বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রধান শিক্ষক অমূল্যচরণ চৌধুরীর হত্যাকাণ্ড এবং...

মোশাররফ হোসেন মুসা

বলা হয়, ভারতের রাষ্ট্র অসাম্প্রদায়িক কিন্তু সমাজ সাম্প্রদায়িক। আর বাংলাদেশের রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক হলেও সমাজ অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর আগের মতো নেই, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ইতিমধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের পিয়ারে লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত দশম শ্রেণির এক ছাত্রকে মারধর করলে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। বিষয়টি ইস্যু করে তাকে লাঞ্ছিত করতে স্থানীয় মানুষদের অতি উৎসাহ, পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে সেখানকার রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের  সাম্প্রদায়িক বক্তব্য  ইত্যাদি আমাদের সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। তবে শ্যামল কান্তি ভক্তকে সাজা দেওয়ার জন্য যারা সেলিম ওসমান এমপিকে এককভাবে দায়ী করছেন তারা সম্ভবত সমস্যার গভীরে যেতে চাচ্ছেন না। কারণ শুধু শ্যামল কান্তিই নন, দেশের বিভিন্ন স্থানে সমসাময়িক সময়ে তার মতো আরও কয়েকজন সংখ্যালঘু শিক্ষককে একই অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এখন যে কোনো সময়, যে কাউকে ধর্ম অবমাননার ভুয়া অভিযোগ তুলে লাঞ্ছিত করা, এমনকি হত্যা করাও সম্ভব।

