রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

এত পরীক্ষা ভালোবেসে দেওয়া সম্ভব নয়

প্রভাষ আমিন

এত পরীক্ষা ভালোবেসে দেওয়া সম্ভব নয়

আমার ছোট বোন নাজনীনের দুই সন্তান, মেয়ে মুন্নী বড়, ছেলে শান্ত ছোট। মুন্নী এখন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। শান্তও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ছে। ছেলেবেলায় শান্তকে পড়তে বললেই সে গাইগুই করত, বলত, আমার পড়ার কী দরকার। মুন্নী আপু পড়লেই হবে। আমি তো আর ছেলেমেয়েকে পড়াব না। শান্তর ধারণা ছিল, পড়াশোনা করতে হবে সন্তানকে পড়ানোর জন্য।  আর তাদের তো মা-ই পড়ান, বাবা তো কখনো পড়ান না। তাই ছেলেদের পড়াশোনা করার দরকার নেই। তার ধারণায় খুব একটা ভুল নেই। এখন সন্তানদের পড়াশোনা করার মূল দায়িত্ব মায়েরাই পালন করেন। আমি আমার ছেলে প্রসূনকে নিয়ে যতই ঢং-ঢাং করি, তার পড়াশোনাটা আমার স্ত্রী মুক্তিই দেখভাল করে। আমি শুধু সকালে প্রসূনকে স্কুলে দিয়ে আসতে যাই। এটা অবশ্য যতটা বাবা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে, তার চেয়ে অনেক বেশি নিজেকে রিচার্জ করতে। প্রতিদিন সকালে আমি প্রসূনের স্কুলে যাই। কারণ দিনের শুরুতেই শিশু-কিশোরদের মুখর কলকাকলি দেখতে আর কিচির-মিচির শুনতে আমার ভালো লাগে। তাদের খুনসুটি, হৈচৈ, দৌড়াদৌড়ি দেখতে আমার ভালো লাগে। আমি তাদের উজ্জ্বল চোখে দেখি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। সকালের ওই সময়টুকুতে আমি নিজেকে চাঙ্গা করে নেই। সন্তানের জন্য মায়েদের দরদ, ত্যাগ, কষ্ট দেখে আমি প্রতিদিন মুগ্ধ হই। আমার বাসা মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে। এলাকাটাই স্কুলপ্রধান। রাতে যতটা বিরান, সকালে ততটাই সরগরম। সকালে প্রসূনকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে প্রতিদিন ফুটপাথে দেখি অভিজাত মায়েরা বসে আছেন। অনেকে পত্রিকা বিছিয়ে বসেন, অনেকে বাসা থেকে চাদর নিয়ে আসেন, অনেকে সঙ্গে নাশতাও নিয়ে আসেন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, সন্তানের স্কুলের সামনে ছাড়া অন্য কোনো স্থানে তাদের একজনকেও এ ধরনের ফুটপাথে বসানো যাবে না। যতক্ষণ সন্তান ক্লাসরুমে, ততক্ষণই মায়েরা ফুটপাথে। তারপর বাসায় নিয়ে খাওয়ানো, কোচিংয়ে দৌড়ানো, রাতে পড়ানো— একজন মায়ের দিনের বেশির ভাগ সময় কেটে যায় সন্তানের পেছনে।

এখানে বাবার ভূমিকা সামান্যই, বড়জোর ছুটির দিনে বেড়াতে বা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়া। প্রসূনের স্কুল-কোচিং সব মুক্তি সামলায়। আমি আসলে তেমন কিছুই জানি না। কিছু দিন আগে প্রসূনের এক সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার দিন স্কুল থেকে অভিভাবককেও যেতে বলা হলো। মুক্তির সে দিন কোনো কাজ ছিল। আমাকেই পাঠাল। গিয়ে দেখি সেন্ট যোসেফ স্কুলের বাস্কেট বল কোটে বেশ বড় আয়োজন। ক্লাস এইটের সব ছাত্র, তাদের অভিভাবক, অনেকের বাবা-মা দুজনই এসেছেন। রীতিমতো জমজমাট ক্যাম্পাস। আমি চুপচাপ পেছনের দিকেই বসেছিলাম। হঠাৎ প্রসূনদের শিক্ষক উত্তম স্যার এসে আমাকে বললেন, অভিভাবকদের পক্ষ থেকে আপনি কিছু বলুন। হয়তো টিভিতে কাজ করার কারণেই আমাকে বেছে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু অভিভাবকদের পক্ষ থেকে আমাকে বলতে হবে শুনে প্রসূনের বন্ধুদের মায়েদের, বিশেষ করে যারা আমাকে চেনেন, তাদের মাথায় বাজ পড়ল। কারণ তারা জানেন, সন্তানের পড়াশোনার ব্যাপারে তাদের ধরনের সঙ্গে আমি একমত নই। বাজ আমার মাথায়ও পড়ল। আমি তো আসলে স্কুল সম্পর্কে কিছুই জানি না, কী বলব। দ্রুতই কয়েকজন মা মিলে একটা ছোট্ট মিটিং করে ফেললেন। তারপর আমার হাতে রীতিমতো লিখিত দাবিনামা তুলে দিলেন, আমি যেন তাদের হয়ে এ দাবিগুলো তুলে ধরি। আমার পালা যখন এলো, সুযোগ পেয়েই সেন্ট যোসেফ স্কুলের প্রতি আমার পুরনো মুগ্ধতার কথা বললাম। ক্যাম্পাসে বড় মাঠ থাকা, কারিকুলাম-বহির্ভূত বিষয়ের প্রতি স্কুলের বাড়তি নজর, একটা ছেলেকে শুধু ভালো ছাত্র নয়, সামগ্রিকভাবে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষকদের আন্তরিকতায় তাদের ধন্যবাদ জানালাম। এরপর পকেট থেকে বের করলাম মায়েদের দাবিনামা। তাদের মূল দাবি চারটি : অ্যাসাইনমেন্ট বাদ দেওয়া, স্কুল টাইম কমানো, স্কুলের প্রশ্ন যেন জেএসসি টাইপ হয় ও কীভাবে লিখলে জেএসসিতে ভালো নম্বর পাওয়া যাবে তা ক্লাসে বোঝানো এবং বেশি করে মডেল টেস্ট নেওয়া। কেন মায়েদের মাথায় বাজ পড়েছে, তখন আমি বুঝতে পারলাম। কারণ দাবিগুলো উল্লেখ করার পাশাপাশি তাদের সবগুলোর সঙ্গেই আমি আমার স্পষ্ট দ্বিমত জানিয়ে দেই। আমি বুঝতে পারছি, তাদের দাবিগুলো সন্তানের গোল্ডেন জিপিএ-৫ নিশ্চিত করার জন্যই। কিন্তু আমি কখনই জিপিএ-৫ দিয়ে মেধা মাপি না, মাপতে চাই না। আমি চাই, আমাদের সন্তানরা বেড়ে উঠুক প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে, অপার কৌতূহল নিয়ে, মানুষ-প্রকৃতি-গান-সাহিত্য-সিনেমা-খেলাধুলা ভালোবেসে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে। পড়াশোনাটা তারা করুক ভালোবেসে। জেএসসি পরীক্ষা সামনে, তাই মুক্তির উসকানিতে আমিও মাঝে মাঝে প্রসূনকে পড়ার কথা বলি। তবে সবসময় বলি যেন ভালোবেসে পড়ে। শুনে প্রসূন মুখ ঝামটা দেয়, বাবা, এত পড়া, এত পরীক্ষা ভালোবেসে দেওয়া সম্ভব নয়। স্কুলের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয় ক্লাসের বাইরেও তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করতে। জেএসসিকে সামনে রেখে অ্যাসাইনমেন্ট বন্ধ করে দেওয়া মানে তার জগৎ সীমাবদ্ধ করে ফেলা। স্কুলের সময় কমানোর দাবির সঙ্গে আমি একমত হতাম যদি জানতাম, বাড়তি সময়টুকু সন্তানরা খেলার কাজে বা অন্য কাজে ব্যয় করার সুযোগ পাবে। কিন্তু বিরোধিতা করেছি। কারণ আমি জানি, বাড়তি সময়টুকুতে তাকে নতুন আরেকটি কোচিংয়ে যেতে হবে। তিন নম্বর দাবিটি তো পুরোটাই জিপিএ-৫ কেন্দ্রিক, শিক্ষার কোনো ব্যাপার নেই সেখানে। বেশি করে মডেল টেস্ট নেওয়ার দাবির প্রবল বিরোধিতা করি আমি। সব সময় আমি পরীক্ষা বাড়ানো নয়, কমানোর পক্ষে। বেশি করে মডেল টেস্ট নেওয়া মানে, সন্তানদের জীবনকে আরও বেশি নিরানন্দ করে তোলা। কিন্তু আমার কোনো আপত্তিই ধোপে টেকেনি। এখন দেখছি মায়েদের দাবিই প্রতিপালিত হচ্ছে। তাই হওয়ার কথা। তারাই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই আমাদের ক্লাস এইটে পড়ুয়া সন্তানদের জীবন এখন পরীক্ষাময়। স্কুল আর একাধিক কোচিং মিলিয়ে প্রসূনের প্রায় প্রতিদিনই ৩/৪টা করে পরীক্ষা থাকে। প্রসূন হিসাব করে দেখিয়েছে, মূল জেএসসি পরীক্ষার আগে তাকে প্রতিটি বিষয়ে পুরো বইয়ের ওপর অন্তত তিন সেট করে পরীক্ষা দিতে হবে। অর্ধেক বইয়ের ওপর দিতে হবে আরও ছয়/সাত সেট পরীক্ষা। এ ছাড়া স্কুলে-কোচিংয়ে নিত্যদিনের পরীক্ষা তো আছেই। তাদের এখন আর কোনো ছুটির দিন নেই। শুক্রবার কোথাও বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব করলেই মা-ছেলে একসঙ্গে হই হই করে ওঠে, না না পরীক্ষা আছে। প্রসূনের ভাষায়, সব বই ভাজা ভাজা হয়ে গেছে। তাই চাইলেও তার পক্ষে গোল্ডেন জিপিএ-৫ এর নিচে কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। আমরা অনায়াসে পরীক্ষার্থীতে স্কুল-কোচিং-বাসা ভর্তি করে ফেলি; শিক্ষার্থীর দেখা পাওয়া ভার। তারা কখন খেলবে, কখন গল্পের বই পড়বে, কখন সিনেমা দেখবে, কখন জোসনা দেখবে? অত সময় কই তাদের। মায়েদের ব্যস্ততা দেখে বোঝার উপায় নেই, পরীক্ষা কার, সন্তানের না মায়ের?

আমার মূল আপত্তিটা পিইসি আর জেএসসি পরীক্ষা নিয়েই। আমাদের সময় অত পরীক্ষা ছিল না। প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হতো এসএসসিতে গিয়ে। আর এখন তার আগেই শিশুদের দুটি পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হয়। আমি মনে করি, এসএসসি পরীক্ষার আগে আসলে একটি ছেলে বা মেয়ে পাবলিক পরীক্ষার চাপ নেওয়ার মতো শক্ত হয় না। শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, পিইসি ও জেএসসির সার্টিফিকেট শিশুদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। কিন্তু আমি জানি জিপিএ-৫ এর দিকে এ অনন্ত দৌড় তাদের আত্মবিশ্বাস কেড়ে নেয়, শুষে নেয় জীবনীশক্তি, চুরি করে শৈশব। অনেক দাবি-দাওয়ার মুখে সরকার একবার পিইসি পরীক্ষা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এ বছর শিশুদের প্রথম এ পরীক্ষা নিয়ে বড়রা যে ছেলেখেলা খেলেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী একবার, এ বছর থেকেই পিইসি পরীক্ষা নেওয়া হবে না জানালেও তার এক সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নেয়, পিইসি পরীক্ষা চলবে। শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে বড়দের নিষ্ঠুর এক্সপেরিমেন্টের শিকার হয় অসহায় ছোটরা। ১ নভেম্বর থেকে শুরু হবে এ বছরের জেএসসি পরীক্ষা। কিন্তু জেএসসি পরীক্ষার বৈধতা নিয়ে করা একটি রিট এখনো উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। জেএসসি পরীক্ষা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, এই প্রশ্নে রুলের জবাবই এখনো আসেনি। আমাদের সবার উচিত, শিশু-কিশোরদের বিষয়গুলো ঝুলিয়ে না রেখে আগেই নিষ্পত্তি করে ফেলা।

আমি জানি এ লেখাটা প্রসূনরা খুব পছন্দ করবে। কিন্তু মায়েরা খুব অপছন্দ করবে। পরীক্ষার ঠিক আগে আগে সন্তানদের মাথা খাওয়া মার্কা এরকম একটি লেখা উসকানিমূলক লেখার জন্য তারা আমাকে অভিসম্পাত দেবেন। আমি জানি, মায়েরা তার সন্তানদের আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসেন। তারা সন্তানের ভালোর জন্যই তাদের ওপর চাপ দেন।  মায়েরা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চান। কিন্তু প্লিজ সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার বর্তমানটা মাটি করে ফেলবেন না।

আনন্দময় শৈশব একটা মানুষের সারা জীবনের স্মৃতিকাতরতার সঙ্গী। ভেবে দেখুন, আপনার সন্তান যেন বড় হয়ে আপনাকে তার শৈশব চুরি করার জন্য দায়ী না করে। পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, করপোরেট চাকরি— ব্যস নিশ্চিন্ত জীবন। জীবনের ছকটা এত সরল নয়।  জীবন একটাই, তার ক্যানভাস অনেক বড়; জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন জিপিএ-৫ই জীবনের শেষ কথা নয়।

লেখক : সাংবাদিক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর