রবিবার, ২৪ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

ব্যাংকিং খাত সোমনাথ মন্দির নয়

নঈম নিজাম

ব্যাংকিং খাত সোমনাথ মন্দির নয়

সংসদে আজকাল কেউ কথা বলেন না। সত্য উচ্চারণে সবার কোথায় যেন ভয় অথবা চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। তার পরও সংসদে বেশ কয়েকজন এমপি মাঝে মাঝে কথা বলেন। জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ তাদের একজন। কিছুদিন আগে সংসদে তিনি ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থানকে সোমনাথ মন্দির লুটের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অনেক দিন পর পুরনো ইতিহাস মনে পড়ে গেল। সোমনাথ মন্দিরের অবস্থান ভারতের গুজরাটের পশ্চিম অঞ্চলে। হিন্দু দেবতা শিব সোমেশ্বর মহাদেবের নামে মন্দিরটি স্থাপন করা হয়েছিল। পুরাণ অনুসারে চন্দ্র তার স্ত্রীদের মধ্যে রোহিণীকে বেশি ভালোবাসতেন। এতে উপেক্ষিত হন বাকি ২৬ স্ত্রী। ভিতরে ভিতরে তাদের রক্তক্ষরণ ছিল। যন্ত্রণা ছিল। এই স্ত্রীরা ছিলেন দক্ষ প্রজাপতি কন্যা। এ কারণে দক্ষ ক্ষয়িত হওয়ার অভিশাপ দেন চন্দ্রকে। শাপ থেকে মুক্তি পেতে চন্দ্র তীর্থে আরাধনা করেন শিবের। খুশি হয়ে শিব অভিশাপ অংশত নির্মূল করেন। কৃতজ্ঞ চন্দ্র সোমনাথে একটি সোনার মন্দির নির্মাণ করেন শিবের নামে। পরে রাবণ রৌপ্যে, কৃষ্ণ চন্দনকাঠে, রাজা ভীমদেব পাথরে মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন। এই মন্দিরে সম্পদের শেষ ছিল না। বিশেষ করে সোনা-রুপা মণ্ডিত এমন মন্দির আর একটিও ছিল না। এ কারণে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর নজরে আসে মন্দিরটি। ইতিহাসে মিথ আছে, গজনির সুলতান মাহমুদ এই মন্দির আক্রমণ করেন বার বার। কারণ ছিল একটাই— সোনা লুট। প্রথমবার আক্রমণের পর মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে সোনার তৈরি আসবাবপত্র ও মূর্তি দেখে বিস্মিত হন সুলতান। এরপর তিনি সেনাদের নির্দেশ দেন সোনা নিয়ে নেওয়ার। শুধু গজনির সুলতান নন, আরও অনেক শাসক সোনার লোভে এই মন্দিরে হামলা করেছিলেন। লুটও করেছেন ইচ্ছামতো। জাতীয় পার্টির নেতা সেই ইতিহাসকে ইঙ্গিত করলেন বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে। এতটা খারাপ অবস্থা আমি মনে করি না। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় এড়ানোর মতোও নয়। আর্থিক খাত অনেক দিন থেকে প্রশ্নবিদ্ধ। এ অবস্থার অবসান দরকার। ব্যক্তিবিশেষের ওপর কোনো খাতই নির্ভরশীল থাকতে পারে না। জনগণের সম্পদের একটা স্বচ্ছতা সবাই আশা করে। একটা সময় ব্যাংক ছিল সবার কাছে মন্দিরের মতোই। জনগণের সম্পদ-আমানত রাষ্ট্র পবিত্রতার সঙ্গে দেখভাল করত। কেউ অনিয়ম করলে রাষ্ট্র কঠোর ব্যবস্থা নিত। আমাদের সেই অতীতকে মনে রাখতে হবে। আমরা হয়তো আগের যুগে যেতে পারব না। কিন্তু সবকিছু জলাঞ্জলিও দেওয়া যাবে না। ন্যূনতম একটা স্বচ্ছতা ও মর্যাদার জায়গা ধরে রাখতে হবে আর্থিক খাতে। বড় ছোট ফকির মিসকিনের উৎপাত বন্ধ করতে হবে।

সমস্যা আছে, থাকবে। কিন্তু এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। মানুষ যাতে নিজেদের বড় অসহায় মনে না করে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকারকে অবশ্যই থাকতে হবে জবাবদিহিতার অবস্থানে। ক্লান্ত হয়ে উঠলে চলবে না। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমি দেখেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রাখছেন এক ঘণ্টা ধরে। প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। তার চোখে-মুখে কোনো ক্লান্তি নেই। অনেক প্রাণোচ্ছল। কিন্তু তার মন্ত্রিসভার চার সদস্য এ সময় ঘুমাচ্ছিলেন। শুধু সেদিন নয়, সংসদে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে, বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে অনেক মন্ত্রী এসে ঘুমিয়ে পড়েন। বিরক্তিকর একটা ব্যাপার। আমরা জানি, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে জীবন শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ফজরের নামাজ পড়েন। কোরআন তিলাওয়াত করেন। এরপর শুরু করেন দিনের কার্যক্রম। আমাকে একজন সচিব বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফাইল পড়েন। মন্তব্য দেন। মতামত লেখেন। তার বিরামহীন এগিয়ে চলা বাংলাদেশকে নতুন মর্যাদার আসনে নিয়েছেন বিশ্বে। কিন্তু তার মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য এখন অচল। অনেকে বছরজুড়েই অসুস্থ থাকেন। ঘুমিয়ে পড়া দেখেই মনে হয়, ওনাদের বিশ্রাম দরকার। এই বয়স্ক মানুষগুলোকে আশা করি আগামীতে আর কষ্ট না দেওয়াই ভালো। তারুণ্যে উদ্দীপ্ত করেই এগিয়ে যেতে হবে ক্ষমতাসীনদের। এ নিয়ে পুরনো একটা গল্প মনে পড়ছে। ’৭৭ সালে ইন্দিরা সরকারের পতনের পর অনেক বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হয়। তখন দিল্লির একজন সাংবাদিক লিখেছিলেন, ইন্দিরা প্রাণবন্ত। সঞ্জয়কে দোষারোপ করারও কারণ নেই। কিন্তু ইন্দিরা মন্ত্রিসভার সদস্যরা বৈজয়ন্তীমালার অনুষ্ঠানের নাচগানের মাঝেও ঘুমিয়ে থাকতেন ক্ষমতার সময়। দরকার ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন। ইন্দিরা আবার সরকার গঠনের পর অনেক পরিবর্তন এনেছিলেন। রাজনীতির মাঠে একবার ক্লান্তি পেয়ে বসলেই সর্বনাশ। আর অহমিকা ভর করলে ডাবল সর্বনাশ।

অহমিকার পরিণতি বিএনপি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বিএনপি ২০১৪ সালে একটা ট্রেন ফেল করেছে। সরকার যা চেয়েছিল তারা তাই করেছিল তখন। ক্ষমতায় চলে এসেছি ভাব নিয়ে ভোট করেনি। দিল্লি গিয়ে আতিথেয়তা নিয়ে ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সময় নির্ধারণ করে তা রক্ষা করেনি। একটা ভয়াবহ অহমিকা ছিল। এই অহমিকা-দাম্ভিকতাই তাদের সর্বনাশ করে দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে। মিডিয়া চালাতে গিয়ে শুধু সরকারি দলের রোষানলে থাকি তেমন নয়। মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে বিএনপি নেতারাও ছাড়েন না। হুমকি-ধামকি দিয়ে বসেন। কেউই বাস্তবতায় থাকতে চান না। ক্ষমতার নেশাটা বড় কঠিন। এই কাঠিন্য অতি বাড়াবাড়ির কারণে একটা জটিল রাজনীতির দিকে নিয়ে যায়। সেই জটিলতা এড়িয়ে বিএনপি এখন চেষ্টা করছে একটা কিছু করতে। ঘুরে দাঁড়াতে। কিন্তু রাজনীতির অঙ্ক বড় জটিল। একবার ভুল হলে সময় লাগে। লম্বা সময়। কারণ চলার পথে মানবজীবনে অদ্ভুত অনেক ঘটনা ঘটে যায়। যার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ইতিহাস থেকে একবার ছিটকে পড়লে আর বের হওয়া যায় না। এখন বিএনপিকে স্বাভাবিক রাজনীতি করতে হলে ভোটে আসতে হবে। অতীতে করা ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ’৭০ সালে ভোটে অংশ না নিয়ে মওলানা ভাসানীর মতো নেতাও জাতীয় রাজনীতি থেকে আড়াল হয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের ভোটে অংশ নিলে আর যাই হোক বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতে হতো না। বিএনপিকে বর্তমান দুর্ভোগে পড়তে হতো না। রাজনীতির মূল মঞ্চ থেকে আড়ালে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকত না। ভোটের পর লাগাতার আন্দোলন, কর্মসূচি প্রত্যাহার না করা ছিল আরেক ভুল। মানুষের মনে আন্দোলন নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। মানুষ হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচির কথা ভুলে গেছে। এখন আর কেউ এ ধরনের কর্মসূচি দেখতে চায় না। এ কারণে বেগম জিয়ার মতো নেত্রী আটকের পর সারা দেশে বিএনপি কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি। এমনকি তার চিকিৎসা নিয়েও তাদের মুখে উচ্চতর শব্দও শুনি না আজকাল। তাদের এখনকার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, পথের ক্লান্তি পেয়ে বসেছে। এই ক্লান্তি থেকে সরতে হলে অনেক কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। বিএনপি তা কতটা করতে পারবে জানি না। সময় বলে দেবে অনেক কিছু। অনেকে মনে করেন সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ হবে অনেক জটিল ও কঠিন। সেই কঠিন মাঠ সবার জন্যই অগ্নিপরীক্ষার। হিসাব-নিকাশের খেলায় অনেক সময় ঢেউ খেলে যায় চারপাশের গতি-প্রকৃতিতে।

এর মাঝে বিশ্বরাজনীতিতে পরিবর্তনের ঢেউ চলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই সবকিছু ওলট-পালট করে দিচ্ছেন। এখানে হিসাব-নিকাশও মেলাতে পারছেন না আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। কারণ পূর্ব-পশ্চিমের বন্ধনে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। কয়েক বছর আগেও ভাবা যেত না আমেরিকা আর উত্তর কোরিয়া একসঙ্গে বসবে। অথচ বৈঠক হয়েছে। অন্যদিকে এই উত্তেজনায় জি-৭-এর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে ট্রাম্পের। ফ্রান্স, জাপান মুখ খুলেছে। তারা খোলামেলা কথা বলতেও শুরু করেছে। এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই ট্রাম্পের। বরং শুধু কোরিয়া নয়, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন বন্ধনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এখন সবকিছুতে ওয়েস্টের কূটনীতি ইস্টকে ঘিরে। বাস্তবতায় চোখ মেলে ট্রাম্পকে বোকা মনে করার কারণ নেই। ট্রাম্প একজন বড় মাপের ব্যবসায়ী। অনেক ব্যবসার মাঝে গলফ ক্লাব, হোটেলের পাশাপাশি ক্যাসিনো ক্লাব ছিল। ব্যবসায় হয়তো একসময় ট্রাম্প অনেক জুয়া খেলেছেন। রাজনীতিতে খেলবেন না তা মনে করার কোনো কারণ নেই। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ট্রাম্পের বর্তমান অবস্থান ইতিহাসের নতুন অধ্যায়। এ অধ্যায় বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতিকে কোন দিকে নেবে তা বলা মুশকিল। তবে আমার মনে হয়, ট্রাম্পের সব কাজই পরিকল্পিত, সাজানো। মাঝে মাঝে ট্রাম্প নাটক করেন অনেক কিছু নিয়ে। বাস্তবে সবকিছুই তার বুঝে শুনে করা। ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশ পরিষ্কার রেখেই তার এগিয়ে চলা। এ কারণে মিডিয়া কিংবা বিশ্বনেতাদের সমালোচনাকে গ্রাহ্য করার সময় তার নেই। তার কাজ যুক্তরাষ্ট্রে নতুন এক ইতিহাস তৈরি। এ ইতিহাস তৈরিই প্রভাব রাখছে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতিতে। এ ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে আমাদের দেশেও। কারণ বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতিতে একটা নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। এ সূচনা ইতিবাচক না নেতিবাচক আমি সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমাদের সামনে আরও অনেক লড়াই। এ লড়াই অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজে, রাষ্ট্রে, ধর্মীয় চিন্তা-চেতনায় বাস্তবতায় থাকার। সারা দুনিয়ার মুসলিম দেশগুলো রয়েছে হানাহানিতে। বাংলাদেশ একমাত্র স্থিতিশীলতায় ব্যতিক্রম। অর্থনীতিতে ইতিবাচক উচ্চতায় আমরা। দরকার আইনের শাসন ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা টিকিয়ে রাখার। আর কোনো কারণে এ নিয়ে হোঁচট খেলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব হবে চ্যালেঞ্জের। বাংলাদেশের সুন্দর আগামীকে ধরে রাখতে হবে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান আর দেখতে চাই না। ধ্বংসলীলা কারোরই কাম্য নয়। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের প্রয়োজন নেই আর্থিক খাতে। ব্যাংকগুলো সোমনাথ মন্দির বানানো যাবে না। জনগণের আমানতের নিশ্চয়তা তৈরি করতে হবে। রাজনীতির নামে শুধু ব্যবসায়ী তৈরি হলে চলবে না। উন্নয়নের নামে ব্যক্তিবিশেষের অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। কবর রচনা করতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির। মাদক ও ভেজালের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অব্যাহত রাখতে হবে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের ডেকে এনে আওয়ামী লীগের নেতা বানানোর দরকার নেই। আওয়ামী লীগকে তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা নিয়ে চলতে হবে। আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনতে হলে শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গড়ে ওঠা ইমেজ ও উচ্চতা ধরে রাখতে হবে। তিনি শুধু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নন, তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার কন্যা। তার বাবার হাত ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর উৎসব তার নেতৃত্বে হোক— এ প্রত্যাশা অনেকের। এ প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে আওয়ামী লীগকে নতুন মাত্রার রাজনীতি উপহার দিতে হবে দেশবাসীকে। অহমিকা নিয়ে বসে থাকলে হবে না। পচা শামুকে অনেক সময় পা কাটে। ঘাটে ঘাটে গজিয়ে ওঠা সুবিধাভোগী চক্রের কারণে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তা কোনোভাবে কাম্য নয়।

            লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর