শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোলটেবিল বৈঠক

পরিবর্তনের জন্য আত্মবিশ্বাসী হও

পরিবর্তনের জন্য আত্মবিশ্বাসী হও

গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রতিদিন গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। নারীর সমস্যা, উন্নয়ন, অর্জন ও সম্ভাবনার নানা দিক তুলে আনেন বক্তারা। গোলটেবিল বৈঠকের মিডিয়া পার্টনার ছিল নিউজ টোয়েন্টিফোর। চুম্বকাংশ তুলে এনেছেন— তানিয়া জামান, আবদুল কাদের ও সাইফ ইমন ছবি তুলেছেন— রোহেত রাজীব

 

 

নারী সহিংসতার বিষয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে

মেহের আফরোজ চুমকি

প্রতিমন্ত্রী

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়

আমরা সমতায় বিশ্বাসী এবং সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। মার্চ মাসটি আমাদের ইতিহাসে অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মাস। তার সঙ্গেই যুক্ত আমাদের নারী দিবস। শুরুতেই ভক্তি ও শ্রদ্ধাভরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করছি। আমরা মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, চিকিৎসক, অভিনেত্রী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক যাই হই না কেন, আমরাই কারও না কারও মা, খালা, বোন, শাশুড়ি, কিংবা প্রতিবেশী। কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনাগুলো প্রায় একই রকম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের মেয়েরা এখন সব বিভাগে কাজ করছে। যেখানেই মেয়েদের সুযোগ হচ্ছে সেখানেই মেয়েরা তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করছে। সবাই কম-বেশি তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারছে। এই সংখ্যাটা আমাদের বাড়াতে হবে। সংখ্যাটা এখনো সমতায় আসেনি। সেই সমতায় আসার জন্য আমাদের যে জায়গাগুলো দুর্বল যেমন— শিক্ষা এবং দরিদ্রতা। সেই জায়গায় নারীদের সহযোগিতা করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে। আমরা বলব, নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ কমাতে হবে। এসব বিষয়ের প্রতি যদি আমরা সঠিক নজরদারি ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারি তবে আমরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যাব। নারীর প্রতি যখনই কোনো সহিংসতা দেখছে তত্ক্ষণাৎ আমাদের প্রশাসন আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টায় এসব সহিংসতার মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। নারী সহিংসতার বিষয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে। আইনে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর এবং ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১ বছর ধার্য করা হয়েছে। আমাদের আইনটা অনেক কঠিন আইন। এখানে কাজী থেকে শুরু করে বিয়ের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত থাকবেন তাদের ৬ মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এই বিষয়গুলো উল্লেখ আছে। বাল্যবিবাহে কাজীর লাইসেন্সও বাতিল হয়ে যেতে পারে। এসব বিষয়ে সচেতনতা গড়তে পারলেই আমরা বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে পারব।

 

নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে সুশিক্ষিত হতে হবে

সাগুফতা ইয়াসমিন

সংসদ সদস্য

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নারীকে রাজনৈতিক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। নারী পৃথিবীর সব জায়গায় নিগৃহীত। পশ্চিমা দেশে মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। আমরা চাই নারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এগিয়ে আসুক। নারী-পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে থাক। আমরা একটি সুষম সমাজ চাই। এখন আমি সমধিকার চাই না, অগ্রাধিকার চাই। নারীকে সত্যিকার অর্থে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নারীদের মর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। প্রতিটি নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নারী শান্তিকামী, নারী মমতাময়ী, নারী শক্তি। অর্থাৎ নারী অগ্রসর না হলে এ সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র কখনই এগিয়ে যেতে পারবে না। নারীর উন্নয়ন হলেই সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন হবে।

 

আমাদের নারী এগিয়ে গেছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কারণে

অ্যাডভোকেট নূরজাহান বেগম মুক্তা

সংসদ সদস্য

বিশ্বে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের নারীরা সবচেয়ে এগিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে। এ ছাড়া বর্তমান সরকার নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন করেছে, প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন করেছে, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন করেছে এবং আরও উন্নত করার চেষ্টা করছে। আমাদের প্রশাসনে শীর্ষ পর্যায়ে ৭.৬ শতাংশ নারী আছে। এসব তথ্য আমাদের নারীর ক্ষমতায়নে উচ্চকিত করে। আমাদের নারী এগিয়ে গেছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কারণে। এ ব্যাপারে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট আন্তরিক। সেজন্য তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক পুরস্কারও পেয়েছেন। নারীরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আজকে এভাবে একত্রিত হয়ে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। এর অর্থ হলো আমরা সচেতন হচ্ছি বলেই এগুলো করতে পারছি।

 

সব কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে

সাবিনা আক্তার তুহিন

সংসদ সদস্য

নারীদের প্রকৃত জায়গাটা এখনো আমরা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা এখনো অবহেলিত। নারীর অর্জিত সম্পত্তিতে সমঅধিকারের দাবি নিয়ে আমরা আন্দোলন করেছি। কিন্তু আমাদের বাধা দেওয়া হয় বিভিন্ন মহল থেকে। আবার আমাদের এই যৌক্তিক দাবিতে সমাজের সর্বস্তরের নারীকে সঙ্গে পাইনি। নারীদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে সবার আগে। নিজেদের আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। নারীদের সব কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে বাসায় যে মেয়েটি কাজ করে সে নির্যাতিত হচ্ছে কিনা পরিবারের পুরুষদের দ্বারা তা খেয়াল রাখতে হবে। স্বামীকে কিংবা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের প্রতি নারীদের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নারীদের আত্মবিশ্বাসী হতে হবে নিজেদের অধিকার আদায়ে।

 

সমাজের প্রতিটি সেক্টরে নারীরা অবদান রাখছে

শামা ওবায়েদ ইসলাম

সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)

নারীরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে। নারীরা আজ প্লেন চালাচ্ছে, রাজনীতিতে সফল হচ্ছে, খেলাধুলায় সুনাম করছে, মিডিয়াতে কাজ করছে, উদ্যোক্তা হচ্ছে ইত্যাদি। নারীরা এখন অনেক এগিয়েছে। রাজনীতিতে একেবারে তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পদে সফলতার সঙ্গে কাজ করছে। সমাজের প্রতিটা সেক্টরে নারীরা অবদান রাখছে। এতকিছুর পরেও কোথায় যেন একটা ‘কিন্তু’ থেকে যাচ্ছে। আমার ধারণা, নারীরা ততটুকুই উঠতে পারে যতটুকু তাকে উঠতে দেওয়া হয়। একটা পর্যায়ে এসে নারীরা থেমে যায়।  একসময় নারী দিবসে হাজার হাজার নারী রাস্তায় নামত অধিকার আদায়ের দাবিতে। এখন তেমনটি দেখা যায় না। ১৯১০ থেকে ২০১৭ সালে এসেও আমাদের নারীদের জন্য লড়াই করে যেতে হচ্ছে। এই অবস্থা উত্তরণে সবাইকে ‘এজ অ্যা সোসাইটি’ হিসেবে কাজ করে যেতে হবে।

 

বহু নারী ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন

নাসরীন আওয়াল মিন্টু

প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ওমেন এন্টারপ্রেনার

অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ

নারীরা অনেক এগিয়ে গেছে এটা সত্য কথা। নারীরা এখন সংসদে তো বটেই, এর বাইরেও অনেক স্থানে এখন পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে নারীর বিচরণ। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও নারীদের আনাগোনা রয়েছে। এত কিছু সত্ত্বেও নারীরা কেন এখনো পিছিয়ে? এখনো ভাবার সময় আছে। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে একজন নারীর জন্য ঋণ নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার জন্য তো বটেই, আত্মবিশ্বাসের অভাবেও নারীরা ব্যবসায়ের মতো উদ্যোগে পিছিয়ে আছে। তা ছাড়া আমাদের দেশের বেশির ভাগ নারী উদ্যোক্তাই শহরের বাইরে। যারা ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিষয়ে জানা তো দূরের কথা তারা বেশ কিছুকাল আগেও ঘরের বাইরেই বের হতেন না। যদিওবা বের হতেন সঙ্গে একজন পুরুষ মানুষ থাকতেন। আর এই অবস্থান থেকেই হঠাৎ করে বহু নারী ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন।

 

অনুধাবন করতে হবে, সফল হতে পুরুষেরও সাহায্য লাগে

মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশিদ

নিরাপত্তা বিশ্লেষক

মালালা ইউসুফ জাই বলেছেন, কারও জন্য অপেক্ষা করো না, নিজের কথা নিজেই বলো। আমিও বিশ্বাস করি। নিজের কথা নিজেকেই বলা উচিত। কিছুদিন আগেও তো খবরে এসেছিল একটি মেয়ের ঘোড়া চালানোর গল্প। এই চ্যালেঞ্জধর্মী কাজে প্রশিক্ষক ছিলেন তার বাবা। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাওয়া, তার সফলতা সবকিছুর জন্য বাবাই উদগ্রিব থাকতেন। সেই বাবার যে উৎসাহ এবং উদ্দীপনা মেয়েকে সফল করল সেটি কিন্তু আসছে না। তাই শুধু বিদ্বেষ নয়, অনুধাবন করতে হবে সফল হতে পুরুষেরও সাহায্য লাগে। অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে নারীরা প্রতিবন্ধকতার শিকার হন। ধরেই নেন নারী হওয়ার জন্য এই সমস্যা। আমি মনে করি, এটি সামাজিক বা সহকর্মীর প্রতি দ্বান্দ্বিক আচরণ। আসলে এটি লিঙ্গভিত্তিক সমস্যা হিসেবে না নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার অভ্যাসটি গড়ে তুলতে হবে।

 

একটি বাইসাইকেলের দুটি চাকার একটি নারী অপরটি হলো পুরুষ

অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা

সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমি মনে করি, নারীরা জন্মগতভাবে আত্মবিশ্বাসী। শিশু অবস্থায় নারী-পুরুষ বৈশিষ্ট্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। জন্মের সময়  ছেলে-মেয়ে উভয়ে একই আত্মবিশ্বাস নিয়ে জন্মায়। কিন্তু মেয়ে যখন আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে, তখন তার হাতে-পায়ে পরিয়ে  দেওয়া হয় শিকল। আমাদের সমাজে ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের ফলে নারীরা প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সমাজ থেকে এসব সবার আগে দূর করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। একটি বাইসাইকেলের দুটি চাকার একটি নারী অপরটি হলো পুরুষ। সভ্যতার চাকা ঘুরায় নারী। অথচ নারীরাই দাসত্বের শিকার হচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা হলো মানসিকতা। আমাদের মনোস্তত্ত্বে পুরুষতন্ত্রের যে মগজটি আছে সেটি কিন্তু পরিবর্তনশীল নয়। নারীর উন্নয়নে নারীকেই সোচ্চার হতে হবে।

 

নারী উন্নয়নের জন্য যে পলিসি হয়েছে তা আগে কখনো হয়নি

মনোয়ারা হাকিম আলী

নারী উদ্যোক্তা

যে কোনো কাজে অংশগ্রহণ করলে বাধা আসবেই। সমস্যা সমাধান করেই এগিয়ে যেতে হবে। সমাধান হিসেবে প্রথমত কৌশল জানতে হবে। নারীরা মেধা দিয়ে পারে বিভিন্ন কৌশলকে প্রণয়ন করতে। আর সেজন্য দরকার আত্মবিশ্বাস। আমি পারব, আমাকে পারতে হবে এই কথাটি বিশ্বাস করে কাজ করলে সফল হওয়া সম্ভব। সবাই পুরুষশাসিত সমাজের দোহাই দেয়। বিভিন্ন কাজের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে এই সমাজকে দায়ী করা হয়। কিন্তু আমি মনে করি, আমার কর্মক্ষেত্র সেদিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা পুরুষদের সঙ্গে কাজ করি। সেখানে পুরুষের আধিপত্যের ঝামেলা নেই। আমাদের সরকার যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে এটি আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই সরকারের আমলে নারী উন্নয়নের জন্য যে পলিসি হয়েছে তা আগে কখনো হয়নি। দেখা যাচ্ছে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা কিন্তু পিছিয়ে নেই।

 

নারীদের জন্যই নারীকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে

ইমদাদুল হক মিলন

সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

আমাদের সমাজে অনেক সময় দেখা যায় পুরুষ সহকর্মীকে বলা হয় স্যার আর নারীকে বলা হয় আপা। সমান মর্যাদাসম্পন্ন দুটি মানুষকে আলাদাভাবে সম্বোধন করার এই মানসিকতা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। নারীদের জন্যই নারীকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। আমি একজন নারীর গল্প বলতে চাই। তার বয়স ৪০। সুশ্রী দেখতে। তার ১০টি বাচ্চা। ১৯৭১ সালে তার স্বামী মারা গেলেন। মারা যাওয়ার আগে তিনি একটি ছোট চাকরি করতেন। তাই তেমন কোনো অর্থবিত্তও রেখে যেতে পারেননি। ১০টি সন্তান নিয়ে সেই নারী একদম একা। হাতে ১০টি টাকাও নেই। অথচ মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা নারী চিন্তা করলেন আমাকে সন্তানদের মানুষ করতে হবে। আত্মবিশ্বাসটি এই জায়গায়। সেই মা তার ১০টি সন্তানকে মানুষ করেছেন। তার সবচেয়ে অযোগ্য সন্তানটি ইমদাদুল হক মিলন।

 

আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় প্রত্যয় থাকলে নারী সফল হবেই

নঈম নিজাম

সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সিইও, নিউজ টোয়েন্টিফোর ও রেডিও ক্যাপিটাল

ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, আমার মা আমাদের সংসার সামাল দিচ্ছেন। এটি দেখে আমি অভ্যস্ত। এখন দেখি, আমার সহধর্মিণী আমার সংসার সামাল দিচ্ছেন। আমার মা যেভাবে সংসার সামাল দিয়েছেন আমি আমার বাবাকে সেভাবে সংসার সামাল দিতে দেখিনি। নারীর আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় প্রত্যয় যদি থাকে তাহলে সফলতায় কোনো বাধা বিপত্তি থাকে না। ১৮ শতকে নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরী যিনি বেগম রোকেয়ার আগে নারী শিক্ষা ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন— পরবর্তীতে আরও অনেকেই এ সংগ্রামে যুক্ত হয়েছেন। তাদের আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল না। কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে একজন নারী সহকর্মী কাজের প্রতি অধিক যত্নশীল। তারা তাদের দায়িত্বের প্রতি অনেক বেশি সচেতন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীরা জিডিপি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

 

নিজেকে নারীতে সীমাবদ্ধ রাখতে রাজি নই

খুজিস্তা নূর ই নাহরিন

পরিচালক, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের রেজাল্ট পুরুষের চেয়ে ভালো। বিজনেস সেক্টরে নারীরা পিছিয়ে পড়ছে। এই সমাজ অর্থ-সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে নারীকে দেখে অভ্যস্ত নয়। আবার নারীদের নিজেদেরও আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি রয়েছে। আমার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পুরুষকে প্রাধান্য দিতে হচ্ছে। কারণ একজন নারীর মাতৃকালীন ছুটি কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সন্তান জন্মের পর দুই বছর সময় লাগে একজন নারীকে শারীরিকভাবে ফিট হতে। দেশে বেবি সিটিংয়ের সুবিধা নেই। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-এর ২৫০ জনের মধ্যে মাত্র ১৪ জন নারী সদস্য। আমি সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় এখানে আসতে পেরেছি। নিজেকে নারী হিসেবে মনে করিনি কখনো। আমি নিজেকে শুধু ‘নারী’তে সীমাবদ্ধ রাখতে রাজি নই।

 

কথাগুলো যুক্তি দিয়ে বলতে পারাটাই আত্মবিশ্বাস

অ্যাডভোকেট এলিনা খান

প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ হিউম্যান লাইফ ফাউন্ডেশন

আমার জীবনের প্রথম মামলা ছিল দেনমোহরের মামলা। এটি আমি জিতে যাই। প্রথম মামলা জেতায় আনন্দটাও ছিল বেশি। কিন্তু আমার পুরুষ আইনজীবী বললেন, আপনি মেয়ে-মানুষ বলে জজ সাহেব আপনাকে জিতিয়ে দিয়েছেন। তার প্রতিবাদে পাল্টা জবাব হলো আত্মবিশ্বাসের একটি অংশ। আমার কথাগুলো যুক্তিতে বুঝিয়ে বলতে পারাটাই হলো আত্মবিশ্বাস। দ্বিতীয়ত হলো, আমি একজন মানুষ এবং আমার মাঝে কোনো না কোনো প্রতিভা অবশ্যই রয়েছে। এই দুটি বিষয় যখন একসঙ্গে করতে পারব তখনই আমি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠব। নারীর এখন সমান অধিকার নয়, চাই অগ্রাধিকার। পরিবার মেয়ের পড়াশোনা, স্বাস্থ্য, যোগ্যতা, মর্যাদার কথা চিন্তা করে না। তাই পরিবারকে দায়িত্ব নিতে হবে।

 

নারীর গৃহকর্মের মর্যাদা ও মূল্যায়ন করতে হবে

ডা. জাহানারা আরজু

সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন সহকারী অধ্যাপক ছিলাম তখন এটাচড বাথরুমসহ কোনো বসার রুম পাইনি। অথচ আমার সময়ে যোগদান করা পুরুষ সহকর্মী ঠিকই এই সুবিধা পেয়েছে। আমাকে আমার অধিকার আদায়ের জন্য মাননীয় ভিসি স্যারের কাছে যেতে হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি এই বৈষম্য দূর করতে হবে। নারীদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তা না হলে অবস্থার উত্তরণ ঘটবে না। ঘরে বসে না থেকে যদি নিজ গৃহেই কৃষিসহ মৎস্য উৎপাদন করে তবে এতে করে শারীরিকভাবেও সে সুস্থ থাকবে। আমার কাছে এমন অনেক রোগী আসেন, যাদের ঘরে অলস বসে থাকার ফলে কোমরে ব্যথা ও মানসিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। নারীর গৃহকর্মের মর্যাদা ও মূল্যায়ন করতে হবে।

 

নারীকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বাধা উৎরাতে হবে

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

শুরুতেই বলব, কোনো পরিবারের একটি বাচ্চাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমার বাবা কী করে? সরাসরি উত্তর দেবে চাকরি, ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো পেশা। কিন্তু একই ক্ষেত্রে মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করা হলে বলবে, মা কিচ্ছু করে না। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত একজন মা তার সংসার সামাল দিচ্ছেন তা সেই বাচ্চাটির চোখেই পড়ল না। সামাজিক বাধাগুলো হলো— তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। আমি বলি, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হও। আমরা জানি যে, আমাদের আত্মবিশ্বাসী হতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আমাদের পরিবার, আমাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। যাদের এই তিনটি সামর্থ্যের একটিও নেই তারা যদি একবার নিজের পেছনের সময়গুলোর দিকে তাকায় তবে অবশ্যই মনে এক ধরনের সাহস জোগাবে।

 

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি

সামিয়া রহমান

হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, নিউজ টোয়েন্টিফোর

একবার আমার বাচ্চার স্কুলের এক অভিভাবক আমাকে বলেন, ভাবী আজকে আমি আমার স্বামীর পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা চুরি করেছি। আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনার স্বামীর টাকা, এখানে চুরি শব্দটি ব্যবহার করলেন কেন? তিনি বললেন, না আসলে গয়না বানানোর জন্য আমি এই টাকাগুলো জমিয়ে রেখেছি। আসলে আমাদের মানসিকতাই আমাদের ছোট করছে। সবার আগে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানসিকতার পরিবর্তন আনা জরুরি। বলা হয়েছে আত্মবিশ্বাসের কথা, বলা হয়েছে সংগ্রামের কথা, বলা হয়েছে প্রতিযোগিতার কথা, বলা হয়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর পিছিয়ে থাকার কথা, বলা হয়েছে নারী অগ্রাধিকারের কথা, নারী-পুরুষের সমান অধিকার, নারীর অগ্রাধিকার জরুরি।

 

কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই

নার্গিস আক্তার

চলচ্চিত্র নির্মাতা

আমি মনে করি, নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা কম। কোনো অফিসের বস যদি মহিলা হন আর তিনি যখন প্রয়োজনে শক্ত হবেন তাকে আখ্যায়িত করা হবে পুরুষালি বলে। আমি যখন এফডিসিতে প্রবেশ করি আমাকে লক্ষ্য করে বলে ‘ওই যে আসছে’। আমি মনে করি, আত্মবিশ্বাসী ও শক্ত থাকাটা খুবই জরুরি। আমি একটি প্রতিষ্ঠান চালাই। শুরুতে আমি ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করতাম। একবার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল, সেখানে আমার তিনজন নারী সহকর্মী প্রেগনেন্ট হয়। তাদের মেটারনিটি লিভ লাগবে। এদিকে এক পুরুষ সহকর্মী রেজা এসে জানান, তার স্ত্রী প্রেগনেন্ট। তার ছুটি লাগবে। আমি পেটারনিটি ও মেটারনিটি লিভ দুটোরই অনুমতি দিয়েছিলাম। আসলে কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই।

 

কর্মক্ষেত্রে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয় নারী

ডা. সহেলী আহমেদ সুইটি

সহকারী অধ্যাপক

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

সমাজে একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে যে নারীরা যে কোনো কাজই একটু কম পারে। ফলে নারীদের যে কোনো কাজে দ্বিগুণ পরিশ্রম করে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। আমি কানাডার সোসাইটি অব নেফ্রোলজি ইন্টারভেনশনাল থেকে স্কলারশিপ পাই। তা কিন্তু নারী-পুরুষ হিসেবে পাইনি। আর এই স্কলারশিপ যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করেছি। নারীদের মুক্তি পেতে হলে সবার রুচির পরিবর্তন করতে হবে। আবার অনেক জায়গায় প্রশোমনের ক্ষেত্রে নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নারীদের কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের কথা, বিরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এতকিছুর পরেও নারীরা সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। সমাজে নারীদের প্রতি অশোভন আচরণ চাই না। পুরুষের সহযোগিতা চাই।

 

বঞ্চিত নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসাধারণ

ডা. ফারজানা রহমান দিনা

সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

আমি বলব, বৈজ্ঞানিক বা গঠনগত  বৈচিত্র্যের কারণে নারী জন্মগতভাবেই অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। নারীরা অনেক বেশি মাল্টি টেক্সার। নারী সেলাই করতে পারে, দুধ জাল দিতে পারে, টেলিফোন ধরতে পারে, নকশিকাঁথা বুনতে পারে এবং সেই নারীই মা হয়ে তার বাচ্চার মনের কষ্টগুলোকে ধরতে পারে। বুঝতে পারে তার কিশোরী কন্যা লাঞ্ছনার শিকার। নারীর রয়েছে ডাবল ক্রোমোজম, যাতে নারী প্রতিকূলভাবেও বাঁচতে পারে। অনেক কষ্ট নীরবে সহ্য করতে পারে। আমি দেখেছি যেসব মহিলার স্বামী দীর্ঘকালীন অসুস্থ, যারা বিধবা অথবা স্বামী গৃহ থেকে বঞ্চিত এমনকি যারা খুব কম বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন তাদের সিদ্ধান্তগুলো অসাধারণ।

 

নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যোগ্য নারীকে সুযোগ দিতে হবে

শাহ্নাজ মুন্নী

চিফ নিউজ এডিটর, নিউজ টোয়েন্টিফোর

সব সময় বলা হয় প্রচুর মেয়ে সাংবাদিকতায় এসেছে। তারা সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করছে। এমন অংশগ্রহণ নারীদের জন্য উদাহরণ তৈরি করছে। বাস্তবে চিত্রটা ততটা ঝলমলে নয়। বাংলাদেশের সব সাংবাদিকের ৮৪ শতাংশ পুরুষ বাকি ১৬ শতাংশ নারী। অথচ যাদেরকে দেখে খুব পুলকিত হই তারা হয়তো উপস্থাপিকা। তারা মূল ধারার সাংবাদিক নন। মাঠ পর্যায়ে কাজ করার সাংবাদিকের পরিমাণ কম। এর প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায় গণমাধ্যমের নিয়োগকর্তারা চান না যে নারীরা আসুক। অনেক সময় পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে বেশি প্রমাণ করতে হয় নারীটি যোগ্য। আমার মনে হয় পুরো সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যোগ্য নারীকে সুযোগ দিতে হবে।

 

সব গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে

জিন্নাতুন নূর

সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলাদেশ প্রতিদিন

ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক ভালো। কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়াতে নারীর অংশগ্রহণ কম। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিকসহ সব গণমাধ্যমে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। প্রিন্ট মিডিয়াতে কাজ করার সময় নারীদের অনেকেই মাতৃত্বকালীন ছুটি উপভোগ করতে পারেন না। সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে দেখতে হবে। নারী বলে কাজ করতে পারবে না— এ ধারণার এখন আর ভিত্তি নেই। নারীর তৈরি প্রতিবেদনগুলো সংবাদপত্রে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করতে হবে। এতে নারী কাজের ক্ষেত্রে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। স্বাধীনতার এত বছর পরও নারীর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে না পারাটা  দুঃখজনক। নারীর সম্পাদক হওয়া এখন সময়ের দাবি।

সর্বশেষ খবর