মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

একজন বিনয়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

একজন বিনয়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা

গতকাল ছিল মুজিবনগর দিবস। কিন্তু যতটা গুরুত্ব দিয়ে দিনটি পালন করা উচিত ছিল কেন যেন তার কিছুই হলো না। সরকার দিনটির যেমন গুরুত্ব দেয়নি, তেমনি রাজনৈতিক, সামাজিকভাবেও দিনটি তেমন গুরুত্ব পায়নি। অথচ আমাদের শিকড় পোঁতা মুজিবনগর দিবসে। ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ মুজিবনগর দিবসে শপথের মধ্য দিয়ে একটি সুনিয়ন্ত্রিত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা না গেলে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হতাম না। সেই ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসেও যদি মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার কথা মনে না করি, সেই স্থানটিকে যদি মর্যাদা না দিই তাহলে কেমন হয়। স্বাধীন দেশে ঢাকা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। কিন্তু ঢাকা থেকে পালিয়ে গিয়ে বৈদ্যনাথতলায় শপথ নিয়ে দৃঢ় পায়ে যদি না দাঁড়াতে পারতাম তাহলে কি আজকে এই বাগাড়ম্বর করার পথ থাকত? আমরা সেই বৈদ্যনাথতলার জন্য কী করেছি? একটা স্মৃতিসৌধ— এটাই কি যথেষ্ট? ওই অঞ্চলের উন্নয়ন, সাধারণ মানুষের মানমর্যাদার জন্য কী করেছি? বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে চরম দুঃসময়ে জাতিকে যারা সঠিক পথ দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন সেই জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে কি আমরা সরকারি-বেসরকারি কোনোভাবে যথাযথ মর্যাদা দিলাম বা দিতে পারলাম? দিনটি যেভাবে গেল তাতে মনে হলো অনেকের যেন খেয়ালই ছিল না। এমন হওয়া ভালো নয়। আজ যারা অতীতকে অবহেলা করছেন কাল অতীতও যে তাদের অবহেলা করবে না, তা কে বলতে পারে?

বর্তমানে বিরোধী দলে থেকে সরকারি কোনো কাজ স্বীকার করা, ভালোকে ভালো বলা বা সরকারি দলে থেকে বিরোধী দলের কোনো ভালো কাজ স্বীকার বা গ্রহণ করা নেই বললেই চলে। এমন একটা সময় সত্যকে সত্য বলতে গিয়ে ভালো না খারাপ করেছি বুঝতে পারছি না। তবুও সারা জীবনের অভ্যাস যখন যা দেখেছি ভালোকে ভালো, খারাপকে খারাপ বলেছি। এমন একটি কঠিন সময় মন্ত্রীকে ভালো বলতে যাওয়া সে আরও কঠিন। যদিও আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাজ নিয়ে নয়, মন্ত্রীকে নিয়ে দুই কথা বলছি। সর্বজনাব তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, মোহাম্মদ নাসিম, ওবায়দুল কাদের, মাহবুব-উল আলম হানিফ, বাহাউদ্দিন নাছিম, আলাউদ্দিন আহমেদ নাসিমের মতো তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয় নয়। ১০-১৫ বছর যে পরিচয় তাতে তাকে আমার অসাধারণ ঠেকেছে। জীবনে অনেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেখেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ আগ্নেয়গিরির চেয়ে উত্তপ্ত। কঠিন উত্তপ্ত পদের জন্য শান্ত মানুষও অশান্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু তিনি এখনো তেমন হননি। জীবনে একবারই তার বাড়ি গিয়েছিলাম। আসাদুজ্জামান খান কামালের অমায়িক ব্যবহারে খুবই মুগ্ধ হয়েছি।

কিছুদিন আগে কালিহাতীতে এক নারী বা শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। যার সঙ্গে কালিহাতী থানার ওসির ওঠা-বসার অভিযোগ ছিল। এসপি, ডিসি যথেষ্ট চেষ্টা করেও তেমন ভালো কিছু করতে পারেননি। কারণ আগেই হাসপাতাল হাত করে ফেলেছিল। সেই ভিকটিম যাতে আইনানুগ নিরাপত্তা পায় সে নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার ছিল। এর মধ্যে আবার সখীপুরে দুটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এসব নিয়ে আলোচনা করতে মন্ত্রীর ধানমন্ডির বাড়ি গিয়েছিলাম। জনাব আসাদুজ্জামান খান কামালের বাড়ি মণিপুরিপাড়ায়। কয়েক বছর আগেও তিনি সেখানে থাকতেন। আমার এক বীর মুক্তিযোদ্ধা মণিপুরিপাড়ায় তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে কাজ করেছে। আমি তাকে চিনি এসব জেনে তিনি নাকি তাকে যথেষ্ট সমাদর করে কাজ করে দিয়েছিলেন। কেউ কাউকে ভালো বললে কার না ভালো লাগে? আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম প্রতিমন্ত্রী, পরে মন্ত্রী হন। মন্ত্রী হওয়ার আগে দু-এক বার একসঙ্গে নামাজ পড়েছি, কথাবার্তা বলেছি। মনে হয় দুবার তার মন্ত্রণালয়েও গেছি। সর্বশেষ তার ধানমন্ডির বাড়িতে। তার একান্ত সচিব ড. হারুনুর রশিদ বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, মন্ত্রী রাত একটা-দেড়টা পর্যন্ত লোকজনকে সাক্ষাৎ দেন। শুনে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম, বলেন কি! ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘আপনি মাননীয় মন্ত্রীর বাড়ি যাবেন এটা স্যারকে জানানো হয়েছে। তিনি ১০টার মধ্যেই বাসায় ফিরবেন। ১০টা থেকে ১২টা যে কোনো সময় যেতে পারেন।’ পিএস উপসচিব হারুনুর রশিদ বিশ্বাসকে কয়েকবার দেখে আমার বেশ ভালো লেগেছে, অনেকটা ইন্দিরাজির পিএস আর কে ধাওয়ানের মতো। ঠিক ঘড়ি ধরে ১০টা ৪০ মিনিটে মন্ত্রীর ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি তিনি তখনো আসেননি। কিন্তু বড় যত্ন করে তার লোকেরা আলাদা ঘরে বসিয়েছিল। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর মন্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলাম। সালাম দিয়ে কিছু বলার আগেই তিনি বলেছিলেন, ‘ভাই! আমি মণিপুরিপাড়ায়, অনেক লোক। গাড়িতে উঠছি, আপনি একটু বসুন।’ কত আর হবে ১০-১৫ মিনিট। হঠাৎ চোখে পড়ে নাসিমা আক্তার লিপির ‘রক্তসিঁড়ি’। ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ঘটনা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষী-সাবুদ নিয়ে লেখা ৪৫-৪৬ পৃষ্ঠার বই। লেখিকার আন্তরিকতায় কোনো খাদ মনে হয়নি। কিন্তু লেখাটি ততটা স্পষ্ট নয়। দু-একটা ক্ষেত্রে একটু তলিয়ে দেখলে বঙ্গবন্ধুকে বরং ছোট করা হয়েছে। পাকিস্তান হানাদার যারা মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে তাদের ‘পাক’ বলা। তারা কি পাক? তারা তো পা থেকে মাথা পর্যন্ত নাপাক। শেষের দিকে আবদুল কাইয়ুমের বরাত দিয়ে ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কী এক পরীক্ষাসংক্রান্ত ব্যাপারে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গেলে তাকে সরাসরি খাবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু কেবলই দুপুরের খাবার শেষ করেছেন। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কথা শুনে তাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু সোজাসুজি ভিসির অফিসে চলে যান। ছাত্রদের সমস্যা মুহূর্তে শেষ হয়ে যায়। এও কি সম্ভব? একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী, তাও আবার বঙ্গবন্ধুর মতো প্রধানমন্ত্রী। ’৭২ সালে বিশ্বজোড়া যার নাম। তিনি সরাসরি একা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের অফিসে যেতে পারেন? কোনো দিন যাওয়া সম্ভব? ব্যাপারটা কেমন যেন খুবই হালকা হয়ে গেছে। মন্ত্রীর দেরি দেখে বইটির ৩০-৩৫ পৃষ্ঠা ততক্ষণে পড়ে ফেলেছিলাম। মাত্র ৮-১০ পৃষ্ঠা বাকি ছিল। তাই মন্ত্রীকে বলে বইটি নিয়ে এসেছিলাম। কাল বইটি পাঠিয়ে দেব। এর মধ্যেই মন্ত্রী চলে এসেছিলেন। কালিহাতীর একটি মেয়ে নাগবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার কথা বলে সখীপুর উপজেলার গজারিয়া এবং দাঁড়িয়াপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। তিনি বলেছিলেন, কারচুপিতে সরকারি কোনো প্রশ্রয় পাওয়া যাবে না। গত পরশু নির্বাচন হয়ে গেছে। হয়তো মন্ত্রী তার কথা ঠিকই রাখার চেষ্টা করেছেন। বাইরে তেমন কিছু হয়নি বা সরকারি প্রশ্রয় পায়নি। কিন্তু অনেক কেন্দ্রেই মানুষ ইচ্ছামতো ভোট দিতে পারেনি। বাইরে ভোটের পরিবেশ বেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। তবে যে যে কেন্দ্রে অন্যকে ভোট দিতে দেওয়া হবে না, সেসব কেন্দ্রে আগে থেকে যা শোনা গেছে তাই হয়েছে। নির্বাচন কমিশন অথবা প্রশাসন কিছুই করেনি বা করতে পারেনি। আরও মজার ব্যাপার, সারা দেশে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দাও-মাছ। কিন্তু সখীপুর-বাসাইল, টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগ-বিএনপি ভাই ভাই। দাঁড়িয়াপুরে জনাব হাসান কবির ধানের শীষের প্রার্থী দেড় লাখ টাকা ঋণী ছিলেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী তাকে সেই টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন যাতে গামছা সেখানে বেশি ভোট না পায়। তিনি তার জাইলার মাঠ কেন্দ্রে ৬০০ ভোট পেয়েছেন। আর কোনোটিতেই ১০-২০ ভোটের বেশি পাননি। গজারিয়ায় প্রার্থী গোলাম মোস্তফা পেয়েছেন সর্বমোট ৯৫ ভোট। মানে সখীপুর ধানের শীষ-নৌকা এক। গামছা মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। শোনা যাচ্ছে, বিদেশে থাকা বহু ভোটারের ভোট দিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট কয়েকটি কেন্দ্রে কাউকেই ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। বাক্স বদল করা হয়েছে। হতেও পারে। কয়েকটা কেন্দ্রের ফলাফলে তেমনই মনে হয়। বিশেষ করে গজারিয়া কেন্দ্রের সব ভোট আওয়ামী লীগ পায়, ১০৯৯ ভোট। চার প্রার্থী— গামছা ৬, ধানের শীষ ১, অন্যরা ৩ বা ৪ ভোট। এই দুঃসময়ে আওয়ামী লীগ এত ভোট পায়? এভাবে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার তার বিশ্বস্ততা নষ্ট করছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নম্রতা-ভদ্রতা-শালীনতা ও সৌজন্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। বয়স হয়েছে। আমরা এখন কারও কাছে বেশি কিছু চাই না। কেউ অসৌজন্য দেখালে খারাপ লাগে। সেটা না হলে ভালো লাগে, স্বস্তিবোধ করি। সে কাজটি আসাদুজ্জামান খান কামাল যথার্থই করেছেন। এর আগেও দু-চার বার ফোন করলে সঙ্গে সঙ্গে ধরেছেন, এমনকি বিদেশে থাকলেও। না থাকলে ফিরতি ফোন করেন। মনে হয় এটা তার একটা অতিরিক্ত সদ্গুণ। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এত সময় আর কেউ এতটা নির্বিবাদে থেকেছেন বলে মনে হয় না। ইদানীং পুলিশের সহিষ্ণুতা অনেকটা কমে গেলেও সামর্থ্যের অনেক উন্নতি হয়েছে। এবার পুলিশ সপ্তাহে টিভিতে তাদের প্যারেড দেখে বিস্মিত হয়েছি। ঢিলেঢালা পুলিশদের অমন চমৎকার প্যারেড অভাবনীয় চিন্তার অতীত। বিশেষ করে সেই প্যারেড কোনো মহিলা এসপির পরিচালনা করা, সেটা আরও অসাধারণ।

গত সংখ্যায় বন্ধু বাবরকে নিয়ে লিখেছিলাম। কবি সায্যাদ কাদির বাবরের বিয়োগব্যথা বুক থেকে এখনো সরছে না। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় সায্যাদ কাদির হানাদারদের হাতে বন্দী হয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। তিন-চার মাস হানাদারদের নির্যাতনে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী হয়েছিল। কুমুদিনী কলেজের প্রিন্সিপাল আমার শাশুড়ি নার্গিস হামিদ কোরায়েশীর অক্লান্ত পরিশ্রমে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছিল। বাবরের সঙ্গে সে সময় বিশিষ্ট শিক্ষক কান্তি রায় ও তার ছেলে অরুণ, গোলাম আম্বিয়া নূরী, আখতার বোখারী ছিল। তারা ভীষণ নির্যাতিত হয়। কান্তি রায় এবং তার ছেলে জীবিত ফেরেনি। শুনেছি, নির্যাতন ক্যাম্পে হানাদাররা কান্তি রায়কে যখন নির্যাতন করত তার ছেলে হাউমাউ করে কাঁদত আর হানাদারদের হাতে-পায়ে ধরে মিনতি করত, আপনারা বাবাকে মারবেন না, আমাকে মারুন। দরকার হলে আমাকে মেরে ফেলুন, তবুও বাবাকে ছেড়ে দিন। আবার ছেলেকে যখন মারত তখন বাবা একইভাবে হানাদারদের হাতে-পায়ে ধরে একই মিনতি করত। কিন্তু সেই মিনতি হানাদার জল্লাদের হৃদয় টলাতে পারত না। তারা শেষ পর্যন্ত বাপ-বেটাকে মারতে মারতে মেরেই ফেলে। প্রায় ৪০-৪৫ বছর সেই কাহিনী যখনই শুনেছি তখনই চোখে পানি রাখতে পারিনি। সেই বাবর আজ নেই। হানাদারদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে প্রায় দুই মাস সকাল-বিকাল থানায় হাজিরা দিত। তারপর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পালিয়ে যায়। বাসাইলের ফুলকি-ঝনঝনিয়ায় গিয়ে আশ্রয় চেয়ে আমায় চিঠি লেখে। সে তখন ভাবতেও পারেনি মুক্তিবাহিনী অতটা সবল হয়ে উঠেছে। তাকে সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয় দেওয়া হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় নানা কাজে। লেখক মানুষ, তার যে কাজ তার বাইরে তাকে টানার উপায় ছিল না। কবিদের কবির মতোই থাকতে দিতে হয়। আত্মভোলা মানুষদের বেশি টানাটানি করলে সবকিছু উলট-পালট হয়ে যেতে পারে। তাই সব সময় সাবধানে চলেছি। আমি একদল কবি-সাহিত্যিক পেয়েছিলাম, যারা অস্ত্র হাতে তেমন যুদ্ধ না করলেও যোদ্ধাদের অস্ত্র শানিত করেছে নানাভাবে। যুদ্ধের প্রেরণা জুগিয়েছে পদে পদে। তার মধ্যে রফিক আজাদ, বুলবুল খান মাহবুব, মাহবুব সাদিক, সায্যাদ কাদির, আবু কায়ছার অন্যতম।

স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধুর হাতে আমরা অস্ত্র তুলে দিলে পূর্বদেশে কাদেরিয়া বাহিনীর এক বিরাট ক্রোড়পত্র ছাপা হয়েছিল। সেখানে মূল চালিকাশক্তি ছিলেন কবি রফিক আজাদ আর সায্যাদ কাদির। অধ্যাপক মাহবুব সাদিক ও মামুনুর রশীদও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। আর এখন বুলগেরিয়ায় বসবাস করে বিখ্যাত হার্ট সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম।

বন্ধু কবি সায্যাদ কাদির কখনো এক জায়গায় থাকেনি। স্বাধীনতার পরপরই মাহবুব সাদিক আর সায্যাদ কাদির করটিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে চাকরি নিয়েছিল। কয়েক বছরে সবার প্রিয় শিক্ষক হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চাকরি ছেড়ে চায়না রেডিওতে ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে বেইজিং চলে যায়। সেখানে কয়েক বছর চাকরি করে বিচিত্রায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেয়। সেখানেও মন টেকেনি। কত কী যে করেছে। যে বিচিত্রায় সম্পাদক হিসেবে সায্যাদ কাদির কাজ করত তখন বর্তমান মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ওখানেই কাজ করতেন। পরে মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে যতবার কথা হয়েছে সায্যাদ কাদির আমার বন্ধু এটা জেনে খুব উল্লসিত হতেন এবং সায্যাদ কাদিরের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। মরার সময় মানবজমিনে চাকরি ছিল না। সারা জীবনই আর্থিক দৈন্যে কেটেছে। কখনো সচ্ছল হতে পারেনি। দেলদুয়ারের বাপ-দাদার জমিজমা যা ছিল তা বিক্রি করে ঢাকায় ১২০০-১৩০০ বর্গফুটের একটা ফ্ল্যাট বাড়ি কিনেছিল। ওটাই ছিল তার সম্বল। আগে আমার কাগজ কলমের সঙ্গে দেখা ছিল না। তাই বাবরের কোনো প্রয়োজন হতো না। কিন্তু লেখালেখিতে হাত দেওয়ায় বাবর ছিল আমার ডিকশনারি। কোনো কবিতা, গান, লেখা, শব্দ, কোনো কিছু নিয়ে অসুবিধায় পড়লেই বাবরের শরণাপন্ন হতাম। কম্পিউটারের মতো সঙ্গে সঙ্গে বলে দিত। এ ব্যাপারে কবি সামাদ আমার প্রিয় মাধ্যম। সামাদ অনেক ক্ষেত্রে যখন যেটা জিজ্ঞাসা করি উত্তর দিয়ে সাহায্য করে। কিন্তু বাবরের মতো নয়। রফিক আজাদ, আবু কায়ছার যত দিন বেঁচেছিলেন সাহায্য করেছেন। কিন্তু বাবর ছিল এক নম্বর। সেই বাবর সেদিন আমাদের সবার মায়া কাটিয়ে চলে গেছে— এটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আরও কষ্ট কত মানুষ স্বাধীনতা পুরস্কার পেল, একুশে পদক পেল কিন্তু কত শত শত জনের চেয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিরাট অবদান রাখার পরও বাবর কিছুই পেল না। নাকি কোনো সরকারের কাছে সে মাথা বিক্রি করেনি! সেজন্য সে তার জীবদ্দশায় কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান পায়নি। জানি কবি সায্যাদ কাদির বাবর হয়তো একদিন বাংলা সাহিত্যে তার অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান পাবে। কিন্তু সে এপারে থাকতে পেল না। সেপারে গিয়ে পাবে এই যা পার্থক্য। দয়াময় আল্লাহ তাকে বেহেশতবাসী করুন—আমিন।

লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর