাণ হারান। ১৯৯৭ সালেও এই এলাকায় আরেকটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে।

 

দামহান ভূমিকম্প [ইরান]

মাত্রা রেকর্ড : ৭ দশমিক ৯

সময়টা ৮৫৬ সালের ২২ ডিসেম্বর। তৎকালীন ইরানীয়রা ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূ-কম্পনের সাক্ষী হয়। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর দামহানে এই ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। উৎপত্তিস্থল ছিল পারস্য অঞ্চলের কুমিস প্রদেশ। এ কারণেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ভূমিকম্পটি স্থানীয়দের কাছে কুমিস ভূমিকম্প নামেও পরিচিত। ৩৫০ কিলোমিটার বা ২২০ মাইল এলাকাজুড়ে তান্ডব চালায়। ধ্বংস করে অসংখ্য জনপদ। ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে, দেশটি আরব পাত ও ইউরেশীয় পাতের মধ্যে মহাদেশীয় সংঘর্ষের জটিল অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত। সে কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলটির আল্পাইড বেল্টের স্থানান্তরের ফলে দামহান ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয় ঘটেছিল। সেদিন ২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।

 

হাইজুয়ান ভূমিকম্প [চীন]

মাত্রা রেকর্ড : ৮ দশমিক ৫

১৯২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর; চীনের গানসু প্রদেশকে ধ্বংস করে দেয় ৮ দশমিক ৫ মাত্রার প্রলয়ঙ্করী এক ভূমিকম্প। তৎকালে চীন স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিধসের মুখোমুখি হয়েছিল। যার ফলে প্রাণহানির সংখ্যাও বাড়তে থাকে হু হু করে। গণমাধ্যম সূত্র বলছে, সন্ধ্যা ৭:০৬ মিনিটে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। পরবর্তীতে আরও তিনবার মৃদুকম্পনে (আফটার শক) কেঁপে ওঠে চীনের গানসু প্রদেশ। গ্রাম থেকে শহর; সব বাড়ি-ঘর মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তথ্য বলছে, তৎকালীন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ অবকাঠামো ভেঙে পড়ে। সেবার ৬৭৫ বার রেকর্ড পরিমাণ ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। আনুমানিক ১ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারায় কেবল ভূমিধসের কারণে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়, ওই অঞ্চলে তখন ২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। তবে তৎকালীন চীনা সরকার জানিয়েছে, সংখ্যাটি ২ লাখ ৭৩ হাজারেরও বেশি।

 

হাইতিয়ান ভূমিকম্প [হাইতি]

মাত্রা রেকর্ড : ৭ দশমিক ৯

২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি, বিকাল ৪:৫৩ মিনিটে ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র হাইতি প্রলয়ঙ্করী এক ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। ভয়ানক ওই কম্পনের উৎপত্তিস্থল ছিল হাইতির রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রাম। এর ফলে হাইতি এবং আশপাশের ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রাথমিকভাবে ভূমিকম্পটি ৭ মাত্রায় আঘাত হানে। তবে পরবর্তীতে দুটি মৃদু কম্পনে (আফটার শক) কেঁপে ওঠে গোটা ক্যারিবীয় দ্বীপ অঞ্চল। যার মাত্রা ছিল যথাক্রমে- ৫ দশকি ৯ এবং ৫ দশমিক ৫। এর কয়েকদিন পর ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত মৃদুকম্পন (আফটার শক্) চলতে থাকে। এত দেশটির বহু দালানে ফাটল এমনকি অনেক ভবন ভেঙে পড়ে। ভূ-পৃষ্ঠের মাত্র ১৩ কিলোমিটার গভীরে এই ভূমিকম্পনটির উৎপত্তি হয়েছিল। ভয়ানক এই ভূমিকম্প কেবল হাইতি এবং  ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র নয়, প্রতিবেশী কিউবা, জ্যামাইকা এবং পুয়ের্তো রিকোতেও অনুভূত হয়। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ভূমিকম্প পরবর্তী মৃদুকম্পন (আফটার শক) ধ্বংসজজ্ঞের ভয়াবহতা বাড়িয়ে তোলে। জানা গেছে, সে সময় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ কয়েক মাস গৃহহীন কাটিয়েছিলেন। ৩ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল।

 

আলেপ্পো ভূমিকম্প [সিরিয়া]

মাত্রা রেকর্ড : ৮ দশমিক ৫

১১৩৮ সালের ১১ অক্টোবর; উত্তর সিরিয়ার প্রাচীনতম আলেপ্পো শহরে আঘাত হানে ভূমিকম্প। সময়টা তখন মাত্র ভোর। ঠিক তখনই ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পটি নাড়িয়ে দেয় আলেপ্পোকে। ভূ-গবেষকদের মতে, আফ্রিকান প্লেট থেকে আরবীয় প্লেট আলাদা হওয়ার সময় এই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। এর আগের দিনও ছোট ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল। এই সতর্কতাকে মাথায় রেখে সে সময় আলেপ্পোর জনসংখ্যার অধিকাংশই শহর ছেড়ে চলে যায়। গবেষকদের মতে, শহর ছেড়ে না গেলে ভূমিকম্পে আরও প্রাণহানি ঘটতে পারত। গোটা একটি শহর মিশে যায় মাটির সঙ্গে। আলেপ্পোর দুর্গের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং স্থানীয় অসংভ্য বাড়িঘর ধসে পড়ে। ভূমিকম্পের ইতিহাসে ভূমিকম্পটিকে বলা হয় চতুর্থ ভয়ঙ্কর দুর্যোগ। ভূমিকম্পের ওই সকালে একটি গির্জায় প্রার্থনাকালীন ৬০০ মানুষ মারা যায়। ইতিহাসবিদদের মতে, ওই ভূমিকম্পে আড়াই লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।

 

সুমাত্রা ভূমিকম্প [ইন্দোনেশিয়া]

মাত্রা রেকর্ড : ৯ দশমিক ১

২০০৪ সালে ২৬ ডিসেম্বর; ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট ৯ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ইন্দোনেশিয়ার সামাত্রা প্রদেশে আঘাত হানে। পার্শ্ববর্তী মালদ্বীপ এবং থাইল্যান্ডেও ভূমিকম্পের ধাক্কা লাগে। অনেকে একে ক্রিসমাস বা বক্সিং ডে সুনামি নামেও চেনেন। ভূ-বিশ্লেষকদের অনেকেই এর মাত্রা ৯ দশমিক ৩ বলে দাবি করেন। জানা গেছে ভারত মহাসাগরের তলদেশে অস্ট্রেলিয়ান প্লেট থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি। ভূমিকম্পের ২০ মিনিট পর, ভারত মহাসাগর থেকে ১০০-ফুট উচ্চতার প্রলয়ঙ্করী ঢেউ উপকূল অঞ্চলগুলোয় আছড়ে পড়ে। নিমিষে পানির নিচে তলিয়ে যায় সুমাত্রা অঞ্চল। এর প্রভাব পড়ে ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ডেও। এতে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ রাতারাতি মারা যায়। অন্তত সাত বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভূমিকম্পটি আট মিনিট থেকে দশ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী ছিল বলে জানান বিশ্লেষকরা। এই ভূমিকম্পের আট ঘণ্টা পর, এর কেন্দ্রস্থল থেকে ৫ হাজার মাইল দূরে দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলেও সুনামিটি আঘাত হেনেছিল।

 

তাংসান ভূমিকম্প [চীন]

মাত্রা রেকর্ড : ৮ দশমিক ২

১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই; গভীর রাত। সময় তখন ৩:৪২ মিনিট। হঠাৎ ৭ দশমিক ৮ মাত্রা থেকে ৮ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে চীনের তাংসান এবং হেবেই অঞ্চলে। জানা গেছে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় চীন এশিয়ার অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ রাষ্ট্র। ওই ভূমিকম্পটি আড়াই গিগাট্রন শক্তিমত্তা নিয়ে আঘাত হানে। সে সময় তাংসানের জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখেরও বেশি। যাদের বেশিরভাগই ঘুমিয়ে ছিলেন। মাত্র দশ সেকেন্ডের ভূমিকম্পে পুরো একটি অঞ্চল ধ্বংস হয়ে যায়। মাত্র ২৩ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল ভূমিকম্পটি। তবে প্রলয়ঙ্করী ওই ভূমিকম্পে তাংসানের ৯০ শতাংশ অকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। কম্পন বন্ধ হওয়ার পর আগুন ধরে যায় অঞ্চলটিতে। ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে তখন শহরজুড়ে পানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভূমিকম্পে শহরের রেলপথ ধ্বংস হয়ে যায় এবং রাস্তাগুলো ধসে পড়ে। প্রাথমিক হিসেবে বলা হয়েছিল যে এই ভূমিকম্পে আড়াই লাখ মানুষ মারা যায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চীন সরকার পূর্ণাঙ্গ মৃত্যু তালিকা প্রকাশ করলে বিশাল মৃতের তালিকা দেখা যায়। প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল সেদিন।

 

ভালদিভিয়া ভূমিকম্প [চিলি]

মাত্রা রেকর্ড : ৯ দশমিক ৫

১৯৬০ সালের ২২ মে, চিলির ভালদিভিয়া অঞ্চলে প্রায় ৯ দশমিক ৫ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পটির শক্তিমত্তা ছিল প্রায় ১৭৮ গিগাট্রন এমনটিই জানিয়েছিলেন গবেষকরা। চিলির উপকূল থেকে প্রায় ১০০ মাইল (১৬০ কিমি) দূরে, ভালদিভিয়া শহরের সমান্তরালে আঘাত হানে। এটি প্রায় ১০ মিনিট স্থায়ী হয় এবং ২৫ মিটার (৮২ ফুট) পর্যন্ত ঢেউসহ একটি বিশাল সুনামি শুরু করেছিল। প্রধান সুনামি চিলির উপকূলকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছিল এবং প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে হাওয়াইয়ের হিলোকে বিধ্বস্ত করেছিল। প্রাথমিক ধাক্কাতে সেসময় প্রায়  ৬ হাজার মানুষ মারা যায়। আর্থিক ক্ষতি হয় এক বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ। পরে আঘাতপ্রাপ্ত অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয়েছেন প্রায় ৩ হাজার মানুষ। ২০ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়। ২০১৪ সালে চিলিতে আবার ভূমিকম্প আঘাত হানে। তখন দেশটিতে মানুষ মারা যায় মাত্র ছয়জন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম হয়। বিশ্লেষকদের মতে, নিয়ম মেনে অবকাঠামো নির্মাণ করায় ক্ষয়ক্ষতি কমে আসে।

 

তোহোকু ভূমিকম্প [জাপান]

মাত্রা রেকর্ড : ৯ দশমিক ৩

ভূমিকম্পের দেশ জাপানের তোহোকু অঞ্চল। ২০১১ সালের ১১ মার্চ, স্থানীয় সময় বিকাল ৫:৪৬ মিনিটে জাপানের উপকূলে একটি বিশাল সমুদ্রের তলদেশে মেগাথ্রাস্ট ভূমিকম্প আঘাত হানে। ৯ দশমিক শূন্য ৩ মাত্রার ভূমিকম্পে ১৫ হাজার ৮৭৮ জন মানুষ মারা যায়। আহত হয় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মানুষ। নিখোঁজ হন ৩ হাজার মানুষ। ভূমিকম্পে বিমানবন্দর, সড়ক ও রেলপথ ধ্বংস হয়েছে, ২৯০টি ভবন সম্পূর্ণভাবে ধসে গেছে। ৭৮৮টি ভবন অর্ধেকটি ধসে পড়ে। ৯৮৯টি ভবন আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশটির একটি পারমাণবিক স্থাপনা মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং ভয়ানক তেজস্ক্রিয় পদার্থ বায়ুতে ছড়িয়ে যায়। এর জেরে কানাডা এবং হাওয়াইয়েও ছোঁয়া লাগে।

 

কামকাটকা ভূমিকম্প [রাশিয়া]

মাত্রা রেকর্ড : ৯ দশমিক ২

১৯৫২ সালের ৪ নভেম্বর বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়। ঘটনাটি ঘটে রাশিয়ার কামকাটকা উপদ্বীপে। এটি ৫০ ফুট পর্যন্ত ঢেউসহ একটি দুর্দান্ত ধ্বংসাত্মক প্রশান্ত মহাসাগরীয় সুনামি তৈরি করেছিল। যা কামকাটকা উপদ্বীপ এবং কুরিল দ্বীপপুঞ্জের ব্যাপক ক্ষতি করে। আনুমানিক ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। এটি হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জেও খুব ক্ষতিকর ছিল, তবে সুনামির জন্য দায়ী কোনো মানুষের মৃত্যু হয়নি। ঢেউগুলো পেরু, চিলি এবং নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিল। আলাস্কা, অ্যালেউটিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং ক্যালিফোর্নিয়ায়, ৪.৬ ফুট পর্যন্ত সুনামি ঢেউ লক্ষ্য করা গেছে। এ ছাড়াও রাশিয়ার কামকাটকা উপদ্বীপে অনেক আগ্নেয়গিরি সক্রিয় ছিল এবং এখানে ১৯২৩ সালে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাত হেনেছিল।

 

শানসি ভূমিকম্প [চীন]

মাত্রা রেকর্ড : ৮ দশমিক ০

চীনের শানসি প্রদেশের এই ভূমিকম্পটিকে বলা হয় ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর ভূমিকম্প। ১৫৫৬ সালের ২৩ জানুয়ারি চীনের শানসি প্রদেশকে কেন্দ্র করে ভূমিকম্পটি মোট ৯৭টি দেশে একযোগে আঘাত হেনেছিল। বেশ কয়েকটি দেশের সমতল ভূমি প্রায় ২০ মিটার ডেবে গিয়েছিল। ৮ দশমিক শূন্য মাত্রার এই ভূমিকম্পটির শক্তিমত্তা এক গিগাট্রন হওয়া সত্ত্বেও এতে প্রায় সাড়ে আট লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। যদিও কম্পন মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল, তবে শক্তিশালী ভূমিকম্পটি পাহাড় সমতল করে দেয়। নিভে যাওয়া আগ্নেয়গিরি আবারও প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়, এমনকি নদী তার গতিপথও পরিবর্তন করে ফেলেছিল। এর প্রভাবে পৃথিবীতে ৬৬ ফুট গভীর পর্যন্ত ফাটল দেখা গেছে। ভূমিধস অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং প্রতিটি কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। পরবর্তী ছয় মাসব্যাপী মৃদুকম্পন (আফটার শক) দেখা গিয়েছিল চীনের বেশ কয়েকটি শহরজুড়ে।

 

► ২৪ আগস্ট ২০১৬

ইতালিতে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় অন্তত ২৯৮ জন। ওই ভূমিকম্পে মূলত প্রাচীন শহর অ্যামাট্রিস প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় শত বছরের ঐতিহাসিক ভবন।

 

► ১৬ এপ্রিল ২০১৬

ইকুয়েডরে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৬৫০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়। এ ছাড়া আহত হয় ১৬ হাজারের বেশি মানুষ। ধ্বংস হয়ে যায় ৭ হাজার ভবন।

 

► ২৬ অক্টোবর ২০১৫

আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প। এতে পাকিস্তানে প্রাণ হারায় অন্তত ৪০০ মানুষ। পাকিস্তান ছাড়াও ভারতের উত্তরাঞ্চল ও তাজিকিস্তানেও ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

 

► ২৫ এপ্রিল ২০১৫

নেপালে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৮ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে। ১৯৩৪ সালের পর দেশটিতে এটাই সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা। তখন পাহাড়ি এলাকায় ৯৮ শতাংশ ঘরবাড়িই ধ্বংস হয়ে যায়।

 

► ৩ আগস্ট ২০১৪

চীনের ইউনান প্রদেশে ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় ৬০০-এর মতো মানুষ। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। ঘটে ভূমিধসের ঘটনা। আহত হয় ২ হাজার ৪০০ মানুষ।

 

► ১৫ অক্টোবর ২০১৩

ফিলিপিন্সে বোহোল ও কেবু নামক এলাকায় ৭.২ মাত্রার ভূমিকম্পে ২০০-এর বেশি মানুষ প্রাণ হারায়।

 

► ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩

পাকিস্তানে আঘাত হানে ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্প। দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ বেলুচিস্তানে এ ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রাণ হারায় ৩০০-এর বেশি মানুষ।

 

► ১১ আগস্ট ২০১২

ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভয়াবহ দুটি ভূমিকম্পে ২৫০ জন মানুষ প্রাণ হারায়, আহত হয় ২ হাজারেরও বেশি।

 

► ২৩ অক্টোবর ২০১১

তুরস্কে ৭.২ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় ২০০-এর বেশি মানুষ, আহত হয় অন্তত ১ হাজার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এরকিস শহর, সেখানে বহু ভবন ধসে পড়ে, আহত বেশিরভাগই ওই শহরের বাসিন্দা।

 

► ১১ মার্চ ২০১১

জাপানে ৮.৯ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায় বা নিখোঁজ হয়। ওই ভূমিকম্পের ফলে ভয়াবহ সুনামিও আঘাত হানে দেশটির উপকূলে।

 

► ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১১

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে ১৬০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়, ১০ হাজার বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

 

► ১৪ এপ্রিল ২০১০

চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় কিনঘাই প্রদেশে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত হয় অন্তত ৪০০ মানুষ।

সর্বশেষ খবর