মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
স্মরণ

আমার স্মৃতিতে অধ্যাপক নোমান

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

আমার স্মৃতিতে অধ্যাপক নোমান

এক ধরনের মানুষ থাকেন যারা নিজ কর্মে এমন আত্মনিবেদিত যে তাদের চেহারাতেই যেন কর্ম বিমূর্ত হয়ে ওঠে। তাদের দেখলেই শ্রদ্ধা জাগে, অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত হয়। অধ্যাপক নোমান ছিলেন এমনই এক ব্যক্তিত্ব।

১৯৫৭ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। ইংরেজি ও বাংলা আমাদের পাঠ্য বিষয় ছিল। অধ্যাপক নোমান ওই সময় ছিলেন ঢাকা কলেজের ইংরেজির শিক্ষক। ইংরেজি ক্লাসেই তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছাত্র হিসেবে-শিক্ষার্থী হিসেবে। ঢাকা কলেজে তখন অনেক নামকরা অধ্যাপক ছিলেন। বাংলায় ছিলেন অধ্যাপক মনসুর উদ্দীন, অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী, অধ্যাপক হিশামউদ্দীন ও অধ্যাপক আবদার রশীদ। ইংরেজি বিভাগে ছিলেন অধ্যাপক আবু রুশদ মতিন উদ্দিন, অধ্যাপক নোমান ও অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। সবাই নিজ নিজ পরিমণ্ডলে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।

অধ্যাপক নোমানের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন প্রত্যেক বিশিষ্ট মানুষেরই থাকে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য। অপেক্ষাকৃত গম্ভীর প্রকৃতির শান্ত, সৌম্য ও মর্যাদাবান অবয়ব। ক্লাসে ঢুকতেন নিঃশব্দে। কোলাহলপূর্ণ শ্রেণিকক্ষ হঠাৎ করেই যেন শান্ত হয়ে যেত তার প্রবেশলগ্নে। কারও দিকে না তাকিয়েই বেদিতে উঠে দাঁড়াতেন। একটা বই হাতে নিয়ে কিছু অংশ পড়তেন— পরিমিত শব্দ করে, সুন্দর উচ্চারণে, আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গিতে। তারপর ব্যাখ্যা করতেন। উপচে পড়ত তার পাণ্ডিত্য। স্বচ্ছন্দে দীর্ঘ সময় ধরে অতি সহজ করে কথা বলতেন। শ্রেণিকক্ষের সব ছাত্র সম্মোহিত হয়ে শুনত। সবাই যেন সাহিত্যে অনুরাগীর মতোই অধীর আগ্রহে কথা শুনত, উপভোগ করত। ক্লাসের পর আমরা আলাপ করতাম— কেন এমন হয়। সবাই একই মত প্রকাশ করত— স্যার বড়ই হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করেন। নীরস বিষয়কেও সরস করে তোলেন। এটাই তার দক্ষতা। এখানেই তার বৈশিষ্ট্য। সব ক্লাসের মতো আমাদের ক্লাসেও কিছু দুষ্টু ছাত্র ছিল। দু-এক জন নবীন অধ্যাপকের ক্লাসে পেছনে বসে গল্প করা, পা দিয়ে শব্দ করা, এমনকি কদাচিৎ মুখে কিছু আওয়াজ করা এসব দুষ্ট ছেলেদের রেওয়াজ। কোনো কোনো শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবশত তারা কখনো বা ক্লাসে উৎপাত না করে অনুপস্থিত থাকত। কিন্তু অধ্যাপক নোমানের ক্লাসে তারা সোৎসাহে উপস্থিত থাকত এবং নিঃশব্দে উপভোগ করত। জ্ঞানকে আকর্ষণীয় করে তোলার জাদুকরী ক্ষমতা ছিল অধ্যাপক নোমানের।

অধ্যাপক নোমানের নির্মল চরিত্র সম্ভবত তাকে সবার কাছে আকর্ষণীয় করে তুলত। শিক্ষক একজন মানুষ। তারও দোষ-গুণ থাকতে পারে। কিন্তু কেউ কেউ দোষ পরিহার করে গুণচর্চার মাধ্যমে ধীরে ধীরে আদর্শ শিক্ষকের সঙ্গে সঙ্গে আদর্শ মানুষও হয়ে ওঠেন অনুকরণীয়। শুধু শিক্ষক হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেও। অধ্যাপক নোমান ছিলেন তেমনই একজন।

১৯৫৯ সালের পর স্যারের সঙ্গে খুব একটা দেখা হতো না। সর্বশেষ দেখা হয় তিনি যখন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তার বাসভবনে একটি মিলাদ মাহফিলে গিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন পরে দেখে তিনি হৃদয়ের যে উষ্ণতা দেখালেন তা মনে থাকার মতো। ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের যে মমতাবোধ, তার বুঝি পূর্ণতা পেয়েছিল তার মধ্যে। এও তার চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য।

অধ্যাপক নোমান বেঁচে নেই। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে তার স্মৃতি অম্লান। তিনি আমাদের স্নেহ দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে, চরিত্র শিখিয়ে ভালো নাগরিক হতে সাহায্য করেছেন। আমরা তার জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি। তার আত্মা শান্তিনিলয়ে অবস্থান করুক।

লেখক :  বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর

সর্বশেষ খবর