পূর্ববাংলায় একসময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই সামাজিকভাবে ছিলেন প্রভাবশালী। তা প্রমাণের জন্য বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই, জনপদের নামগুলোই যথেষ্ট (যেমন-নারায়ণগঞ্জ, মদনগঞ্জ, বিক্রমপুর প্রভৃতি)। ব্রিটিশ আমলে এদেশে হিন্দুদের হাত ধরে শিক্ষার বিস্তার লাভ করে। পুরনো নামকরা স্কুলগুলোর প্রধানশিক্ষক ছিলেন উচ্চশিক্ষিত হিন্দুরাই। এখনো যে কয়জন হিন্দু শিক্ষক আছেন তারাও শিক্ষায় নিবেদিত রয়েছেন। অথচ ধর্ম অবমাননার ভুয়া অভিযোগ তুলে তাদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। মাত্র ২৫-৩০ বছর আগেও জনসাধারণ সংকীর্ণ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা এমন আক্রান্ত ও বিভক্ত ছিল না। এখানে গত ১৯৭৯ সালে আমাদের এলাকার প্রিয় শিক্ষক অমূল্যচরণ চৌধুরীর হত্যাকাণ্ড এবং তত্পরবর্তী সময়ে এলাকাবাসীর সম্মিলিত প্রতিবাদ উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। অমূল্যচরণ চৌধুরী নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার রাজাপুর উচ্চবিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আমৃত্যু প্রধান শিক্ষক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বর্তমানে প্রতি বছর এই স্কুল মাঠেই রাজশাহী বিভাগের সবচেয়ে বড় বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৫৬ সাল এবং প্রতিষ্ঠাতা ডা. বীরেন্দ্রলাল সেন রায়। পাকিস্তান আমলে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট) নাটোরে মহকুমা প্রশাসক থাকাকালীন স্কুলটি পরিদর্শনে এসেছিলেন। সেই সুবাদে শাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তার ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ডা. বীরেন্দ্রলাল সেন রায়ের গ্রুপ ছবি রয়েছে (অফিস কক্ষের দেয়ালে ওই ছবিটিসহ স্যারের আরেকটি সিঙ্গেল ছবি দীর্ঘদিন শোভা পেতে দেখা গেছে। এখন আর সেই ছবিগুলো দেখা যায় না। স্যারের মৃত্যুবার্ষিকীও পালিত হয় না। এটাও বর্তমান স্কুল কর্তৃপক্ষের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কিনা প্রশ্ন করা যেতে পারে)। অমূল্যচরণ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্য আবদুস সালামের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন। মাটির দেয়াল দেওয়া ঘরে বসবাস ছিল তার। ওই এলাকার জনসাধারণের মধ্যে তখনো শতকরা ২০-২৫ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। দশম  শ্রেণিতে আমার ৪৫ জন সহপাঠীর মধ্যে হিন্দু ছাত্র ছিল ১৫ জন। স্কুলের ১৬ জন শিক্ষকের মধ্যে হিন্দু শিক্ষক ছিলেন ৫ জন। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে হিন্দু বসতি আগের মতো নেই। তাদের অধিকাংশ দেশ ত্যাগ করেছে। অমূল্যচরণ চৌধুরীর পরিবার পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলেও তার বংশের কয়েকজন জন্মভিটার আকর্ষণে এখনো গ্রামাঞ্চলে বসবাস করছেন। অমূল্যচরণ চৌধুরী ইংরেজি ও ইতিহাস এ দুই বিষয়ে পৃথক পৃথকভাবে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তাছাড়া এলএলবি ডিগ্রিও অর্জন করেছিলেন তিনি। সে সময় তার কাছে যে কোনো সরকারি চাকরি জোগাড় করা কষ্টসাধ্য ছিল না। এমনকি ওকালতি পেশায় যোগ দিয়ে নাটোর শহরে আয়েশি জীবনযাপনও করতে পারতেন। সেসব দিকে না গিয়ে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়ানোর উদ্দেশ্যে শিক্ষকতা পেশাকেই বেছে নেন। ইংরেজি তার প্রিয় বিষয় হওয়ায় তিনি শুধু নবম ও দশম শ্রেণির ইংরেজি ক্লাস নিতেন। তার ইংরেজি উচ্চারণ, শব্দচয়ন, পরিচ্ছন্ন পোশাক-পরিচ্ছদ, চুল আঁচড়ানোর স্টাইল ইত্যাদি আমাদের খুবই আকর্ষণ করত। লুঙ্গি পরে কোনো ছাত্র ক্লাসে আসুক সেটা তিনি গ্রাহ্য করতেন না। রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে পড়লে তিনিও মাঝে মধ্যে লুঙ্গি পরে স্কুলে আসতেন। তবে স্কুলের আঙ্গিনায় পা রাখার আগে ব্যাগ থেকে শার্ট-প্যান্ট বের করে তা পরিধান করতেন। একদিন নবম শ্রেণিতে আজিজ নামের একজন ছাত্র লুঙ্গি পরে ক্লাসে আসলে তিনি রাগ করে শাসনের ছলে তার পিঠে ডাস্টার দিয়ে দুই-তিনটা আঘাত করেন। রফিকুল নামের একজন পঙ্গু ছেলে ছিল ওই ক্লাসের ফার্স্ট বয় (বাল্যকালে পোলিও রোগে আক্রান্ত হওয়ায় সে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটত)। সে মেধাবী ছাত্র হলেও মনে মনে কিছুটা সাম্প্রদায়িক ছিল। তার ইশারায় আজিজ প্রধান শিক্ষকের পেছন দিক থেকে স্যান্ডেল দিয়ে আঘাত করে দৌড়ে ক্লাস থেকে পালিয়ে যায়। বাংলা ক্লাসের মকবুল স্যার (যিনি এলাকায় কবি ও সাহিত্যিক নামে পরিচিত) আমাদের ক্লাসে এসে ক্লাস ফাঁকি দেওয়া ও বেয়াড়া টাইপের আমাদের কয়জনকে আদেশ দেন—আজিজ আর রফিকুলকে ধরে আনার জন্য। রফিকুলকে পাওয়া না গেলেও আজিজকে পাওয়া গেল তার বাড়ির খাটের নিচে। আমরা সেখান থেকে তাকে চ্যাংদোলা করে ধরে এনে অফিসকক্ষে স্যারদের কাছে সোপর্দ করি। যতদূর মনে পড়ে, ‘মারের স্যার’ নামে খ্যাত কালাম স্যার আজিজকে পেটাতে পেটাতে দুটি বেত ভেঙে ফেলেন। কালাম স্যারের এই নির্মম পিটুনি দেখে এলাকাবাসীকে কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে দেখা যায়নি। এমনকি আজিজের পিতা-মাতাও বলেছেন, ছেলের সঠিক শাস্তি হয়েছে। তাদের দুজনকে তত্ক্ষণাৎ ফোর্স টিসি দিয়ে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনার ৪-৫ মাস পর অমূল্যচরণ চৌধুরী কতিপয় দুষ্কৃতকারীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন। সেদিন স্যারের স্ত্রী শিশু-সন্তানদের নিয়ে পিত্রালয়ে থাকায় স্যার একাকী বাড়িতে ছিলেন। গভীর রাতে ছাত্রের পরিচয় দিয়ে দুষ্কৃতকারীরা দরজা খুলতে বললে স্যার সরল বিশ্বাসে দরজা খুলে দিলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে বুকে-পিঠে আঘাত করে তাকে হত্যা করা হয়। প্রধান শিক্ষকের খুনের ঘটনায় সমগ্র এলাকা উত্তাল হয়ে পড়ে এবং খুনিদের বিচারের দাবিতে মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন (যাদের মধ্যে স্যারের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রও ছিলেন) স্কুলে এসে খুব দ্রুত খুনিদের গ্রেফতারের প্রতিশ্রুতি দেন। এ ঘটনায় আজিজ আর রফিকুলকেও সন্দেহবশত গ্রেফতার করা হয়। তারা খুনের সঙ্গে কোনোরূপ সংশ্লিষ্ট থাকার কথা অস্বীকার করলেও রফিকুল পুলিশি প্রহারের ভয়ে তার বড় ভাইয়ের কাছে একটি অবৈধ রিভলবার আছে বলে স্বীকারোক্তি দেয়। পুলিশ তার বড় ভাইকে গ্রেফতার করে অবৈধ রিভলবারটি উদ্ধার করে। তার বড় ভাই পুলিশি নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিন মাস পর হাসপাতালে মারা যান। এরই মধ্যে পুলিশ হত্যার রহস্য উত্ঘাটন করে ফেলে। খুনিদের মুখে জানা গেছে, এলাকার এক প্রভাবশালী পরিবারের সঙ্গে (যারা সরকার গোষ্ঠী নামে পরিচিত) স্কুলের তহবিল তছরুপ ও খাস জমির ভুয়া পত্তন সংক্রান্ত বিষয়ে স্যারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল। এক সালিশি বৈঠকে অমূল্যচরণ চৌধুরী ওই প্রভাবশালী পরিবারটির বিরুদ্ধে অর্থদণ্ডের রায় দিলে তারা প্রতিশোধবশত ভাড়াটিয়া খুনিদের দ্বারা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। পরবর্তী সময়ে সাক্ষীর অভাবে আসামিরা বেকসুর খালাস পেলেও প্রকৃতির বিচারে তাদের ঠিকই সাজা হয়েছে। তাদের দুজন গণপিটুনিতে (চরমপন্থি হিসেবে), একজন সড়ক দুর্ঘটনায়, একজন স্যালো মেশিন চালাতে গিয়ে ও আরেকজন দুরারোগ্য রোগে মৃত্যুবরণ করেছে। প্রভাবশালী পরিবারটির কোনো সদস্যই লেখাপড়া কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে কোনো উন্নতি লাভ করেনি। তাদের অনেকেই এখন অন্যের বাড়িতে কামলা খেটে দিনাতিপাত করছে। তাদের এই মর্মান্তিক পরিণতি প্রসঙ্গে এলাকাবাসীর মন্তব্য—‘খোদার বিচারে কেউই রেহাই পায় না’। শিক্ষকের সঙ্গে বেয়াদবি করলে তার জীবন সুখের হয় না সেটা আমরা আজিজ আর রফিকুলের পরবর্তী জীবনে দেখতে পাই। আজিজের লেখাপড়া সে সময়ই ক্ষান্ত হয়ে গেছে। রফিকুল এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেও উচ্চশিক্ষা লাভে ব্যর্থ হন। তার অপরাধে পুরো পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে। বর্তমানে সে কোথায় আছে, কী করছে, কেউই খোঁজ রাখেন না। (পুনশ্চঃ রাজাপুর উচ্চবিদ্যালয়টি এখন লেখাপড়ায় পূর্বের তুলনায় অনেক উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করেছে। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও ঈর্ষণীয়। তাদের মাঝে আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে অমূল্যচরণ চৌধুরীকে জীবিত রাখা জরুরি। সেজন্য অমূল্যচরণ চৌধুরীর ছবিটি  সংরক্ষণ করাসহ তার মৃত্যুবার্ষিকী পালনের ব্যবস্থা করার জন্য ম্যানেজিং কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি)।

     লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।

     email – [email protected]

সর্বশেষ খবর