মঙ্গলবার, ১২ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

জিতবেই বাংলাদেশ

সৈয়দ বোরহান কবীর

জিতবেই বাংলাদেশ

বাংলাদেশকে কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে। পাশের লোকটি মনে হয় দুর্বৃত্ত। একটু পরই হয়তো এক লম্বা ছুরি বের করে গলাটা শরীর থেকে আলাদা করবে। একটু দূরে দাঁড়ানো লোকটা যেন মানববোমা, এখনই ফাটলে লুটিয়ে পড়বে অনেক নিরীহ প্রাণ। বনানী থেকে গুলশান রাস্তায় ব্যারিকেড নিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। এটা কি বাংলাদেশ নাকি পাকিস্তান? কোনো চপল তরুণের চাপা দাড়ি দেখে ভড়কে যাই। এই তরুণই কি নিবরাস, রোহানের মতো কেউ? বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো এ দেশের মানুষের হাসি। চরম বিপদের মধ্যেও মানুষ হাসে। বন্যায় সবকিছু নষ্ট হওয়ার পরও মানুষ হাসে। আগুনে পুড়ে সর্বস্ব হারানো মানুষও হাসে, নিয়তির অবিচার দেখে। হঠাৎ করে বাংলাদেশ থেকে যেন হাসি উধাও। মানুষের বিষণ্ন মুখ। অজানা আতঙ্কে মানুষ। কেউ কারও সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে ভয় পায়। এমন এক অবিশ্বাস, সন্দেহ এবং আতঙ্কের জগতে আমরা বসবাস করছি। বিচ্ছিন্নভাবে যখন বিভিন্ন স্থানে মানুষ হত্যা হয়েছে, তখনো মানুষ এমন মলিন হয়ে যায়নি। কিন্তু ১ জুলাই বাংলাদেশকে যেন পাল্টে দিয়েছে। বাংলাদেশ কি আরেকটি আফগানিস্তান হবে কিংবা সিরিয়া অথবা পাকিস্তান। যেখানে জীবন-মৃত্যু পাশাপাশি হাঁটবে। যেখানে মানুষ জানবে না কী হবে তার আগামীকাল?

গুলশানের মতো সুরক্ষিত এলাকায় অস্ত্রধারীরা ঢুকে পড়ল। যেখানে মোড়ে মোড়ে পুলিশ মিষ্টির প্যাকেট খুলে দেখে। মুরগি জবাইয়ের মতো মানুষ জবাই করল। জবাই করে আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিল। আমরা জানলাম না, কারা এর হোতা। এ রকম একটি পরিস্থিতির পর অনেক সুযোগসন্ধানী, যে যার মতো ঘটনাকে তার পক্ষে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। মার্কিন গণমাধ্যম বিরামহীনভাবে প্রচার করল হলি আর্টিজানের ঘটনা। ঘোষণা করল গণতন্ত্রহীনতার জন্যই নাকি এ রকম ঘটনা। ফ্লোরিডায় কদিন আগে নৈশক্লাবে ঘটেছিল একই ধরনের ঘটনা, সেটাও কি গণতন্ত্রহীনতার জন্য? বেলজিয়ামের বিমানবন্দরে কিংবা তুরস্কের বিমানবন্দরের ঘটনাও কি তাহলে গণতন্ত্রহীনতার জন্য?

বাংলাদেশে যদি গণতন্ত্র নাই থাকে তাহলে যে যার মতো টেলিভিশনে কথা বলছে কীভাবে? সংবাদপত্রে সবকিছু লেখা হচ্ছে কীভাবে? রাজনৈতিক নেতারাই বা লাগামছাড়া কথা বলছেন কীভাবে। গণতন্ত্র ছাড়া কি এভাবে স্বাধীন, যথেচ্ছ কথা বলা সম্ভব?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়িয়েছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনমনে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে যে বাংলাদেশে আইএস অস্তিত্ব থাকলেও থাকতে পারে। কোনোভাবে এটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে বাংলাদেশের ঘাড় ধরে ইচ্ছামতো ঘোরানো যাবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যে কোনো ব্যাপারে নাক গলানো যাবে। বাংলাদেশকে আবার মার্কিনিদের অনুগত ভৃত্য বানানো যাবে। ১ জুলাইয়ের ঘটনা তাই মার্কিনিদের জন্য বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ‘বন্ধু হবে, হাতটা বাড়াও’ গোছের আহ্বান জানিয়ে বসে আছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু হবে তার শত্রুর দরকার কী?

১ জুলাইয়ের ট্র্যাজেডিতে লাভবান হয়েছে বিএনপি এবং তার জোটও। যাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদী তত্পরতাকে লালন ও উসকে দেওয়ার একাধিক অভিযোগ প্রমাণিত। এ ঘটনার পর বিএনপি যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা বিস্ময়কর। বিএনপি নেতারা যেন খুশিতে আটখানা। ১ জুলাইয়ের রক্তাক্ত ঘটনা যেন বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন কোনো রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, ‘এই সরকারকে সরে যেতে হবে, নতুন নির্বাচন দিতে হবে।’ এর অর্থ কী? যারা হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়েছে, তারা কি এই সরকার পতন ঘটানোর জন্য এটা করেছে? এ রকম একটি রাষ্ট্রীয় দুর্যোগের পর যদি সরকারের পদত্যাগের দাবি ওঠে তাহলে বুঝতে হবে ঘটনার অন্য দিকও আছে। অথচ দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে এই ঘটনার পর আমরা বিএনপির কাছে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করেছিলাম। আমাদের প্রত্যাশা ছিল বিএনপি সুস্পষ্টভাবে জঙ্গিবাদ দমনে একাত্ম হবে। ঘোষণা দিয়ে জঙ্গিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গ ত্যাগ করবে।

এই ঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার ভিত্তিমূলের একটি হলো জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’। এজন্যই এই সরকার দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। গুলশান ট্র্যাজেডি তাই আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার বৈধতাকেই চ্যালেঞ্জ করেছে। দেশে-বিদেশে সরকারের সক্ষমতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ব্লগার হত্যা, বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু হত্যা, মিতু হত্যাকাণ্ড এবং সর্বশেষে হলি আর্টিজানের ঘটনা— সরকারের ধারাবাহিক ব্যর্থতার চিত্র। এসব ঘটনা আওয়ামী লীগকে একটি দুর্বল সরকার হিসেবেই উপস্থাপিত করেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ যতই গলা ফাটিয়ে এর জন্য একে ওকে দায়ী করুন না কেন, একটি ঘটনাতেও সন্দেহাতীতভাবে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পারেনি। একটি ঘটনারও মূল রহস্য উন্মোচিত হয়নি। এর ফলে সরকারের বক্তব্যগুলো মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। মানুষের আস্থায় চিড় ধরেছে।

ধারাবাহিক সন্ত্রাসী ঘটনা এবং সবশেষ হলি আর্টিজানের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আমাদের পুলিশবাহিনীর ইমেজ। বিশেষ করে ১ জুলাইয়ের পর পুলিশবাহিনীকে মনে হয়েছে দুর্বল, অদক্ষ এবং বিব্রত। জঙ্গিদের কৌশল, প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণের কাছে প্রায়ই পুলিশবাহিনীকে অসহায় মনে হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিশবাহিনীর কারও কারও বাচাল, লাগামহীন বক্তব্য। পুলিশ যখন রাজনীতিবিদদের মতো কথা বলে তখন তা কেবল অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, অশোভনও বটে। পুলিশবাহিনীর ওপর যদি মানুষ আস্থা হারায় তাহলে তা একটি সভ্যসমাজের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এখন পর্যন্ত পুলিশ বিশ্বাসযোগ্যভাবে একটি ঘটনারও রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি।

তবে, ১ জুলাইয়ের ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণ। বাংলাদেশের অতিথিপরায়ণতার বিশ্বব্যাপী ইমেজে বড় রকমের কলঙ্ক দাগ লেগেছে। এ ঘটনায় প্রতিটি বিবেকবান মানুষ অনুশোচনায় ভুগছেন। বিবেকের দংশনে দংশিত হচ্ছেন। প্রতিটি বাঙালির একবার হলেও মনে হয়েছে, তিনিই অপরাধী। আমি জানি না, এই অপরাধবোধ আমাদের কতদিন বয়ে বেড়াতে হবে। একটা বিব্রত, অপরাধী জাতি হেসেবে আমরা যেন মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছি।

এ রকম অপরাধবোধ আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে। বিশ্ব আমাদের জাতির পিতার খুনি হিসেবে চিনেছে। আমরা খুনি জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হয়েছি। জাতির পিতার হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে আমরা এই অভিশাপ মোচন করেছি। ১ জুলাই আমরা আবার অভিশপ্ত হলাম। এ যেন বিনা দোষে সাজা ভোগের মতো।

লাভ-ক্ষতির এই হিসাব ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটি সামনে এসেছে, তা হলো এর শেষ কোথায়? বাংলাদেশ কি এভাবে আস্তে আস্তে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে? বাংলাদেশ কি আফগানিস্তান, সিরিয়া কিংবা পাকিস্তানের মতো আতঙ্কের রাষ্ট্র হবে, যেখানে মানুষ মৃত্যুকে হাতে নিয়ে ঘুরবে। শ্যামল ছায়ার এই দেশটি কি এভাবে বার বার গুলি, বোমা আর গ্রেনেডে এক রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হবে? বাংলাদেশ কি হবে জঙ্গিগোষ্ঠী, সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য? যেখানে মানুষ হাসতে ভুলে যাবে, আতঙ্কে ঘর থেকে বেরোবে, নির্ঘুম রাত প্রার্থনা করবে, আর একটি সন্ত্রাসী হামলা যেন না হয়। বাংলাদেশ কি তেমনি এক রাষ্ট্র হবে যেখানে বিদেশিরা আসতে চাইবে না। আসার আগে মনে করবে মৃত্যুর দুয়ারে যাচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষ কি এক পরাজিত ব্যর্থ রাষ্ট্রের বাসিন্দা হবে, যারা বিদেশে গেলে তাদের চৌদ্দবার তল্লাশি হবে। সন্দেহের তীর ছোড়া হবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। আমাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ কি হবে মুখ থুবড়ে পড়া এক রাষ্ট্র। যেখানে অগ্রগতি এবং উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। আবার দুর্ভিক্ষ, হাহাকার। অনাহারী মানুষ অপেক্ষায় থাকবে একটু রিলিফের?

বাংলাদেশের সামনে এখন এ প্রশ্নগুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আবার এক পরীক্ষার মুখোমুখি বাংলাদেশ। আমরা হারব নাকি জিতব। এ রকম পরীক্ষা আমরা বার বার দিয়েছি। ’৭১-এ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় যুদ্ধ। চালানো হয় বর্বর গণহত্যা। অপারেশন সার্চলাইটের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করা। অসম যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি। আমরা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ‘বাংলাদেশ’ অর্জন করেছি। পেয়েছি আমাদের পবিত্র স্বাধীনতা, বিজয়ের পতাকা।

মুক্তিযুদ্ধের পর আবার শুরু হলো গৃহবিবাদ। জাসদ-সর্বহারার তাণ্ডব। টাইম ম্যাগাজিন বলল বাংলাদেশ একটি অবাসযোগ্য রাষ্ট্র। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের আগে এ রকমই পরিস্থিতি তৈরি করা হলো। পাটের গুদামে আগুন লাগানো হলো। মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হলো। তারপর হত্যা করা হলো জাতির পিতাকে। এরপর শুরু হলো উল্টোপথযাত্রা। একে একে উপড়ে ফেলা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মূল্যবোধ এবং অর্জনগুলো। পথ হারাল বাংলাদেশ। জিয়ার একনায়কতান্ত্রিক শাসনে বাংলাদেশ শুধু নামেই থাকল বাংলাদেশ, আসলে এটা হয়ে গেল পাকিস্তান। স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্ফাালন আর অট্টহাসিতে যেন ‘মুক্তিযুদ্ধ হায় বৃথা যায়, বৃথা যায়।’ রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধীরা রক্তে ভেজা পবিত্র পতাকা উড়িয়ে দানবের রাজত্ব কায়েম করল। কিন্তু বাংলাদেশ পথ হারায়নি। বাংলাদেশ সুদান হয়নি, হয়নি জিম্বাবুয়ে, হয়নি ইথিওপিয়া। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিয়েছে ২১ বছর। পরিকল্পনা ও উন্নয়নবঞ্চিত এ দেশের মানুষ শুধু বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করেছে। এরপর আস্তে আস্তে মানুষ জেগেছে। ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। জনগণের ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই দূর হয়েছে অন্ধকার। এসেছে নতুন সকাল। বাংলাদেশ এগিয়েছে হাঁটি হাঁটি পা পা করে। আস্তে আস্তে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে এসে দাঁড়িয়েছে উন্নত আধুনিক একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ঠিক তখনই আবার আঘাতের চেষ্টা। বাংলাদেশ এখন আবার এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। গুলশানের হলি আর্টিজানের বর্বরোচিত ঘটনা কেবল তাই একটি ঘৃণ্য সন্ত্রাসী ঘটনা নয়। এটি বাংলাদেশের অস্তিত্ব এবং স্বপ্নের ওপর একটি চ্যালেঞ্জ। এ ঘটনায় আক্রান্ত হলো বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা। যে দেশটি টানা পাঁচ বছর ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে এবার ৭ স্পর্শ করেছে, সেই প্রবৃদ্ধির ওপর এটি একটি বড় আঘাত। এ ঘটনায় সাতজন জাপানি নিহত হয়েছেন। জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী, সবচেয়ে নিঃস্বার্থ উন্নয়ন অংশীদার। এ ঘটনা বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কের ওপর একটি বড় আঘাত। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বড় বাজার হলো ইউরোপ। গুলশানের ঘটনায় যে কজন ইতালীয় মারা গেছেন তাদের অধিকাংশই পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত। এর ফলে পোশাকশিল্পসহ রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর একটি বড় আঘাত আসতে পারে। উন্নয়নের রেখাচিত্র পাল্টে যেতে পারে বাংলাদেশের।

গুলশানের ঘটনাটি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়ার অপতত্পরতার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। অনেকে আরেকটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে ক্ষমতার পালাবদলের খোয়াব দেখছেন। অনেক যুদ্ধাপরাধী চূড়ান্ত দণ্ড কার্যকর হবে না বলেও আশায় বুক বেঁধে আছেন। এখনো তারা যে হাল ছাড়েননি, সাম্প্রতিক কথাবার্তায় তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

কিন্তু বাংলাদেশ এক অদ্ভুত দেশ। এ দেশের যে কোনো সংকট নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করে দেয়। প্রবল বন্যায় মানুষের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়, সেই বন্যা দেয় পলিমাটির উর্বরাশক্তি। ফসলের ঘ্রাণে মানুষ বন্যায় সব হারানোর দুঃখ ভুলে যায়। সংকট যে বাংলাদেশে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়, দেয় অমিত সাহস তার সবচেয়ে নিকটতম উদাহরণ সম্ভবত পদ্মা সেতু। বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতু নির্মাণে সহায়তা থেকে সরে দাঁড়াল তখন দেশের অধিকাংশ মানুষই, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু এই সংকটকে সম্ভাবনায় পরিণত করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন। পদ্মা সেতু এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। তাই সন্ত্রাসের এই বিষাক্ত ছোবল আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে যে সংকট এবং কঠিন সময়ের সামনে দাঁড় করিয়েছে, তা থেকে সম্ভাবনাও সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনার আগে বলা হতো, আমাদের মাদ্রাসাগুলোই নাকি জঙ্গিবাদের কারখানা। কিন্তু ১ জুলাই আমাদের চোখ খুলে দিল। দেখা গেল উচ্চবিত্তের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া তরুণরা এসব জঘন্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে গুমের আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছিল। কারও সন্তান হারিয়ে গেলে বলা হচ্ছিল তাকে গুম করে ফেলা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা গুম নয় তারা জঙ্গি হয়েছে। গুলশানের ঘটনা এ রকম অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো আমাদের মানুষ ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মের বাড়াবাড়িকে ঘৃণা করে। এ দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দেশ। আমরা অতিথিপরায়ণ জাতি। আমাদের ভিতরের এই শক্তিগুলো যদি আমরা জাগিয়ে তুলতে পারি, তাহলে আমাদের জয় অনিবার্য।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি জঙ্গিবাদের কাছে কখনো মাথা নত করতে পারে না। যে দেশে কৃষক শস্য ফলাতে গান গায়, মাঝি নৌকা বইতে গান গায় সে দেশে বুলেটের শব্দ কখনো বেগবান হতে পারে না। আর্টিজান হামলা তাই আমাদের সচেতনতার চোখ খুলে দিয়েছে। এ দেশের মানুষই প্রতিহত করবে, এ দেশের মানুষের হাতেই পরাজিত হবে অপশক্তি। জয় হবেই আমাদের। জিতবেই বাংলাদেশ।

     লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

     ইমেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর