মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

হাতি আমার সাথী

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

হাতি আমার সাথী

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধযোদ্ধারা শোক দিবস পালনের জন্য ঢাকায় এক সভায় মিলিত হয়েছিলেন। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে শেরপুরের নকলা-নালিতাবাড়ীর বৈদ্য, গৌরাঙ্গ, জসিম, বাহাদুর ভালুকার কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। আমি রাত ২টায় খবর পেয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলাম। করিডরে বৈদ্যের দেহ পড়ে ছিল। কপালে হাত দিয়ে অমন হিমশীতল অনুভূতি জীবনে আর কখনো পাইনি। ’৭৫-এর সেই প্রতিরোধযোদ্ধাদের কথা কেন যেন বার বার মনে পড়ছে। নাকি ৪১ বছরে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধযোদ্ধাদের কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই বলে এবার বেশ কয়েকটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও পত্রপত্রিকায় ব্যাপক আলোচনা হওয়ায় ব্যাপারটা মন থেকে মুছতে পারছি না? নাকি অন্য কিছু? হঠাৎই সেদিন বাহাদুরের স্ত্রী শিখার সঙ্গে দেখা। বলল তার স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তির জন্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কাছে গিয়েছিল। মন্ত্রী নাকি বলেছেন তার স্বামী কাদেরিয়া বাহিনী। তাই তার জন্য তিনি কিছু করতে পারবেন না। তিনি কাদেরিয়া বাহিনী দেখতে পারেন না। এটা সত্য, মতিয়া চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু অথবা অন্যদের সঙ্গে ’৭৫-এর প্রতিরোধযোদ্ধারা জাতির পিতার হত্যার প্রতিবাদ করেনি, আমার সঙ্গেই করেছিল। বেগম মতিয়া চৌধুরী অথবা হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে করলে সে তো হতো বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ নয়। ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবে ট্যাংকের ওপর নাচানাচি করা ইনু সাহেবের ছবি তো এখনো আছে। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধযোদ্ধাদের প্রতি যখন অবমাননাকর আচরণ করা হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলা করা হয়, তখন বড় বেশি খারাপ লাগে।

মো. বাহাদুর শাহ, পিতা হাজী মেহের আলী সরকার, মেদিরপাড়, গণপদ্দী, নালিতাবাড়ী, শেরপুর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। রফিক উদ্দিন ভূইয়ার সিলমোহর করা সার্টিফিকেট আছে। মন্ত্রী বলেছেন ও রকম সার্টিফিকেট এখন পাঁচ টাকায় কেনা যায়। হতে পারে পাঁচ টাকায় সার্টিফিকেট কেনা যায়। কিন্তু বাহাদুরের সার্টিফিকেট আমি দেখেছি। ওটা পাঁচ টাকায় কেন পাঁচ হাজার কোটি টাকায়ও কেনা যাবে না। ওটা নকল নয়, আসল। বাহাদুর আমার জন্য প্রতিবাদ করেনি, আমার বাবার জন্যও নয়। সে জাতির পিতার হত্যার প্রতিবাদ করেছে। তার এবং তাদের মর্যাদা পাওয়া উচিত। কদিন আগে বাসেত সিদ্দিকীর ছেলেরা এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধে গণপরিষদ সদস্যদের মধ্যে বাসেত সিদ্দিকী একজন অসাধারণ। যিনি প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেই। তার ছেলেদের নেই। অথচ তার বাড়ির সবার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট থাকা উচিত, তারা সবাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন এসেছিল সামছু। যার গায়ে নাগরপুর যুদ্ধে গুলি লেগেছিল। সারা দিন যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে ছিল। স্বাধীনতার পর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে বাবার নামের জায়গায় আমার নাম দেওয়ায় রেজাল্ট উইথহেল্ট হয়েছিল। সে যুদ্ধাহত হিসেবে বহুদিন ভাতা পেয়েছে, কে বা কার কথায় এখন সামছু মুক্তিযোদ্ধাই না। আরেকজন লায়েক আলম চন্দন। বাবা পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরি করতেন। তার অমতে বিয়ে করায় মুক্তিযুদ্ধের আগে ছেলের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ছিল না। লায়েক আলম চন্দন কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়ে অভাবনীয় সাফল্যের পরিচয় দেয়। রক্ষীবাহিনী গঠনে প্রথম ব্যাচে ছয় হাজার যোদ্ধার সঙ্গে লায়েক আলম চন্দনকে পাঠানো হয়। প্রথম অফিসার্স ট্রেনিংয়ে লিডার লায়েক আলম চন্দন প্রথম স্থান অধিকার করে। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়। একসময় সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে তিতাস গ্যাসে জিএম হিসেবে চাকরি করে। চাকরিরত অবস্থায় হঠাৎ মারা যায়। সেই লায়েক আলম চন্দনও এখন মুক্তিযোদ্ধা না। সরকারি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম নেই। অথচ একসময় এসএসএফের ডিজি মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলাম, মেজর জেনারেল আইন উদ্দিনসহ আরও অনেকে চন্দনের জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছেন। আজ অনেকে মুক্তিবার্তা ও অন্যান্য জায়গায় তালিকা খোঁজেন। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের বর্তমান জঙ্গিদের চেয়েও খারাপ অবস্থা ছিল। ইদানীং যেমন আইজিপি বলেছেন জঙ্গিদের কিসের মানবাধিকার? ঠিক তেমনই সেদিন বলা হতো কাদেরিয়া বাহিনীর দুষ্কৃতকারীদের আবার কিসের অধিকার? বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে গিয়ে অকাতরে অনেকেই জীবন দিয়েছে। আশা করি বর্তমান সরকার ’৭৫-এর প্রতিরোধযোদ্ধা ও কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারটি বিবেচনায় আনবে।

ভালগ্রাম থেকে যখন শ্যালো ছাড়ছিল তখন এক আবেগময় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। ভালগ্রাম উত্তরপাড়া মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করে রাস্তার ওপর বসে খিচুড়ি খেয়েছিলাম। আমার পাশে বসেছিলেন দেওয়ানগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রবীণ নেতা আবুল হোসেন বাচ্চু মাস্টার। আর সামছুলের নেতৃত্বে কল্লাকাটা চরে কলেজপড়ুয়া ১০-১২ জন ছাত্র। দক্ষিণে ছয়-সাত জনের পর এক দোকানি বসে ছিল। গাজীপুরে কী কাজ করে। আমি জীবনে কখনো অত আগ্রহ নিয়ে খিচুড়ি খেতে দেখিনি। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সামাদ গামা ১৬-১৭ সের মাংস খেয়েছিল কিন্তু খিচুড়ি নয়। সেদিন ভদ্রলোককে যেভাবে খিচুড়ি খেতে দেখেছিলাম তাতে প্রথম মনে হয়েছিল ভদ্রলোক বেশি খেয়ে কষ্ট পেতে পারে। কিন্তু পরে দেখলাম, না প্রায় ১০-১৫ জনের খিচুড়ি খেয়ে আমার সঙ্গে ঘাটপাড়ে আসে। সেখানেও প্রায় আধাঘণ্টা নির্বিবাদে সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমাদের বিদায় দেয়। তার মধ্যে কোনো অস্বস্তি দেখিনি। শ্যালো যখন ছাড়বে ঠিক তখন হাঁটুপানিতে নেমে সামছুল র‍্যাপিং পেপারে পেঁচানো একটা কিছু আমার হাতে দিতে চেষ্টা করে। জিনিসটা স্পর্শ করে মনে হয় গামছা ছাড়া আর কিছু নয়। ছেলেটিকে প্রশ্ন করলাম, নতুন বউকে উপহার দেওয়ার মতো ও রকম র‍্যাপিং পেপারে পেঁচিয়ে দিয়েছ কেন? খুলে ফেল। ছেলেটি একটানে র‍্যাপিং পেপার খুলে ফেললে বেরিয়ে আসে আমার সারা জীবনের শ্রমের ঘামের ফসল গামছা। মাথা এগিয়ে দিই। প্রথম বর্ষের ছাত্র ছোট মানুষ। নিচে থেকে গামছা দিতে নিশ্চয়ই তার বেশ কষ্ট হয়। আমার গলায় গামছা পরিয়ে দিয়ে সে তিনটা চকলেট হাতে গুঁজে দেয়। আমার কান্না পেয়ে যায়। রাতে যে লাল মিয়ার ছেলে নীল মিয়া, রেজাউল, এনামুল হকদের বাড়িতে ছিলাম। নীলের চার-পাঁচ বছরের মেয়ে স্বর্ণালী সারা দিন পিছ ছাড়েনি। ১০টা থেকে ১২টা আমগাছের নিচে ক্যাম্প খাটে শুয়ে ছিলাম। সে আমার মাথার কাছে বসে ছিল। তারপর শ্যালোতে ওঠা পর্যন্ত হাত ধরেই ছিল। তখনো ছোট্ট বাচ্চার হাতের স্পর্শ আমার দেহমনে লেগে ছিল। সামছুলের চকলেট হাতে নিয়ে কেমন যেন একটা স্বর্গীয় অনুভূতি অনুভব করছিলাম।

সন্ধ্যা গড়িয়ে যাচ্ছিল, ভালগ্রাম থেকে প্রায় ৩০-৪০ কিলোমিটার ভাটিতে সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের মনসুরনগর ইউনিয়নের মাজনাবাড়ী আমরা ঘাঁটি গাড়ি। জায়গাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীর পাড়ে তেমন বাড়িঘরের চিহ্ন নেই। সবাই বাড়ি ভেঙে সরে গেছে। তবুও ওখানে আমরা ঘাঁটি গেড়েছিলাম। অন্যদিনের মতো সেখানেও অনেক লোক এসেছিল। সোহেল, সাদেক, রফিক, আনিস, খলিল আশপাশে দেখতে গিয়েছিল। ফিরে এসে সোহেল বলে আধা কিলোমিটার দূরে মাজনাবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়। সেখানে সৌরবিদ্যুৎ আছে, পেশাব-পায়খানা এবং গোসলের ভালো জায়গা আছে। জায়গাটাও বেশ নিরাপদ। কিন্তু ততক্ষণে একটি জায়গা আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। একেবারে নদীর পাড়ে ৫০ গজের মধ্যে এক হতদরিদ্র দিনমজুর সালামের ঘর। পাশেই মাজনাবাড়ী হাইস্কুলের হেডমাস্টারের বাড়ি। ভাঙনের কারণে তারা আর সেখানে থাকবে না। তাই একদিন আগে সবকিছু নিয়ে চলে গেছে। সোহেলও দিনমজুর সালামের বাড়ি দেখেছিল। একেবারেই থাকার মতো নয় বলে সে পছন্দ করেনি। বন্যার পানিতে ঘরের ডোয়া ভেঙে নিচে হাঁ হয়ে গেছে। সেখান দিয়ে শিয়াল-কুকুর অনায়াসে ছোটাছুটি করতে পারে। আমাকে সেই বাড়িতে উঠতে দেখে সোহেল কিছুটা অবাক হয়। কাজী শহিদ সঙ্গে থাকলে আমার কোনো চিন্তা করতে হয় না। সেদিনও হয়নি। দরিদ্র হলেও সালামের বউ খুব চটপটে। তার ঘরে গিয়ে বসতে বসতে একটা ভুনা ডিম দিয়ে ভাত নিয়ে এসে জোর করে খাইয়েছিল। একটু দেরি হলে অন্য লোকজনের খাবারও খেতে পারতাম। ততক্ষণে লোকজন আসা শুরু হয়ে গিয়েছিল। স্কুলের হেডমাস্টার কামাল উদ্দিন আসেন। তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন মাস্টার। এলাকার প্রবীণ ভদ্রলোক জনাব গোলাম হোসেন সন্তোষ মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের বড় ভাই। আরও অনেকে। আলাপে আলাপে অনেক রাত হয়ে যায়। সকালে আরও বেশি লোকসমাগম হয়। সাধারণ মানুষ উতলা হয়ে উঠেছিল। তারা আমাকে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। ও রকম অজপাড়াগাঁয়ে গরিবের কুটিরে আমাকে পাবে? মাজনাবাড়ীতেই কেন যেন এই অবিশ্বাসটা বেশি মাত্রায় দেখলাম। মাজনাবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের হেডমাস্টার কামাল উদ্দিন ও তার স্ত্রী মর্জিনা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না।

সে যাক। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাতঃস্মরণীয় ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর নামে কাজিপুর উপজেলায় মনসুরনগর ইউনিয়নের মাজনাবাড়ী আমার খুব ভালো লেগেছে। এখনো মাজনাবাড়ী যেন আমার সঙ্গে কথা কয়। সদ্য বিবাহিতা কলেজপড়ুয়া রুবি আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল। তার স্বামী ঢাকায় চাকরি করে। আমার ফোন থেকে সে স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছিল। কিন্তু প্রথম প্রথম তার স্বামী বিশ্বাস করেনি। আমি মেয়েটিকে বলেছিলাম, দেখেছ তোমার স্বামী তোমাকে বিশ্বাস করে না। গ্রামে যেমন নির্মল বায়ু তেমন মানুষও বড় নির্মল। মাজনাবাড়ী থেকে যখন ভাটির পথ ধরেছিলাম ডিউটি করতে আসা পুলিশরাও ছিল। তাদের সিরাজগঞ্জের পাড়ে নামিয়ে দিয়ে যখন শ্যালো ছাড়ি তখন কেন জানি মনে হচ্ছিল দেশে কোনো প্রশাসন নেই। নদীপথে ত্রাণকার্য পরিচালনার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিলাম। আইজি, ডিআইজিকে এবং যে কটি জেলার ওপর দিয়ে এসেছি সব কটি জেলার এসপি, ডিসিকে কপি দিয়েছিলাম। আমরা কোথায় কোথায় যাচ্ছি, কী করছি তার সবই তারা জানত। কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় বিচিত্র আচরণ পেয়েছি। রৌমারী যাওয়ার পর পুলিশ ও অন্যান্য প্রশাসনিক লোকজন যতটা করা দরকার ঠিক ততটাই করেছে। কিন্তু জামালপুরে প্রশাসনের কোনো আকারবিকার দেখিনি। কাজিপুর, রৌমারী ও অন্যান্য জায়গায় থানা থেকে ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে ছিলাম। কিন্তু দেওয়ানগঞ্জের ভালগ্রাম উপজেলা সদর থেকে বড়জোর ২ কিলোমিটার পশ্চিমে ঢোষমারী ২০০ গজ। প্রায় ২৪ ঘণ্টায় তাদের কাউকে দেখিনি। আবার সিরাজগঞ্জের সীমানায় পড়লেই তাদের সে যে কী তত্পরতা। যে কোনোভাবে যে কোনো সাহায্য করতে পারলে তারা যেন উতরে যায়। অথচ মাঝেমধ্যে শুনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চান না তাই আমাদের প্রশাসনিক সহযোগিতা করা হয় না। কিন্তু এখানে তো তেমন দেখছি না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইজিকে চিঠি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রণালয় থেকে জেলা পর্যায়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী না চাইলে আমি কি এতই বেকুব যে, মন্ত্রণালয় সঙ্গে সঙ্গে চিঠি দিতে পারে।

যাক ওসব কথা। এবার বানভাসি মানুষের সঙ্গে সরকার মশকরা করার একটা মারাত্মক জিনিস পেয়েছিল। পুরো বন্যায় যখন লোকজন ঘরে থাকতে পারছিল না তখন আসামের দিক থেকে এক হাতি ভেসে আসে। যেখানেই বন্যা সেখানেই হাতি। মানুষের শোক নেই, তাপ নেই শুধু হাতির পিছে ছোটা। সে হাতি এমন সার্কাস দেখিয়ে গেছে যে, দু-চার বছর হাতি কাহিনী চলবে বিরাট এলাকাজুড়ে। মাজনাবাড়ী থেকে যে পুলিশরা আমাদের সঙ্গে এসেছিল তাদের বয়ানে এমন বিস্মিত হয়েছি। তারা বলছিল হাতি যখন নদীর এপার-ওপার হতো, দুই পা উঁচু করে শুঁড় তুলে এমন জোরে ছুটত স্পিডবোটও পারত না। জানি না সেটা কত গতির স্পিডবোট। তবে আমার স্পিডবোটকে পিছে ফেলে যাওয়া হাতির কোনো উপায় ছিল না। হাতিটা মারা গেছে। আমরা একটা হাতিকেও ভালোভাবে হ্যান্ডেলিং করতে পারি না। বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে গারো পাহাড়ের পাদদেশে কয়েক বছর কাটিয়েছি। শত শত হাতির সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাগমারা থেকে মহাদেও-এর পথে হাতি আর হাতি। মনে হয় কিছু হাতি আমাকে চিনে ফেলেছিল। আপনজনের মতো ব্যবহার করত। আমার জিপের সামনে-পেছনে, ডানে-বামে এক-দেড়-দুশ হাতি। ৫-৭ কিলোমিটার চলার পর হঠাৎ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যেত। কোনো দিন কোনো ক্ষতি করত না। গাড়িতে একটা ধাক্কাও দেয়নি কোনো দিন। জিপ থেকে কতবার হাত বুলিয়ে আদর করেছি। কখনো কিছু বলেনি। অনেকের কাছে শুনতাম দলবদ্ধ হাতি নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। খারাপ ব্যবহারের কারণে দল থেকে কোনো হাতিকে বের করে দিলে একা হাতি পাগল হয়ে যায়। উন্মাদ হাতি সাধারণত ক্ষতির কারণ হয়। ঘর-দুয়ার নষ্ট করে, মানুষজন মারে। আমরা কখনো একা হাতি পাইনি। কিন্তু এবার বানে যে হাতিটি ভেসে এসেছিল সে সম্পূর্ণ একা। তাকে যে দল থেকে তাড়িয়ে দেয়নি, সে যে কোনো অসভ্য খারাপ হাতি ছিল না এটা তার ৫৩ দিনের আচরণে বোঝা গেছে। দেশে জঙ্গিদের উপদ্রব। কত মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু ৫৩ দিন হাতিটা থাকল কারও একটা ঘর-দুয়ার ভাঙেনি। কারও খেত, গাছপালা নষ্ট করেনি। কারও কোনো ক্ষতি করেনি। দেওয়ানগঞ্জের ভালগ্রামে শুনছিলাম কবে কোথায় নাকি একটা চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা হাতির সামনে পড়েছিল। মানুষ ভয়ে মরে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই বাচ্চাটিকে হাতি শুঁড় দিয়ে আলতোভাবে তুলে তার পথ থেকে সরিয়ে রেখে চলে গিয়েছিল। বাচ্চাটি বলেছে তার গায়ে কোনো আঁচড় লাগেনি। হাতি যে ধরেছিল, মা কোলে নিলে যেমন লাগে তার ও রকমই লেগেছিল। একটা বোবা জানোয়ার তারও মানবতা আছে, আমাদের নেই। হাতিটি পরপারে চলে গেছে। আমরা কি তার কাছে কিছু শিখেছি, যা ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে?

লেখক : রাজনীতিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর