কোনো শিশু রেললাইনে পড়ে গেলে কী করবে মানুষ? এ প্রশ্ন দক্ষিণ কোরীয় সাহিত্যিক হান কাংয়ের। উত্তরটা খুব সহজ। উদ্বিগ্ন মানুষের ভিড় জমে যাবে। তাঁকে বাঁচাতে কেউ জীবন বাজি রাখবেন নিশ্চয়ই। মানবিক মানুষ অন্তত তাই করে। অথচ মানুষের ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। নিপীড়ন, রক্তপাত, যুদ্ধ-বিগ্রহে এ মানুষ হয়ে উঠেছে দানব। গত শতকের শুরুতে কোরিয়ায় জাপানের দখলদারি, দুটি বিশ্বযুদ্ধ, তারপর দেশে উগ্রপন্থিদের সহিংসতা অজানা নয়। তার জবাবে ই স্যাং, কোরীয় আধুনিক কবি লিখলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, মানুষের উচিত বৃক্ষে পরিণত হওয়া।’ কথাটি মনে গেঁথে রইল হান কাংয়ের। ১৯৯৭ সালে একটি গল্প লেখেন তিনি। নাম ‘দ্য ফ্রুট অব মাই ওম্যান’। ওখানে একটি মেয়ে সত্যি সত্যি গাছ হয়ে যায়। এর অনেক বছর পর সেই ছবিটাকে ঘিরেই দ্য ভেজিটেরিয়ানের ভাবকাঠামো দাঁড় করান হান। প্রেক্ষাপট হয় আরও অন্ধকার, আরও ভয়ানক।
প্রায় এক দশক পর ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। সারা বিশ্বে তোলপাড় তোলে। এ উপন্যাসে দেখা যায়, মানুষের নৃশংসতাকে চ্যালেঞ্জ করা এক তরুণীকে। মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয় সে। এ ঘটনাপ্রবাহে গোটা পরিবারেই টানাপোড়েন শুরু হয়। অবলীলায় সম্পর্কের সুতা কেটে যায়। হান দেখান কত ঠুনকো মানুষে মানুষে বন্ধন! ইতিহাসের ট্রমায় ভুগতে থাকা মানুষ বৃক্ষ হয়ে উঠতে চায়। মানুষ কতটা মহৎ হতে পারে, সেদিকে সবার নজর ফেরাতে চান লেখিকা। সম্পর্কের শেকড়ের পচন দেখাতে পাঠককে নিয়ে চলেন কালের পরিক্রমায়। মানুষের দ্বিচারিতা, ভঙ্গুর সমাজ, ফাঁপা সম্পর্ক পেরিয়ে মানুষের উজ্জ্বল দিকটিও দেখাতে চান।
‘গ্রিক লেসনস’-এ তুলে ধরেন বিপরীত লিঙ্গের দুই মানুষের কথা। যাদের একজন কথা বলতে পারেন না, অন্যজন দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছেন। গ্রিক ভাষা শিখতে এসে তারা যে সম্পর্কের ভিত গড়তে শুরু করেছিল তা মুখোমুখি হয় কঠিন বাস্তবতার। ক্রমশ একে অন্যের যাপিত জীবনের ভীতিপ্রদ সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় তারা। সম্পর্কের গভীরে এ লড়াই তুলে এনেছেন তিনি।
২০১৫ সালে ডোবারা স্মিথ ‘দ্য ভেজেটেরিয়ান’ বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করার পর পাঠকরা জানতে পারেন হান কাংয়ের নাম। পরের বছরই ম্যান বুকার পুরস্কার জেতেন তিনি। তার বয়স তখন ৪৫ বছর। বিশ্ব পরিচিতি পাওয়ার আগের গল্পটা অবশ্য সাদামাটা। প্রথম দুই শিশু সন্তানের মৃত্যুতে শারীরিকভাবে নাজুক ছিলেন হান কাংয়ের মা। অনেক ওষুধ খেতে হতো তাকে। এমন সময় গর্ভে এলো আরেক সন্তান। তখন ভেবেছিলেন এ সন্তান হয়তো জীবনটাই কেড়ে নেবে। গর্ভপাত করতে চান তিনি। কিন্তু চিকিৎসকরা বাদ সাধেন। বলেন, গর্ভের সন্তানের বয়স বেশি। এখন গর্ভপাতের ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো। জন্মই যেন সৌভাগ্যের, উপহার হান কাংয়ের।
১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে জন্ম হয় তার। তার বাবা হান সিউং ওন একজন সাহিত্যিক। নিজের জন্মস্থান ও অভিজ্ঞতার কথা লিখতেন। সাহিত্যিক পরিচিতি থাকলেও লেখালেখি করে সংসার চালানোর মতো আয় হতো না। বই দিয়ে সাজানো ছিল ঘর। বাবার লেখালেখি, উৎসাহ থেকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে হান কাংয়ের। এই পাঠাভ্যাস প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আমাদের বাড়িতে প্রচুর বই ছিল, ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার একটা ভালো পরিবেশ পাই। আমি মনে করি এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। কোরিয়ান লেখকদের খুব পছন্দ করতাম। বিভিন্ন অনুবাদের বইও অনেক পছন্দের ছিল। অ্যাস্ট্রিড লিন্ডগ্রেনের ‘দ্য ব্রাদার্স লায়নহার্ট’-এর কথা আলাদা করে বলতে হয়। কোরিয়ান লেখকদের মধ্যে লিম চুল-উয়ের ছোটগল্প দারুণ পছন্দ করতাম। বিদেশি লেখকদের মধ্যে দস্তয়েভস্কিকে ভীষণ ভালোবাসি।” কিন্তু খুব বেশিক্ষণ পড়তে পারতেন না। মাইগ্রেনের ব্যথায় কাবু হয়ে পড়তেন। পরিণত সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর হান বলেছিলেন, ‘‘প্রচণ্ড মাথাব্যথা আমাকে কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আমার পড়া, লেখালেখি কিংবা সমস্ত কাজের রুটিন তখন বন্ধ হয়ে যায়। তখন ভাবি যে, আমি অমর কোনো প্রাণী নই। আর এটিই আমাকে নম্র-ভদ্র করে তোলে, নিজেকেই মূল্যবান ভাবতে শিখি। আমি শতভাগ সুস্থ থাকলে, কখনই একজন লেখক হতে পারতাম না।’’
১৯৮০ সালের দিকে গোয়াংজু ছেড়ে সিউলে চলে আসে তার পরিবার। মাত্র চার মাস পরই গোয়াংজুতে সামরিক সরকারের সঙ্গে লড়াই বাধে স্থানীয় জনতার। হানের ভাষায়, ‘এ যেন দুই চরমপন্থি দলের লড়াই।’ বেসরকারি হিসাবে এ সংঘাতে হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। এ নিয়ে গোপনে একটি আলোকচিত্রসংবলিত বই প্রকাশ হয়েছিল। হানের বাবা সেটি লুকিয়ে বাসায় নিয়ে আসেন। বইটি ছিল হত্যাযজ্ঞের এক অকাট্য দলিল। পাতায় পাতায় সহিংসতার প্রমাণ। এসব দেখে হানের মনে একটাই প্রশ্ন জাগে, মানুষ একে অন্যের সঙ্গে এমন সব করতে পারল কেমন করে? সহিংসতা গভীর দাগ কাটে হান কাংয়ের হৃদয়ে। সেই রক্তক্ষরণ দেখতে পাওয়া যায় তার কবিতায়। ১৯৯৩ সালে লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটিতে মাত্র ২৩ বছর বয়সে প্রথম পাঁচটি কবিতা প্রকাশ হয় তার। তার গদ্য সামনে আসে আরও দুই বছর পর, ১৯৯৫ সালে। ছোট গল্পের সংকলন ‘লাভ অব ইয়েসু’ পড়েই পাঠক টের পান তার গদ্য কবিতার অলংকার দিয়ে সাজানো। হান নিজেই বলেন, ‘আমার গদ্য কাব্যে আক্রান্ত এবং এই কাব্যিকতা সচেতন নয়, বরং অবচেতনে অনুপ্রবেশ করে। তারপর দখল করে নেয় তার গদ্যের পৃথিবী।’
হান কাংয়ের দেখা দুনিয়া কেমন? এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘মানুষের কর্মকাণ্ড মানবীয় সহিংসতার ব্যাপারে মনোযন্ত্রণা দিয়ে শুরু হয়। আমি শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে চেয়েছিলাম মানবীয় মর্যাদায়, সেই উজ্জ্বল স্থানে, যেখানে ফোটে ফুল। সেটা ছিল আমার উপন্যাস লিখে চলার বড় অনুপ্রেরণা।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পেয়েছিলেন ৫৩ বছর বয়সে। সেই ইতিহাসের যেন পুনরাবৃত্তি ঘটল। ৫৩ বছর বয়সেই এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেলেন হান কাং।
তিনিই প্রথম কোনো দক্ষিণ কোরীয় লেখক, যিনি নোবেল জিতলেন। তাকে নিয়ে নোবেল কমিটির মূল্যায়ন, নিজের সাহিত্যকর্মে ‘ইতিহাসের ট্রমা ও মানবজীবনের ভঙ্গুরতা’কে তীব্র কবিতাময় গদ্যের মাধ্যমে উন্মোচিত করেছেন। খবরটি জানাতে নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে ফোন দেওয়া হয় হানকে। ফোন তুলেই বললেন, ‘আমি বেশ অবাক হয়েছি। তখন কেবল সন্ধ্যা। আমার ছেলের সঙ্গে রাতের খাবার শেষ করার পরই আমি নোবেল জয়ের খবরটি পাই।’ নোবেল পুরস্কার পাওয়া কীভাবে উদযাপন করবেন? উত্তর দিলেন, ‘ফোন রেখে আমি আমার ছেলের সঙ্গে বসে চা খাব।’ ব্যস এটুকুই! তার নোবেল জয়ের খবরে উৎসব আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাতে বাধা দেন হান। বাবাকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘দয়া করে এই দুঃখজনক ঘটনার (ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের দিকে ইঙ্গিত) সাক্ষী হয়ে কোনো আনন্দ উৎসব উদযাপন করবেন না।’
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জেতার পর নিজ দেশে সাত দিনে হান কাংয়ের ১০ লাখেরও বেশি বই বিক্রি হয়েছে। নোবেলজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষণার অল্প সময়ের মধ্যে দেশটির স্থানীয় বই বিক্রেতাদের ওয়েবসাইটগুলো অত্যধিক ইন্টারনেট ট্রাফিকের কারণে ক্র্যাশ করে। হান কাং রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৮। দ্য ভেজিটারিয়ান ছাড়াও তার আলোচিত গ্রন্থগুলো হলো-‘এ কনভিক্টস লাভ কনভালেসেন্স’, ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’, ‘ফ্রুটস অব মাই ওমেন’, ‘গ্রিক লেসনস’। হানের পরামর্শ নতুন পাঠকরা যেন তার সর্বশেষ বই ‘উই ডু নট পার্ট’ দিয়ে তার দেখা দুনিয়ায় প্রবেশ করেন।